জন্মদিনের শুভেচ্ছা

মহাদেব সাহার কবিতা বেদনা ও বিরহের প্রশান্ত ছায়া

প্রকাশ | ০৭ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

সাইফুজ্জামান
বাংলা কবিতায় কবি মহাদেব সাহা স্বতন্ত্র ধারার এক কণ্ঠস্বর। তার কবিতায় অনুভূতি, আবেগ ও জীবনের কলস্বর তীব্র। প্রেম ও প্রকৃতি যুগলবন্দি করে তিনি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। বেঁচে থাকার আকুলতা, সংগ্রাম যুথবদ্ধ সুখ-দুঃখের পাঠ কবিতার চেতনাকে সংহত করেছেন। তার কবিতা জীবনালেখ্যের গভীর অনুরণের দোলাচালে ভরপুর। হৃদয় স্পর্শী পংক্তিমালা অভিজ্ঞতা, জীবনযাপন ও স্বপ্নে বন্দি। নিত্যদিনের ঘটনা, দৃশ্যমান জগতের ভেতর অবগাহন শেষে একজন প্রকৃত কবি তুলে আনেন জীবনাবিজ্ঞতার উপাদান কবিতায় ধরা পড়ে কবির বিচিত্র বোধ- যা শব্দ ও বাক্যে গ্রথিত হয়। এসব কিছু মা, মাটি, মানুষ যার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। মানব মানবীর সংবেদনশীলতায় সৃষ্ট জীবন রহস্যের গাঢ় আবেদন কবিতার অন্তর্গত ভূমিকে আদ্র করে তোলে। মহাদেব সখেদে যা উচ্চারণ করেন তার মধ্যে থেকে আমাদের চেনা জগৎ খুঁজে পাওয়া যায়। এই গৃহ, এই সন্ন্যাস, কাব্য গ্রন্থের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে তার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পরিণত। কবিতা দর্শনেরও জীবনের টানাপড়েন শুদ্ধ সুষমার জন্ম দেয়। মহাদেব আধুনিক। তার কবিতায় মানবিক সম্পর্ক, বেড়ে ওঠা ও সময় অতিক্রমনের জীবন্ত গাঁথা যেন সৌন্দর্যের আধার। নিত্যদিন দেখা, কথাবার্তা আর ভাব বিনিময়ের মধ্যে প্রেম জাগ্রত থাকে। প্রেমাস্পদের স্পর্শে ধন্য হয়ে ওঠে মন। প্রেমে বিরহ এক মৌলিক সত্তা। ফেসবুক, ইন্টারনেট, মুঠোফোনের যুগে যোগাযোগের কষ্ট কাউকে পীড়া দেয় কিনা আমরা জানি না। এক সময় যোগাযোগের এই আধুনিক মাধ্যম ছিল না তখন 'চিঠি' ছিল মনের ভাব আদান-প্রদানের প্রতিনিধি। প্রেমের আকুতি ছিল। প্রেমিক কত আবেগে উচ্চারণ করেছে : করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও আঙুলের মিহিন সেলাই ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও, এটুকু সামান্য দাবি- চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি। মহাদেবের কবিতায় প্রকৃতি ও প্রেম একাকার হয়ে আছে। দয়িতা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন তিনি প্রকৃতির কাছে আশ্রয় চাইবেন। একজন মানস প্রতিমার আচলই হতে পারে প্রেমিক কবির আশ্রয়স্থল। ব্যথিত কবি সেবাশ্রম, স্বাস্থ্য নিবাস ছেড়ে মানসীর কাছে পরম শান্তি ও স্বস্তির জন্য পৌঁছে যাবেন। নর-নারীর শাশ্বত প্রেমাকাঙ্ক্ষী কবিতার ধ্যানমগ্ন কবি উচ্চারণে বলেন : সবখানে ব্যর্থ হয়ে যদি যাই তুমিও ফেরাবে মুখ স্নিগ্ধ বনভূমি ক্ষুধায় কাতর তবু দেবে না কি অনাহারী মুখে দুটি ফল? মহাদেব সাহা বাংলা কবিতায় জাগর উচ্চারণ ও মানবিক জাগরণের সুতীব্র জীবনবোধ কবিতায় সংস্থাপন করেছেন। বৈশ্বিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লগ্নতা তার কবিতাকে পেলবতা দান করেছে। ক্লান্তি, হতাশা দুঃখবোধ তার কবিতার সহজজাত উপাদান। প্রেম, পেস্নটোনিক আকর্ষণ ও বিরহের অনুরননও আমরা কান পেতে থাকলে শুনতে পাই। সৌন্দর্য সন্ধান করে কবি নিজেকে চিহ্নিত করেছেন। একে একে প্রকাশিত হয়েছে তার উলেস্নখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : