যৌতুকের নামে মিথ্যা মামলায় করণীয় কী?

দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে আপনি পাল্টা মামলা করতে পারেন। এছাড়া মিথ্যা নালিশ আনয়নকারী সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ করা যায়। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয় এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করা যায়। দন্ডবিধির ১৯১ ও ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তির জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের কথা উলেস্নখ আছে

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
রুহল আমিন (ছদ্মনাম) একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। এরই মধ্যে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনের চাকরি পেয়ে যায়। এক আত্মীয়ের সুবাদে পরিচয় হয় আফরিনার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। পরিচয় থেকে ভালোলাগা, ভালোবাসা অবশেষে বিয়ে। চাকরির কাজে রুহুল সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে বাসায় ফেরে। আফরিনা গৃহবধূ। লেখাপড়া জানলেও কোনো চাকরি করে না। কিন্তু আফরিনা দীর্ঘসময় বাসার বাইরে থাকে। জিজ্ঞাসা করলে সোজাসাপটা উত্তর একা বাসায় থাকতে ভালো লাগে না, ভয় করে ইত্যাদি কারণে বান্ধবীর বাসায় যাই বলে রুহুলকে জানায়। রুহুল আমিন পরে জানতে পারে অন্য এক ছেলের সঙ্গে আফরিনার পরকীয়ার কথা। শোধরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বরং উল্টো সব ঘটনা ঘটতে থাকে। অস্থির হয়ে ওঠে রুহুল আমিন। অবশেষে তালাকের সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে আফরিনা আক্রমাণাত্মক হয়ে ওঠে। যৌতুক, নারী নির্যাতন ও অন্যান্য মামলার ভয় দেখায়। যেই কথা সেই কাজ। আফরিনা নিজ জেলা আদালতে রুহুল আমিনের নামে যৌতুকের মিথ্যা মামলা করে। সম্প্রতি 'যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮'-পাস হয়েছে। বিয়ে উপলক্ষে বর বা কনে যে কোনো পক্ষের কাছ থেকে বিয়ের আগে, বিয়ের সময়ে কিংবা বিয়ের পরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শর্ত আরোপ বা দাবি করে যে সব অর্থসামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ বা অন্য যা কিছু আদায় করে তাকেই যৌতুক বলে। যৌতুক নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে নেবে বা যারা দেবে তাদের সবারই সাজা হবে। এ জন্য যৌতুক নেওয়ার অপরাধকে বলা হয়েছে জামিন অযোগ্য। যৌতুক নেওয়ার জন্য শাস্তি হবে ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডই হতে পারে। যে ব্যক্তি যৌতুক নেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করবে তাদেরও একই রকম শাস্তি হবে এবং যে ব্যক্তি যৌতুক দাবি করবে তারও একই রকম শাস্তি হবে। এ ছাড়া যৌতুক গ্রহণের জন্য যদি কেউ উদ্বুদ্ধ করে বা প্ররোচিত করে সেই ব্যক্তিও ৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধী হবে এবং তার শাস্তি হবে। 'মিথ্যা মামলাসংক্রান্ত শাস্তির ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা করেন বা করান তাহলে তিনি বা তারা অনধিক ৫ বছর মেয়াদের কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। কিছু মানুষ (পুরুষ-নারী-নির্বিশেষে) সবসময় ছিল, আছে এবং থাকবে যারা সুযোগের অপব্যবহার করেছে, করে এবং করবে। তাহলে ভুুক্তভোগীদের জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা কী? দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া কিংবা সমাজের চোখে ছোট করে দেওয়া, আদৌ কাম্য হতে পারে না। সত্যিকার যৌতুকের শিকার হলে কি করবেন যৌতুকের শিকার হলে কোনো পক্ষ তার কাবিননামাসহ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সরাসরি মামলা করতে পারে। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় এ মামলা করতে হয়। কাছের থানায় গিয়ে এজাহার করতে পারেন। আর যৌতুকের জন্য মারধরের শিকার হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রথমে থানায় এজাহার করার চেষ্টা করতে হবে। এজাহার কোনো কারণে পুলিশ না নিলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালে গিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রমাণসহকারে মামলা করা যাবে। মারধরের শিকার হলে চিকিৎসা সনদ সহকারে মামলা করা উচিত, না হলে মামলা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। যৌতুকের অভিযোগে যে কেবল স্ত্রীই মামলা করতে পারবেন, তা নয়, স্ত্রী যদি যৌতুক দাবি করেন, স্বামীও স্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করতে পারেন। তবে স্ত্রী ভরণপোষণ ও দেনমোহর বাবদ কোনো টাকা দাবি করলে তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না। মিথ্যা যৌতুক মামলা থেকে বাঁচতে কি করবেন যদি মিথ্যা মামলার শিকার হয়েই যান কেউ, তাহলে আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মামলাটি লড়ে যেতে হবে। যদি দলিলপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ ঠিক থাকে, তাহলে মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই মিলবে। মামলা থেকে পালিয়ে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এতে আপনার অনুপস্থিতিতেই সাজা হয়ে যেতে পারে। একজন আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবেন। জামিন না-হলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করতে হবে। এ ছাড়া আপনি মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন। অনেক সময় কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিকে আদালতে প্রেরণ করা হয়। তাই আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে হবে। মনে রাখতে হবে যদি থানায় মামলা না হয়ে আদালতে সিআর মামলা হয় তাহলে আদালত সমন দিতে পারেন কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন চাইতে পারেন। মনে রাখবেন দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে আপনি পাল্টা মামলা করতে পারেন। এ ছাড়া মিথ্যা নালিশ আনয়নকারী সব ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ করা যায়। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয় এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করা যায়। দন্ডবিধির ১৯১ ও ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তির জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের কথা উলেস্নখ আছে। দন্ডবিধির ২০৯ ধারামতে, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে হবে। আবার ২১১ ধারায় মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে কোনো অভিযোগ দায়ের করলে অথবা কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছে মর্মে মিথ্যা মামলা করলে মামলাকারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ড কিংবা উভয়দন্ডে দন্ডিত করারও বিধান রয়েছে। তবে অভিযোগের বিষয় যদি এমন হয় যে যার কারণে মৃতু্যদন্ড, যাবজ্জীবন বা সাত বছরের ওপর সাজা হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তাহলে দায়ী অভিযোগকারীর সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৭ ধারায়ও মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তির কথা উলেস্নখ আছে। এখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কারও ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এই আইনের অন্য কোনো ধারায় মামলা করার জন্য আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন অথবা করান, তবে সেই অভিযোগকারী অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা।