ধর্ম অবমাননা, বস্নাসফেমি আইন ও মানবাধিকার

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০

আইন ও বিচার ডেস্ক
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশেই 'বস্নাসফেমি', 'ধর্মীয় অবমাননা' এবং 'ধর্মত্যাগ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাস্তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত্রম্নতা, জমি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রেও হাতিয়ার করা হয় এসব আইনকে। প্রায় ১০ বছর ধরে গৃহবন্দি ছিলেন আসিয়া বিবি। শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তাকে অব্যাহতি দেয়। আসিয়া বিবির এ ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু ধর্ম অবমাননার অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও তাকে কী পরিমাণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, তা জানেন না বিশ্ববাসী। ২০১৯ সালের মে মাসে পাকিস্তান ছেড়ে ক্যানাডায় চলে যান আসিয়া বিবি। সেখানেও তাকে দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায়। আসিয়াকে হত্যা করার আহ্বান জানিয়ে এক ভিডিও পোস্ট করে এক ধর্মীয় উগ্রপন্থি। এখনো নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আসিয়া। কী অভিযোগ ছিল আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে? মনগড়া কিছু বাজে কথা, যা নিয়ে মন্তব্য করারও প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু পাকিস্তানে এসব অভিযোগ পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবেই নেয়া হয়। এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও তা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। আসিয়া বিবির ঘটনা ছিল ব্যতিক্রম। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তার ১০ বছরের নরকবাসের একটা অংশই কেবল গণমাধ্যমের নজর কেড়েছে, বাকিটা রয়ে গেছে আড়ালেই। পাকিস্তানের 'কালো আইন' আসিয়া বিবির মতো ঘটনা বস্নাসফেমি নিয়ে চলমান নৈরাজ্যের বিষয়টি তুলে ধরেছে। তার এই ঘটনা নিয়ে খুন হতে হয়েছে দুজনকে। ২০০৯ সালে পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত আসিয়া বিবিকে দেখতে যান। কারাকক্ষ থেকে বের হয়ে পাকিস্তানের বস্নাসফেমি আইনকে 'কালো আইন' বলে আখ্যা দেন। ২০১১ সালে এই বক্তব্যের জন্যই তাকে প্রাণ দিতে হয়। একই কারণে প্রাণ হারান সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও। বস্নাসফেমি আইনের সমালোচনা করে আসিয়া বিবির পক্ষে কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন তারা। গভর্নরের হত্যাকারী ছিল তারই দেহরক্ষী। সুষ্ঠু বিচার শেষে মুমতাজ কাদরিকে মৃতু্যদন্ড দেয়া হয়। লাখ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী এবং নিরক্ষর সহানুভূতিপ্রবণ জনতা এই ঘাতককে সমর্থন করেছিলেন। তাকে শহিদের মর্যাদাও দিয়ে জান্নাতের দরজা প্রশস্ত বলেও মন্তব্য করেন অনেকে। ২০১৫ সালে যখন হত্যাকারীর মৃতু্যদন্ড ঘোষণা করা হয়, পুরো পাকিস্তানে ছিল শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা। প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসাইন কি তাকে ক্ষমা করে দিবেন? বস্নাসফেমির কারণে হত্যা করেও ক্ষমা পাওয়ার দৃষ্টান্ত কি স্থাপন হবে? ফলে ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রম্নয়ারি যখন হত্যাকারীর মৃতু্যদন্ড সত্যিই কার্যকর হলো, জনগণ বেশ অবাকই হয়েছিলেন। তারপর এক সপ্তাহ ধরে উগ্রবাদীরা রাজধানী ও অন্যান্য নগর স্তব্ধ করে দিয়ে রাজপথ কাঁপিয়েছে। রাশিয়া (স্থগিত) এবং বেলারুশ (চালু) ছাড়া ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই মৃতু্যদন্ড বিলোপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেটের ১৩টিতে মৃতু্যদন্ড স্থগিত করা হয়েছে, ২১টিতে বিলোপ করা হয়েছে। পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এখনও মৃতু্যদন্ড চালু রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গভর্নরের হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে প্রেসিডেন্টের অস্বীকৃতি দারুণ একটি বিষয়। মুসলিম বিশ্বের অনেক অংশে প্রথাগত আইনের দৃঢ় প্রত্যাখ্যান এটি। একবিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ 'বস্নাসফেমি', 'ধর্মের অবমাননা' এবং 'ধর্মত্যাগের' বিরুদ্ধে আইন করেছে। পাকিস্তান, অরান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া এবং সোমালিয়াতে বস্নাসফেমি এবং ধর্মত্যাগের শাস্তি মৃতু্যদন্ড। মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, সুদান এবং মৌরিতানিয়াতেও ধর্মত্যাগের শাস্তি মৃতু্যদন্ড। অন্য অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নানা মোড়কে বস্নাসফেমি আইন চালু রয়েছে। ১৯৮৪ সালের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশন অগ্রাহ্য করে অনেক জায়গাতেই প্রকাশ্যে দোররা মারার মতো নিষ্ঠুর শাস্তিও দেয়া হচ্ছে। উদাহরণ ইন্দোনেশিয়াতেও কোরআনের একটি আয়াত নিয়ে কথা বলায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জাকার্তার সাবেক গভর্নর বাসুকি চাহাইয়া পুর্নামাকে দুই বছর কারাগারে কাটাতে হয়। পুর্নামা নৃতাত্ত্বিকভাবে একজন চীনা খ্রিস্টান ছিলেন। ২০১৮ সালে আরেক নৃতাত্ত্বিক চীনা বৌদ্ধ মেইলিয়ানাকে ১৮ মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। তার অপরাধ কী ছিল? তার আবাসস্থলের তারপাশে মসজিদের মিনার থেকে আযানের উচ্চ ধ্বনি নিয়ে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। তার এই অভিযোগকে 'ইসলামকে অপমান' করার ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মানবাধিকারের লঙ্ঘন এই ঘটনাগুলো মৌলিক মানবাধিকারের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের গ্রহণ করা মূলনীতিকেও অগ্রাহ্য করে এসব নীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যা ও বীভৎস যুদ্ধাপরাধের বিপরীতে গিয়ে ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস গ্রহণ করা হয়। তা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন নৃশংসতা এখনো ঘটে, এবং মানবাধিকারই সবার আগে ভূলুণ্ঠিত হয়। ডয়েচে ভেলে অবলম্বনে