মানব এসেছি কাছে (১৯৭৩), চাই বিষ অমরত (১৯৭৫), কী সুন্দর অন্ধ (১৯৭৮), তোমার পায়ের শব্দ (১৯৮২), ধুলোমাটির মানুষ (১৯৮২), মানুষ ক্রন্দন জানে না (১৯৮৪), ফুল কই শুধু অস্ত্রের উলস্নাস (১৯৮৪), লাজুক লিরিক (১৯৮৪), আমি ছিন্নভিন্ন (১৯৮৬), মানুষে বড়ো ক্রন্দন জানে না (১৯৮৯), নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৯), প্রথম পয়ার (১৯৯০), কোথা সে প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ (১৯৯০), প্রেমের কবিতা (১৯৯১), মহাদেব সাহার রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১), অস্তমিত কালের গৌরব প্রভৃতি গ্রন্থ। শ্রাবণে অবগাহিত মহাদেব 'শ্রাবণ' বন্দনায় মুখর। তার কবিতা অশ্রম্নসজল বিধুর। গ্রামে তার জন্ম। সে কারণেই বোধ হয় বুকের ভেতর এক অনন্ত শ্রাবণকে তিনি ধারণ করেছেন। মহাদেব তার আবেগ, অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রকৃত কবির দুঃখ কষ্টে লীন হয়ে আছেন। প্রকৃতি, নদী, মানুষ, বর্ষা তার কবিতায় বারবার ফিরে আসে। স্মৃতি, গ্রাম, মন কেমন করা প্রহর নিয়ে অঝোর শ্রাবণ ধারায় মহাদেব শেকড় সংলগ্ন হয়ে পড়েন। ব্যস্ততার ভিড়ে এই শহরে কিংবা প্রবাসে তার গ্রাম্য স্মৃতি ফুড়ে ওঠে। সঙ্গত কারণে নদীর কাছে পাওয়া, না পাওয়ার গল্প বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নদী কারও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখে উত্তাল হয়ে ওঠে না। নদী সর্বংসহা মায়ের মতো স্নেহ ধারা ও গোপনতার পানচুন রপ্ত করা রমণীর মতো বহমান। নদী স্রোতস্বিনী। তাকে বলতে শোনা যায় : বড়ো ইচ্ছে করে নদী, কিছুক্ষণ তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াই শৈশবে মন খারাপ হলে যেমন তোমার কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম একবার বুক উজাড় করে সব কথা তোমাকে বলি দু'হাতে এই মুখ ঢেকে কত যে কাদি, কেউ তা জানে না। মহাদেব গীতল প্রেমের কবিতার মধ্য দিয়ে অনন্ত তৃষ্ণাকে ধারণ করেছেন। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, চাওয়া পাওয়ার তাড়না তার কবিতাকে সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। বিষাদ-কাতরাতা তার নিত্য সঙ্গী। দুঃখ বিলাস নয়, দুঃখ জয়ের মন্ত্রণা মহাদেব সহজ করায়ত্ব করে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। কত আপন করে তাই তাকে বলতে শুনি : হায় আমার দুঃখ আছে কত রকম/ বুকের ক্ষত/ বুকের গাঢ় জখম/মা যেমন বলেন/হলো না তার ঘটি বাটি সোনার বাসন/ন্যায্য আসন/সবাই আমরা দুঃখ করি/দুঃখ করি হাজার রকম/সবাই এই বুকের নিচে সুনীল জখম/সবাই আমরা দুঃখ করি/ একটা কিছুই দুঃখ করি/ ঘটি বাটি, বসত বাড়ি, ফুলদানি বা সোনার বাসন/ নিজের জন্য হলো না ঠিক যোগ্য আসন / হাত বাড়াবার শক্ত লাঠি/ পরিপাটি সোনার জীবন হলো না ঠিক/ যেমনটি চাই /দুঃখ করি / দুঃখ আছে কত রকম। নারী ও প্রকৃতি, প্রেম আর কাতরতা মহাদেবের কবিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংযোজিত। তিনি একদিকে বাউল অন্যদিকে প্রেমিক ও আগন্তুক। মহাদেব সাহা শীর্ষ কবি। তার কবিতায় যাপিত জীবনের যন্ত্রণা ও আনন্দ প্রকাশিত। প্রায় ৮০ খন্ডের কাব্যগ্রন্থে নিরন্তর প্রণয়-বিরহ, সংগ্রাম ও রক্তাক্ত হওয়ার বিবরণ বিধৃত। এ সত্যগুলো আমাদের বলতে হবে। তিনি শীর্ষ কবি। তার