জলডাঙ্গার হাতুড়ে ডাক্তার

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২০, ০০:০০

ওমর খালেদ রুমি
সবুজ গ্রামগুলোর সবুজটা জলডাঙ্গায় এসে এতটাই ঘনীভূত হয়েছে যে, মনে হয় দিনের বেলায়ও কেমন যেন একটা গা ছম ছম করা নীরবতা। এই নিভৃত পলস্নীরই একটা আরও নীরব কোণে একজন হাতুড়ে ডাক্তারের ঘর। বয়স তার আশি ছুঁইছুঁই। বুড়ো হয়ে যাওয়া হাড়গুলোতে ঘুণ ধরেছে সেই কবে? ডাক্তার তবুও যেন বিশ্রামহীন। মাঝে মাঝে সেও ভাবে কারও জন্য সে আর তার জায়গা ছেড়ে উঠবে না। কিন্তু শেষমেষ আর পারে না। অসুস্থ মানুষের আত্মীয়স্বজনরা এতটাই কাকুতি-মিনতি করে যে, শেষ পর্যন্ত ডাক্তারকে উঠতেই হয়। নড়বড়ে শরীরটায় দুয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়ে বুক ভরে কিছু নিঃশ্বাস টেনে দমটা বাড়িয়ে নেয়। হয়তো অনেকটা পথ হাঁটতে হবে রোগীর বাড়ি যেতে। হয়তো পাঁচ/দশটা টাকা দেবে ঠিকই, কেউ বা আবার হয়তো কিছুই দেবে না। ওষুধের দামটাও কখনো কখনো বাকি পড়ে যায়। ডাক্তারকে তবুও যেতে হয়। টাকা-পয়সা বড় কথা নয়। এই জনবিচ্ছিন্ন গাঁও-গেরামে সে না গেলে রোগীর আর কি গতি হবে? ডাক্তার বলতে তো সে-ই। আসলে তাকেও কী ডাক্তার বলা যায়? ডাক্তারির ওপর মূলত তারও কোনো পড়াশুনা নেই। বাপ ছিল কবিরাজ। গাছপালা ছেঁচে ওষুধ তৈরি করত। সেও প্রথম জীবনে তাই ছিল। তারপর সময় বদলাতে থাকে। '৪৭-এর দেশভাগের পর কেমন যেন একটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করে। শুধু কবিরাজি বিদ্যা দিয়ে তখন আর ঠিক চলছিল না। তাই আস্তে আস্তে অ্যালোপ্যাথিক বিদ্যার হাতেখড়ি। না কোনো মেডিকেল কলেজ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানেও নয়। বিভিন্ন মাধ্যম ঘেঁটে, অনেক ঘাটের জল খেয়ে, ওষুধের গুণাগুণ জেনে তবেই না তার প্রয়োগ। আর এভাবেই কবিরাজ থেকে ডাক্তার হয়ে ওঠা। দেশভাগের সময় তার বয়সও যে একেবারে কম তা কিন্তু নয়। চলিস্নশ ছুঁইছুঁই। তার বিয়েটাও হয় ঠিক ওই সময়টাতেই। বলতে গেলে কবিরাজি করতে করতে বিয়ে করতে কিছুটা দেরিই হয়ে গিয়েছিল বটে।  ডাক্তারও নিজ জীবনে কম কিছু দেখেননি। সেই ১৯০৭ সালের দিকে তার জন্ম। তার বাপও তখন পরিণত বয়স পেরিয়ে বার্ধক্যে পা রাখতে যাচ্ছেন। ডাক্তার তখনই পৃথিবীর আলো দেখলেন। বাংলা তখন স্বদেশি আন্দোলনে কাঁপছে। ডাক্তার হলেও তার বাপ রাজনীতি সচেতন ছিল। তার বাপের কাছ থেকেই শুনেছেন স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থনের কথা। হিন্দুরা তখনো দুই বাংলা ভাগ করার কথা ভাবতেই পারত না। ডাক্তারের মতো ডাক্তারের বাপেরও বিয়ে করতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। মূলত অভাবী জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে গিয়ে অনেক সময় অনেক কিছুই ঠিক সময়ে করা হয়ে উঠে না। তাছাড়া কবিরাজি বিদ্যার প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক থাকায় সব সময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকত।  