বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শামসুর রাহমানের কবিতা অনন্ত নক্ষত্রের উদ্ভাস

বাবুল আনোয়ার
  ১৪ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

শামসুর রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। ত্রিশ উত্তর বাংলা কবিতার উত্তরণে তিনি পঞ্চাশ দশকে কবিতা লেখা শুরু করেন। নিরন্তরভাবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তা করেছেন নিপুণ, নিগূঢ়ভাবে। কবিতায় নিজস্ব মুখাবয়ব সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন। শামসুর রাহমান সমকালীন অনেক কবির সঙ্গে সমান্তরালভাবে কবিতা লেখা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এক্ষেত্রে একক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় সফল হন। সমকালে তার সঙ্গে অনেকেই কবিতার ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। এক্ষেত্রে জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুলস্নাহ, ওমর আলী, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেকের নাম উলেস্নখ করা যেতে পারে। বাংলা কবিতার উত্তরণের ধারাকে পঞ্চাশ দশকের কবিরা নানাভাবে ধারণ ও প্রকাশে সফল হন। বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে এ কাজটি যারা করেছেন শামসুর রাহমান সেখানে একক নন; তবে যে প্রধানতম তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

শামসুর রাহমানের কবিতার দিগন্ত প্রসারিত নানাভাবে, নানা মাত্রায়। জীবনের নানা গ্রন্‌িহ থেকে তা দেশ, কাল, সমাজ ও রাজনীতি মনস্কতায় গভীরভাবে পরিব্যাপ্ত। সমকালীন জীবনবোধকে যেমন তিনি কবিতায় ধারণ করেন তীব্র মননশীলতায় তেমনি বৈশ্বিক চেতনাকেও ধারণ করেছেন দৃষ্টির প্রখরতায়। এ প্রসঙ্গে কবি, প্রাবন্ধিক আব্দুল মান্নান সৈয়দের একটি উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার 'বাংলাদেশের কবিতা' শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, 'শামসুর রাহমানের বিরামহীন ঝংকৃত অকের্স্ট্রায় বহু সুরই বেজেছে, আজও বেজে চলেছে এবং কখনোই তা শিল্পহীন নয়। বাংলাদেশের কবিতাকে লোকপ্রিয়তা দান করেছে শামসুর রাহমানের এই বিরামহীন বহু বিচিত্র

ঝংকৃত উচ্চারণ। (মাসিক কাফেলা, সম্পাদক আব্দুল আজিজ আল নোমান, কলকাতা, প্রথম বর্ষ, বৈশাখ ১৩৮৮) সমকালীন সতীর্থ কবিদের সঙ্গে শামসুর রাহমানকে আলাদা করার এটি একটা বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়। সম্ভবত যা তাকে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান এবং বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

শামসুর রাহমানের প্রথম দিকের কবিতাগুলোতে যে বোধের উদ্ভাস লক্ষ্য করা যায়, তা মাঝপথে ভিন্ন অবয়বে বিকশিত হয়েছে। শেষে 'দিকে বিচিত্রতার পথ ধরে কবিতাকে তিনি নির্মাণ করেছেন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের বিশাল ক্যানভাসে। কবিতার বিবর্তনের ধারায় তিনি আধুনিকতার মোড়কে ঘটিয়েছেন দু্যতিময় উত্তরণ। সময় সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা, নির্মাণ কৌশলের নিজস্ব ভঙ্গি তাকে বাংলা কবিতার অপরিহার্য প্রধান কবির মহিমা দান করেছে। শামসুর রাহমান প্রথম দিকের কবিতায় স্বপ্ন, বাস্তবতাকে রোমান্টিকতার আদলে প্রকাশে প্রলুব্ধ হয়েছেন। সে সঙ্গে প্রকৃতি ও বাস্তবতার নিবিড় পাঠ, মানবিক দ্বন্দ্ব, দীর্ণ, শীর্ণতার আর্তনাদ, জীবনের টানাপোড়েন তার কবিতায় বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ পথ ধরে তিনি মানুষের ঐকান্তিক অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সহজে কবিতায় ধারণ করতে সক্ষম হন। এখানে তার আলাদা কৃতিত্ব বিদ্যমান। সৃজনশীলতার অদম্য বোধ, মেধার ঐশ্বর্যে শামসুর রাহমান তা করতে পেরেছিলেন বলে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পথিকৃৎ। সম্পন্ন বোধ ও ব্যাপ্তির কবি।

প্রথম কাব্য 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ কাব্যসমূহে তার প্রতিফলন সহজে চোখে পড়ে। যেমন : আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে/ কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে/দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি/ ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয় / (দুঃখ, রৌদ্র করোটিতে) স্বপ্নময়তা ও স্মৃতি কাতরতায় কবি হৃদয়ের উন্মুখ অনুভব অনবদ্য হয়ে ওঠে কখনো কখনো। যেমন : যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে/রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, এখন তাদের/গ্রনিহল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু / ন্যাপথলিনের গন্ধ ভেসে আসে!/(কখনো আমার মাকে, বিধ্বস্ত নীলিমা)

শামসুর রাহমান মাতৃভূমি, স্বদেশ, স্বকাল ও সময়কে আশ্চর্য গ্রন্‌িহতে তার কবিতার নিগূঢ়ে বেঁধেছেন। তার হৃদয় জুড়ে স্বদেশ সর্বক্ষণ অনন্ত সুরের বীণায় ধ্বনিত হয়েছে।

তাই যে কোন বিরূপ সময়, বিপন্নতা স্বদেশে আঘাত হেনেছে তখনই দ্বিধাহীন চিত্তে তার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। কবি মানসের এ অনঢ় নীতিগত অবস্থান তার কবিতাকে মানবিকতার সুমহান আদর্শে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে। এ ঐশ্বর্যময়তা তার কবিতার অমিয় শক্তি, চিরকালীন বৈভব। নিজ বাসভূমে, বন্দি শিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যে তার এ প্রবণতা ও সৃষ্টির ধারা বেগবান হয়েছে।

জাতীয় জীবনের যে কোনো সংকটকালীন মুহূর্তে তার মানবিকতা, হৃদয়ের শুদ্ধতা, প্রতিবাদকে তিনি কবিতার শিল্পীত বাহনে প্রকাশ করেছেন। জাতির ইতিহাস, আশা- আকাঙ্ক্ষা প্রাণের স্পন্দন হয়ে ধ্বনিত হয়েছে কবিতায়। এ মাহাত্ম জাতীয় জীবন থেকে আন্তর্জাতিক পরিন্ডলেও সমানভাবে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। দেশ, কালের গন্ডি পেরিয়ে মানুষের ইতিহাস, অনড় অনাদি স্বপ্নকে ধারণ করেন কবিতায়। এর প্রতিফলন হিসেবে আমরা তার কবিতায় লক্ষ্য করি টেলেমেকাস, ইকারুস, চাঁদ সওদাগর, অ্যাকিলিসের মতো বিষয়।

জাতীয় ক্ষেত্রে আসাদের শার্ট 'প্রাণের পতাকা' হয়ে জাতির বিক্ষুব্ধ মননকে ধারণ করে। এ ধারাবাহিকতায়, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনসমূহে অপরিমেয় ত্যাগ, বেঁচে থাকার দুর্নিবার শপথ তার কবিতায় প্রাণময় হয়ে উঠেছে। যেমন : তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতা-মাতার লাশের ওপর। (তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা, বন্দি শিবির থেকে) অথবা : প্রিয় নূর, তোমার বুকের রক্ত নিরন্তর। আমার কবিতা/ভিজে ওঠে বারবার, ধুলো মুছে যায়,/স্বচ্ছ হয় পবিত্র চোখের মতো আর ইবাদতে /(অলৌকিক আলোর ভ্রমর, হরিণের হাড়)।

যুগ চেতনার সঙ্গে শাণিত মননের গভীর যোগ সূত্রতার সমন্বয় শামসুর রাহমানের কবিতার প্রাণ। তার কবিতার বিষয়, কাব্য ভাষা, আহরিত শব্দ, উপমা জীবনের নিবিড় পর্যবেক্ষণের উদ্ভাস। এ উদ্ভাসই তার কবিতা অনন্ত অসীমের সীমানাকে স্পর্শ করে।

কখনো কখনো অবাক নিপুণতায় নাগরিক জীবনের ক্ষুদ্র বিষয়সমূহকে তিনি কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যেমন, চাদর, কাক,পথের কুকুর, মোমবাতি,

ল্যাম্পপোস্ট, এ ধরনের প্রয়াশ তার আগে খুব বেশি পরিদৃষ্ট হয়নি। এখানে তিনি আলাদা কুশীলবের ভূমিকায় বাংলা কবিতায় ঘটিয়েছেন নতুন নতুন শব্দের সংযুক্তি। কবি আল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'শামসুর রাহমান আমাদের নগর স্বভাবী আধুনিক কবি মানসিকতায় লিরিক্যাল মেজাজ প্রবর্তনের প্রথম প্রয়াসী' '(একুশোত্তর আধুনিক কবিতা, একুশের নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৬৩-১৯৭৬) বাংলা একাডেমি, ১৯৯৫)

প্রথম দিকে জীবনানন্দীয় ছায়া তার কবিতায় কখনো কখনো প্রতিফলিত হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি নিজস্ব নির্মাণের পথে সার্বভৌম হয়ে ওঠেন। মানুষের আবেগ, অনুভূতি, চিরন্তন মানবীয় আর্তিকে তিনি অনবদ্য শব্দ, ভাষায় কবিতায় পরিণত করেন। আর তা সহজেই পাঠকের হৃদয়কে তুমুলভাবে নাড়া দেয়। এভাবেই শামসুর রাহমানের কবিতা ব্যাপক পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাই বলেন, 'আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমানের কবিতাই সর্বত্রগামী। (ভূমিকা, আধুনিক কবিতা, বাংলা একাডেমি, ১৯৭১) তার চিরকালীন আবেদন, সৌরভ, শক্তি, সমৃদ্ধিতে বাংলা কবিতার অনাদি ভূমিতে নতুন সজীবতা নিয়ে আসে।

শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৩ সালে পুরান ঢাকায়। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি চিরদিনের মতো লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। ১৯৬০ সালে প্রথম প্রকাশিত কাব্য 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে' থেকে শুরু করে সর্বশেষ কাব্য 'অন্ধকার থেকে আলোয়' (২০০৬) পর্যন্ত সংখ্যা ৬৫। বাংলা কবিতায়, তিনিই সবচেয়ে বেশি কবিতা রচনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত শুদ্ধতার ধারাকে তিনি মেধায় ধারণ করেছেন। তার কবিতায় গভীর প্রসারিত দৃষ্টি, সূক্ষ্ণ জীবাণুভূতি, মানবিকতা, শুদ্ধতম চেতনার বহিঃপ্রকাশ মেধা, মননে শাণিত শিল্পে কালোত্তীর্ণ হয়েছে। আর তা কবিতার বৈশ্বিক পরিমন্ডল থেকে ব্যাপ্ত বিশ্বময়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<108715 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1