কবিতায় সুঘ্রাণ, তীব্রতা ও দহনের অবিরাম শব্দ প্রতিধ্বনি হয়। পাওয়া কিংবা হারানোর মধ্যে থেকে তিনি 'প্রেম' স্পর্শ করে মানবীর এই পৃথিবীতে প্রদক্ষিণ করেন। মহাদেব সাহার কবিতায় খন্ড খন্ড চিত্র ভেসে ওঠে। নাগরিক জীবনের কোলাহল, ক্রুরতা, অগ্নিতাপের মাঝে তিনি শীতলতা খুঁজে ফেরেন। তার কবিতায় ঐতিহ্যের নিদর্শনের অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। উপমা-উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্প ও নন্দন তত্ত্বের চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, প্রেম-স্মারক ও প্রকৃতি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা আক্রান্ত একদল মানুষ পৃথিবীর সুন্দর তছনছ করে দিচ্ছে। মহাদেব পৃথিবীর রুঢ়তায় কষ্ট পেয়েছেন : মানুষের ঘরে জমেছে অনেক হিংসা, কিন্তু কোনো ভালোবাসা নেই তবে কি ফুরিয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ের যা কিছু সঞ্চয়, অনেক জমেছে তার নোট, টাকাকড়ি, সোনার মোহর কিন্তু কেন নেই একটি বৃক্ষের ছায়া, দুটি কচিপাতা নেই সামান্য শিশির, একটু ঝরনা ধারা এক বিন্দু জল। ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টি উলস্নাস তার অন্বেষার বিষয়। শেকড় লগ্ন কবি প্রকৃতি, মানুষ, জন্ম গ্রামে ফিরে যাওয়ার আর্তি প্রকাশ করেন। তার যাত্রা ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীর যোদ্ধা আর জন্মভূমির সোনালি দিনের দিকে। মহাদেব ভাষা আন্দোলন, গণঅভু্যত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাপরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বিশেষ করে পঁচাত্তুরের মর্মন্তুদ ঘটনা জাতি পিতার হত্যা পরবর্তী ঘটনা আপন যত্নে কবিতার অংশ করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, মহাদেব সাহা আত্মজৈবনিক কবি। তিনি কবি হয়েছেন অনুভূতিপ্রবণ মনন ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার অভিঘাতে। তার জীবনে যেমন অপার আনন্দ আছে তেমন রয়েছে বেদনা ও বিরহের প্রশান্ত ছায়া। সমাজের অবক্ষয়, মানবিক বিপর্যয়, সমাজ ব্যবস্থার অসমতা ও মানুষের অন্তর্গত বোধ তাকে কবি হিসেবে আবির্ভূত হতে সাহায্য করেছে। তার কবিতা সমকালীনতা, রাজনীতি, প্রেম বিরহ বেদনায় আকীর্ণ নারী-নিসর্গ সমানভাবে উপস্থিত থাকে তার কবিতায়। নস্টালজিয়া ও জন্ম গ্রামের টান মহাদেব উপেক্ষা করতে পারেন না। সাম্য ও সৌম্যের দিকে তার পক্ষপাত। পৃথিবীর তাবৎ মানুষের চেতনায় ফলগুধারায় অবগাহিত হয়ে। তার অভিজ্ঞ বাণী মালা মহাকালের গর্ভে গভীর চিহ্ন রেখে যেতে বাধ্য, নির্দ্বিধায় বলা যায়। কবি মহাদেব সাহার ৭৫তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। জন্ম : ২০ শ্রাবণ, ১৩৫১, ৫ আগস্ট, ১৯৪৪, সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে। পিতা গদাধর সাহা, মা বিরাজ মোহিনী। ঢাকা কলেজ, বগুড়া কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ : এই গ্রন্থে এই সন্ন্যাস'। শিশু-কিশোর গ্রন্থ টাপুর টুপুর মেঘের দুপুর, ছবি আঁকা পাখির পাখা'। আকাশে ওড়া মাটির ঘোড়া ও সরষে ফুলের নদী'। তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জেবুন্নেসা মাহবুব উলস্নাহ পুরস্কার, আলাউল সাহিত্য পুরস্কার ও কলকাতা থেকে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার লাভ করেছেন।