পিতার হাত ধরেই তার বেড়ে ওঠা। বাপ বেঁচে থাকতে যতটা পেরেছেন তার কাছ থেকে শিখে নিয়েছেন। তারপর  তার রেখে যাওয়া বইপত্র ঘেঁটে দিনে দিনে উন্নতি করার চেষ্টা করেছেন। ডাক্তার যখন একজন পরিপূর্ণ যুবক তখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। শেরে বাংলার লাহোর প্রস্তাব ঘোষণার পর কেউ কেউ একটা ঈষৎ আলাদা ধারাটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে থাকে। ঘুমিয়ে পড়া মুসলিম লীগ যেন আচমকা জেগে ওঠে। ধীরে ধীরে এটা স্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে যে, হিন্দু-মুসলমানদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলছে। মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র হয়তো সময়ের ব্যাপার। তখন থেকেই ডাক্তার লক্ষ্য করতে লাগল তারই হিন্দু ভাইদের অনেকেই মনে মনে ওপারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক ডাক্তারের মাথায় আসে না, যখনই কোনো রাজনৈতিক বিষয় এসে দাঁড়ায় সেখানে জোর করে ধর্মকে টেনে এনে একটা সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা হয় কেন? তার রোগী তো হিন্দু মুসলিম সবাই। রোগী দেখতে যাওয়ার আগে তিনি তো কোনোদিন জিজ্ঞেস করেননি রোগীর নাম কি? সে হিন্দু না মুসলমান? এই কথা তো তার কখনো মাথায় আসেনি।  ডাক্তারের ভাবনা যাই থাক, '৪০ থেকে '৪৭ সময়কাল খুব একটা ভালো যায়নি তার। একটা অস্থিরতার মধ্যে দিয়েই কেটেছে পুরো সময়টা। এই সময়ই তার মাথায় বিয়ের ভাবনা আসে। অবশেষে সেই বিয়ে যখন সম্পন্ন হয় ততদিনে কতিপয় লোক তাদের ধারালো কাঁচি চালিয়ে উপমহাদেশের মানচিত্রকে তিনটি টুকরো করে ফেলেছেন। ছোট ছোট দুই টুকরো রুটি মুসলমানদের পাতে তুলে দিয়ে রুটির বড় টুকরোটাই তারা হিন্দুদের হাতে তুলে দিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা ডাক্তার এবং তার বাপের আদৌ পছন্দ হলো না। প্রথমত, এই অবৈজ্ঞানিক বিভাজন যেখানে মূলত সম্প্রীতির বদলে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ তার ওপরে এই অসম বিভাজন- এই দুটোর কোনটাই যে ভালো ফল আনবে না তা কবিরাজদ্বয়ের বুঝতে বাকি থাকল না। কিন্তু তাদের হাতে আর কিইবা আছে কেবল অস্থির হওয়া ছাড়া। এরকম একটা অস্থির সময়েই ডাক্তারের বাপ তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয়। এমনিতেই তাদের মাথায় ওপারে চলে যাওয়ার কোনো ভাবনা ছিল না তারপরও এই বিয়ের মাধ্যমে তাদের থেকে যাওয়ার ব্যাপারটা যেন আরও পাকাপোক্ত হয়ে যায়। পূর্ব বাংলার এই নতুন মাটিতেই ডাক্তার তার আগামী দিনগুলোর জন্য স্বপ্নের জাল বোনে। নিজেই নিজেকে আরও একবার সজোরে বলে, এ মাটি আমারও। নতুন সংসারে সুখের কোনো কমতি হয় না তাদের। একটু বয়সে বিয়ে করলেও ডাক্তারের নতুন বউ তাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে যারপরনাই খুশি। স্বামীর মতো তার ভাবনাও ওই একই। এ মাটি ছেড়ে কেন যাব। তার এই ভাবনাটা ডাক্তারের খুবই ভালো লাগে। সে নতুন ভূমিতে নতুন স্বপ্নের বীজ বোনার স্বপ্ন দেখে। ডাক্তারের সংসারে সুখের অভাব নেই। কিন্তু কেন জানি সন্তান আসতে দেরি হচ্ছিল। একে তো দেরি করে বিয়ে তার ওপর উত্তরাধিকারের মুখ দেখতে দেরি হওয়ায় ডাক্তার ভেতরে ভেতরে কিছুটা