করোনাকালের আলো

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২০, ০০:০০

সাজ্জাক হোসেন শিহাব
অনেক দিন পর নোংরা জানালার শিক ধরে বাইরের আলো মুখে মাখে নাসরিন। নিমিষেই কেমন আনমনে হয়ে যায় সে। স্মৃতির গলি বেয়ে সামনে আসে অতীত। তার মনে পড়ে- এমনই এক আলো ঝলমলে দিনে ছোট একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে তার প্রথম দেখা হয়েছিল রায়হানের সঙ্গে। প্রথম দেখাতেই রেস্তোরাঁর ম্যানেজার রায়হানকে তার ভালো লেগেছিল। রায়হানও কিন্তু এগিয়ে এসেছিল প্রেমের হাত বাড়িয়ে। দুজনের ভালো লাগা গিয়ে এক সময় ঠেকে বিয়েতে। বাবা-মা হারানো নাসরিনের জীবনে যেনও একটা পর্বত হয়ে দাঁড়ায় রায়হান। সেই পাহাড় সব ঝড় থেকে আগলে রাখে নাসরিনকে। রায়হানের আগমনে স্বপ্নের মতো নাসরিনের জীবনের সব শঙ্কা কেটে যায়। নাসরিনের মতো এমন ভালো বউ পেয়ে একলা চলা রায়হানও খুব খুশি হয়। রায়হানের একার সংসারে যুক্ত হয় নাসরিনের আলো। সেই আলোতে যুগল জীবন মধুময় হয়ে ওঠে। তারা মাঝেমধ্যে ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। মন খুলে আলাপ করে। দুবছরের মধ্যে তাদের ঘর আলোকিত করে আসে এক কন্যাসন্তান। হাশিখুশিতে ভরে ওঠে সংসার। ঢাকা শহরে তারা প্রতিদিন ভালোবাসার ফুল ফোটায়। তারা থাকে ভাড়া বাসায়। তাদের এমন সুখ দেখে বাড়িওয়ালা মাঝেমধ্যে বলে- এমন সুখী পরিবার এই বাসায় আর দ্বিতীয়টি নেই। এমন কথাশুনে হো হো করে হাসে নাসরিন আর তার স্বামী। এভাবে সুখেই দিন কাটাতে থাকে তারা। একদিন মেয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। তার চেঁচামেচিতে ভরে থাকে ঘর। রায়হান প্রতিদিন সকালে বের হয়। ফেরে গভীর রাতে। সব হিসাব বুঝিয়ে তাকে ঘরে ফিরতে হয়। একদিন রায়হানের ফিরতে খুব দেরি হচ্ছিল। তার ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছিল। সারারাত নাসরিন জেগে থাকে। দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে থাকে। কিন্তু সে কিছুতেই পাচ্ছিল না রায়হানের খবর। অবশেষে একদম ভোরবেলা তার অপেক্ষার অবসান ঘটে। মোবাইলে একটা দুঃসংবাদ আসে, যা শোনার জন্য পৃথিবীর কোনো নারী প্রস্তুত থাকে না। নাসরিন শুনতে পায় এক ছেলের কণ্ঠ-রায়হান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে! মুহূর্তেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় তার। ঝড়ের বেগে সবকিছু বদলে যায়। আবারও শুরু হয় একলা চলা। হার না মানা নাসরিন মেয়ের কথা ভেবে আর বিয়ে করেনি। এরপর জীবনের প্রয়োজনে অনেক কষ্টে একটা শপিং মলে চাকরিতে ঢোকে সে। ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে নেয় নাসরিন। স্বামীকে ছাড়া যতটুকু ভালো থাকা যায়, ততটা ভালো ছিল সে। কিন্তু হুট করে করোনা আসে জমের মতো। তার স্বপ্নকে চুরমার করে দেয়। চাকরি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তার জীবনে নেমে আসে আরও এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা। দুর্যোগের পাশাপাশি দুর্ভোগে নেমে আসে জীবনে। বাসা ভাড়া দিতে পারে না সে। হাসিমুখের বাড়িওয়ালা ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করে, অসুবিধা নেই। পৃথিবীতে কোনো কিছুই এমনিতে হয় না। থাকতে হয় বিনিময়। সেটাতে সায় দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। কিন্তু বাড়িওয়ালার সেই আদিম ইশারায় নাসরিনের আগ্রহ নেই। এদিকে বাসা ভাড়ার বাকিটা বাড়তে থাকে। নাসরিনের কাছ থেকে ফায়দা নিতে না পেরে বাড়িওয়ালা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে উঠেপড়ে লাগে। সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে এখন কোথায় যাবে নাসরিন! এই শহর কেন, এই পৃথিবীতেই তার কাছের বলতে কেউ নেই, যে নাসরিনকে আশ্রয় দেবে! নাসরিন তবুও এখানে-সেখানে চেষ্টা করে। কোথাও কোনো ঠাঁই পায় না সে। অল্প টাকায় একটা রুম ভাড়া খোঁজে। কিন্তু ঢাকা শহরে কেউই এমন মাকে বাসা ভাড়া দিতে চায় না। তাও আবার করোনার সময়। নাসরিন চোখে আঁধার দেখে। তার মনে করোনার ভয়। পেটে তীব্র ক্ষুধা। সামনে অনিশ্চিত যাত্রা। মেয়েকে নিয়ে হাজারো সংশয়। এক সময় দয়া হয় তার দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়ের। করোনাকালে যখন মাকে জঙ্গলে ফেলে যায় সন্তানরা, ছেলের লাশ রাস্তায় ফেলে যায় বাবা, অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার লাশ নিয়ে ঘুরে ঘুরে উপায় না দেখে যখন লাশ ফেলে দেয় নদীতে, যখন মসজিদের ইমামকে করোনায় মৃত লাশ দাফনের দায়ে যখন সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়, কিংবা লাশ আনতে রাস্তায় দেওয়া হয় বাঁধা; তখন এমন অনুকম্পা পাওয়াটা নাসরিনের কাছে বিশেষ অর্থবহ ঠেকে। মনে হয়, পৃথিবীতে কেউ না কেউ ভালোবাসা নিয়ে ফেরেশতার মতো সব সময় জেগে থাকে। নাসরিনের থাকার জায়গা হতেই সে এবার রোজগারের চিন্তায় মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু পৃথিবীর নির্মম নিয়ম তাকে রুদ্ধ করতে চায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠে না নাসরিন। উপায় না দেখে কী যেনও ভেবে স্বামীর দেওয়া সোনার চুড়ি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে সে দ্রম্নত ড্রাইভিং শেখে। হাতে তুলে নেয় স্টিয়ারিং। করোনাকালের প্রয়োজনীয়তা নাসরিনকে সাহসী করে তোলে। কিন্তু তাতেও তার শান্তি নেই। তাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয় অসামাজিক কাজের প্রস্তাব। এমনকি পতিতালয়ে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাবও আসে কান পর্যন্ত। নাসরিন দমে যায় না। গাড়িতে করে প্রতিদিন শক্ত হাতে ঢাকা শহরের অলিগলি চষে বেড়ায়। আত্মবিশ্বাস বাড়ে নাসরিনের। সে সামনে আগাতে থাকে। তার ভাগ্য বদলে যায় আবারও। জানালা দিয়ে এবার সে বিশাল আকাশে তাকায়। তার মনে হয়, পৃথিবী বদলে গেছে। প্রকৃতি বদলে গেছে। যুক্ত হয়েছে মানুষের মৃতু্য মিছিল। শুধু মানুষ বদলায়নি। হয়তো একদিন পৃথিবীর সব মানুষ সত্যি সত্যি বদলে যাবে। নষ্ট হওয়া জীবনে আসবে অবিরত আলোর মিছিল। কিন্তু আর কখনো ফিরবে না রায়হান। এই দেশে স্বামী ছাড়া একজন স্ত্রীকে কতটা সংগ্রামী হতে হয়, তার সঙ্গে ঘটে যায় কত অবর্ণনীয় ঘটনা! এসব ভাবতে ভাবতে চোখ ভিজে যায় নাসরিনের। আচমকা মেয়ের ডাকে টনক নড়ে তার। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে বলে- এই তো আমার আলোর মিছিল। আমার ভয়হীন আগামীর শুরু।