অস্থির ছিল। কিন্তু এসব অস্থিরতা তাকে মোটেই ঘাবড়ে দিতে পারছিল না। তিনি বরাবরের মতো স্থির আর শান্ত থাকলেন। পিতার কাছ থেকে পাওয়া অনেকগুলো গুণের মধ্যে কবিরাজের এটাও একটা বড় গুণ। ডাক্তার লক্ষ্য করতেন তার পিতা সুযোগ পেলেই গীতা নিয়ে বসতেন। পথ চলতে চলতে তিনি ডাক্তারকে পরিস্থিতি অনুযায়ী গীতার শ্লোক শোনাতেন। এভাবেই পিতার কাছেই ডাক্তারের গীতায় হাতেখড়ি। নতুন পূর্ব বাংলায় সব কিছু বদলে যেতে থাকে। সমাজ ব্যবস্থার এই পরিবর্তন, যা মূলত বিপরীতমুখী, ডাক্তারের কাছে সংগত মনে হয় না। অবশ্য এই পরিবর্তন শুধু ডাক্তার কেন হিন্দু-মুসলমান কারোরই মনঃপুত নয়। হওয়ার কথাও নয়। হাজার মাইল দূর থেকে ভিনদেশি সেজে শাসনকার্য চালালে যা হয়। ঘটনাপ্রবাহ দিন দিন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। বাঙালির মেধা আর মননের সঙ্গে এর সম্পর্ক কোনো কালেই ছিল না। বাঙালি বরাবরই তার হাজার বছরের সংস্কৃতি নিয়েই মজে ছিল। এখন বিভাজনের যে সূক্ষ্ণ সীমারেখা টানা হচ্ছে তার ভাঁজে ভাঁজে শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট উভয় শ্রেণিরই যেন নাভিশ্বাস উঠছে দিন দিন। এ অবস্থা থেকে কবে যে মুক্তি মিলবে কে জানে? দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর পেরিয়ে যায়। সংসার যেন দিন দিন বিবর্ণ আর মলিন হয়ে আসে। ঠিক এরকম একটা সময়ে ধূসর মেঘমালা সরে গিয়ে যেন আলোর রেখা ফুটে ওঠে। ডাক্তার অবশেষে পুত্র সন্তানের মুখ দেখেন। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের দুই প্রান্তেই যে ঘটনাটি যুগপৎ ঘটে তাহলো মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তার ধস। মূলত কেন এমনটা হয়েছিল? এই জিজ্ঞাসার পেছনে হয়তো অনেক জবাব রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিমাত্রই জানে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য। আর পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে এর প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। পাকিস্তানের দুই প্রান্তের মুসলমানরা আধুনিক ও উত্তর আধুনিক বাস্তবতায় মুখ দেখলেও ভারতের ভেতর রয়ে যাওয়া মুসলমানরা চিরদিনের জন্য রয়ে যায় এক গভীর অন্ধকারে। বিচ্ছিন্নতা তার সংখ্যালঘুতার দায় নিয়ে একটা মাথা উঁচু করা জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের মতো পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলো থেকে অমবস্যার গাঢ় গভীর অন্ধকারে হাঁটতে শুরু করে। সে ভ্রমণ তাদের আজও অব্যাহত আছে। এসব জিনিস ডাক্তারকে বড় বেশি পীড়া দেয়। ডাক্তার মানুষে মানুষে ভেদাভেদে বিশ্বাস করেন না। তার বাপ তাকে তা শিখানওনি। তিনি সবসময় মানবতার কথা বলতেন। গীতা যেমন জানতেন হাদিস-কোরআনও কম জানতেন না। মানুষকে সম্মান করতেন শুধু মুখের কথা দিয়ে নয়। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে। অসুস্থ ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে। চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তুলে তার মুখে যে হাসিটা তিনি দেখতেন তার দাম তার কাছে লাখ টাকার চেয়ে বেশি। সেই রোগী হিন্দু না মুসলিম তাতে তার কিছুই আসে যায় না। রোগী সুস্থ হয়েছে দেখে গাঁয়ের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অজস্র্র জ্যোৎস্ন্নালোকিত রাতে একাকী নিঃসঙ্গ চাঁদের নিচে বাড়ি ফিরতে গিয়ে কতোবার যে তিনি তার অশ্রম্ন সংবরণ করতে পারেননি তার সাক্ষী শুধু তিনি নিজেই। অজস্র কালোর ভেতরেও এই পৃথিবী যে কত নাম না জানা আলো ধারণ করে তার খবর কজনই বা রাখে। পাকিস্তানের দুই প্রান্তেই গণতন্ত্রের আশা মূলত শেষ করে দিচ্ছিল শাসকগোষ্ঠী। তারা বুঝতে পারছিল তাদের আবেদনে মানুষ হয়তো আর সাড়া দেবে না। তাই সংবিধান প্রণয়নে দীর্ঘ সূত্রতা, নির্বাচিত সরকারকে বিব্রত করা, গভর্নরের শাসন জারি করে জনমতের বিরুদ্ধে শাসনকার্য চালানো, আর যখন সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ তখন নির্মম সামরিক শাসন চাপিয়ে দেওয়ার দুরভিসন্ধি মূলত একটা মিশ্র জনগোষ্ঠীর মানুষকেও অন্তত একটা ভাবনার সুতায় বাঁধতে পেরেছিল যে, আর যাই হোক জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে তারা সবাই শোষিত। আর এই ভাবনাটাই হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই একটা পস্নাটফরমে নিয়ে আসতে বাধ্য করল। অজস্র্র বাস্তবতা সামনে এলেও নানা কারণে একজন মানুষ (ডাক্তার) দেশ ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমানোর ভাবনা মাথা থেকে একেবারেই সরিয়ে ফেললেন। তিনি এটাই ধরে নিলেন, এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠী যারা মূলত বঞ্চিত তারা হিন্দু কিংবা মুসলিম যাই হোক অন্তত দুঃখী মানুষ। ডাক্তার চলে গেলে এদের চিকিৎসাটা অন্তত কে দেবে? মধ্যরাতে অসহায় মানুষ যখন হাতে একটা হ্যারিকেন কিংবা মশালের আলো নিয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, ডাক্তারমশায়, বাড়িতে আছেন, ডাক্তার তখন তার হাতের কাছের কালো জীর্ণশীর্ণ ব্যাগটাকে নিয়ে হন্ত দন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে বলে, হঁ্যা, আছি। কোথায় যেতে হবে? সে চলে গেলে এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর অসহায় মানুষগুলো যে অন্তত একজন হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসাও পাবে না এটা সে ভালোভাবেই বোঝে। রোগী দেখে রাতের অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে যখন ঘরে ফেরে তখন তার সমস্ত শরীর জুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি। তবু একটা অন্যরকম ভালো লাগা তার হৃদয়ে যে অনাবিল প্রশান্তি আনে তাতে বাকি রাতটুকু সে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। দেখতে দেখতে ডাক্তারেরও বয়স বাড়ে। ডাক্তারের ঘর আলো করে এখন দুটো পুত্র সন্তানের পাশাপাশি দুটো কন্যা সন্তান যেন চার চারটি চাঁদের টুকরো হয়ে খেলা করে। বড় ছেলেটি বাপকে একটু একটু করে সহযোগিতা করতে শিখেছে। এই সহযোগিতাটুকুই যেন অনেক কিছু। ডাক্তার মনে মনে আশাবাদী হয় এই ছেলেটাই হয়তো বড় হয়ে বাপ-দাদার জায়গাটা ধরে রাখবে। পাকিস্তানের শেষের দিনগুলোতে অস্থিরতা যেন বহুগুণে বেড়ে যায়। কি হিন্দু কি মুসলমান কেউই যেন ভালো নেই। বিশেষ করে শেখের '৬৬-এর ছয় দফা ঘোষণার পর পাকিস্তানিরা যেভাবে চড়াও হচ্ছে তাতে ভালো থাকা দায়। এই অস্থিরতা যেন রাজধানী থেকে গাঁয়ের একটা ছোট্ট কুটিরেও আছড়ে পড়ছে। সময় যত সামনে গড়ায় অস্থিরতা তত বাড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় ডাক্তার বাড়ি ফিরলেন। হঠাৎ করেই তার এক প্রতিবেশী ডাক দেয়। ডাক্তার থমকে দাঁড়ায়। প্রতিবেশী একটু সামনে এগিয়ে এসে বলে, তাহলে শেষ পর্যন্ত রয়েই গেলে। ডাক্তার ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর ধীর কণ্ঠে বলে, গিয়েই বা কি লাভ! ওপারেও তো মানুষ।  '৬৮তে এসে পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোলাটে হতে থাক। হিন্দুরা কেন জানি একটু একটু করে অস্থির হয়ে ওঠে। এই অস্থিরতা কেউ কারো কাছে প্রকাশ না করলেও তাদের অবচেতন মন কিছুটা হলেও বুঝতে পারে একটা পরিস্থিতি সামনে আসছে। তা ভালো না মন্দ হয়তো সময় হলেই তা বোঝা যাবে।  '৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন হলে বাঙালি ধীরে ধীরে আশাবাদী হয়ে উঠে। হিন্দুদের মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করে। যদি দেশ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায় পাকিস্তানিরা তো এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না। সে ক্ষেত্রে তারা যতটা না তাদের স্বধর্মের ওপর চড়াও হবে তার চেয়ে অনেক বেশি চড়াও হবে অন্য ধর্মের ওপর। তাদের মনে এই সংশয় দেখা দেয় যে, সত্যি সত্যিই তাদের আবার উদ্বাস্তু করা হবে না তো কিংবা করা হবে না তো হত্যাযজ্ঞের শিকার।  ইয়াহিয়া নির্বাচনের দিকেই হাঁটলেন। ব্যাপারটাকে মন্দ বলা যাবে না। যথাযথ সংস্কারও করলেন। বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ভোটের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। আর '৭০-এর নির্বাচনে তার প্রতিফলনও ঘটল। ১৯৭১-এ এসে যুদ্ধটা বেঁধেই গেল।  এই প্রথম ডাক্তার কিছুটা অনিশ্চয়তা অনুভব করল। মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল। তারপর মে। তেমন কিছুই ঘটল না। কিন্তু ঘটনা ঘটতে শুরু করল জুন থেকে। পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রামে গ্রামে ঢুকে হিন্দুদের ঘরবাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিতে শুরু করল। ব্যাপারটা ডাক্তারকে দারুণভাবে ব্যথিত করল। কেন এই আচরণ? হিন্দু হওয়ার সঙ্গে এর কিসের সম্পর্ক? ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত কারো কাছেই নেই। কিছু মানুষ মূলত তার বিধানের বাইরেও আদি প্রবণতা দ্বারা পরিচালিত। এর ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। দেখতে দেখতে একদিন ডাক্তারের বাড়িটাও আগুনে পুড়ে যায়। শুধু ডাক্তারের বাড়িটা বললে ভুল হবে। পুরো গ্রামটাই। এ গ্রামটায় মূলত হিন্দুদেরই বেশি বসবাস। দেখতে দেখতে যুদ্ধ একদিন শেষ হয়। বাংলাদেশের নতুন মাটিতে ডাক্তার এবং তার পরিবার আবারও জীবনের গন্ধ খুঁজে নেয় যদিও প্রতিবেশীদের কেউ কেউ ততদিনে ওপারে চলে গেছে।