এসএম সুলতানের পশু-পাখির প্রতি প্রেম

প্রকাশ | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

শাহরিয়ার সোহেল
পৃথিবীতে কিছু বিচিত্র মানুষ সময়ের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করেন। মহামানব হিসেবে যারা পরে স্বীকৃতি পায়। তাদের কিছু কিছু আচরণ বেশ চমকপ্রদ এবং আশ্চযর্ ধরনের। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় প্রত্যেক মহামানবেরই কিছু বিচিত্র খেয়াল বা শখ ছিল। জন্মভ‚মি যশোরের মাত্র বিশ কিলেমিটার দূরে নড়াইলে জন্মগ্রহণকারী বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানেরও কিছু বিচিত্র শখ ছিল। পশু-পাখির প্রতি তার প্রেম ছিল নিমোর্হ, অনিন্দ্য সুন্দর। হরেক রকম পশু-পাখি তিনি লালন করতেন। এর ভেতরই ছিল তার প্রগাঢ় সুখ। এসএম সুলতানের ভেতর এক আশ্চযর্ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। মানুষ থেকে শুরু করে পশু-পাখি সবাই সম্মোহিত হতো তার প্রতি। স্বাভাবিকভাবে বিড়াল দেখলে ইঁদুর ভয়ে পালায়, আবার কুকুর দেখলে বিড়াল ভয়ে পালায়। কিন্তু মজার ব্যাপার এসএম সুলতানের কাছে কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর এক সঙ্গেই বসবাস করত; কিন্তু একে অন্যকে আহত বা জখম করত না। এখানেই অপার রহস্য ঘনীভ‚ত হয়ে আসে। যে মানুষ নিজের কথা কখনো ভাবেনি, শুধুই ভেবেছে অন্যের উপকারের কথা, সে মানুষটিই অসীম এক জগতের রহস্যময় সত্তা। একবার এক বানর উঁচু গাছে উঠে তাল সামলাতে না পেরে মগডাল থেকে পড়ে যায়। এতে বানরটির এক পা ভেঙে যায়। সুলতান নিজে সেই বানরটি নিজ বাড়িতে এনে পায়ে ব্যান্ডেজ করে চিকিৎসা করতে থাকেন। এক সময় বানরটি সুস্থ হয়ে যায়। তবে সে সুলতানকে ছেড়ে অন্য কোথাও কখনো চলে যায়নি। সুলতানের ছিল প্রচÐ এক অজগর সাপ। ঘোষ ঘোষ করত সারাক্ষণ তার পাশে। কুকুর আর অজগর একই সঙ্গে কাটাত সময়। অজগর কুকুরকে পেঁচিয়ে তার গায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলত আবার কুকুরটি অনেক সময় সাপের গা চেটে দিত। বিচিত্র মায়ার বন্ধনে সব অবলা পশু-পাখিই যেন ধরা পড়েছিল। সবাই কেমন নিমোর্হ এবং ত্যাগী হয়েছিল। ময়না ও টিয়া এক সঙ্গে থাকতেই চায় না। শুধু ঝগড়া-বিবাদ করে। অথচ তার কাছে ময়না, টিয়া, কবুতর, মোরগ, ময়ূর সব এক সঙ্গেই বসবাস করত। কখনো ময়না, টিয়া সুলতানের ক্যানভাসের ওপর মলত্যাগ করে একে অন্যের গা চুলকাতো। পেখম ঝাড়ত। সে সব দৃশ্য খুবই মজার! বাড়িতে ছিল বড় বড় গাভী। তাদেরও সে খুবই ভালোবাসত এবং তার অনেক ছবিতে পরিপুষ্ট গাভীর ছবি পাওয়া যায়। ছোট ছোট খরগোশ তার আঙিনাকে ধবল-শুভ্র করে রাখত। ভলুক, হনুমানও ছিল সুলতানের সঙ্গী। অনেক বেজিও দেখা যেত তার বাড়িতে। সব কিছু মিলিয়ে বহু ধরনের জীব-জন্তু সে পুষত। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলতেন তিনি। কখনো নিজের স্বকীয় সত্তাকে বিলীন করে দেননি। শাড়ি, চুড়ি এসব পরে ঘুরে বেড়াতেন। মাথায় লম্বা চুল। হাতে বঁাশের বঁাশরী। চমৎকার অদ্ভুত চলন-বলন ছিল তার। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত অমায়িক ধরনের মানুষ। সুলতানের ছিল বিচিত্র শখ। অমাবস্যা ও পূণির্মার রাতে তিনি রাধা সেজে নৃত্য করতেন। জানা যায়, গভীর রাতে তার কাছে বহু ধরনের সাপ আসত। পশু-পাখির প্রতি তার প্রেম ছিল অনবদ্য। তিনি পশু-পাখির মনের ভাষা বুঝতে পারতেন। আর সে জন্যই পশু-পাখিরা তাকে ত্যাগ করে চলে যেত না। চমৎকার ঘনিষ্ঠতা ছিল তার সঙ্গে। এসএম সুলতান জীবনে বহু অভিজ্ঞতা অজর্ন করেছেন। ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং একক চিত্র প্রদশর্নী হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। পৃথিবীর বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লী, ব্র্যাক প্রমুখের সঙ্গে যৌথ চিত্র প্রদশর্নী হয়েছে। এসএম সুলতান পৃথিবীখ্যাত হয়েছেন এবং তিনি ছিলেন এশিয়ার প্রথম চিত্রশিল্পী যিনি চিত্রের বোধ পাল্টে দেন সমগ্র পৃথিবীতে। খুব সাধারণ মানুষ, কৃষক, তঁাতি, গৃহিণী তথা সহজ বাস্তবতাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তুলির প্রতিটি অঁাচড়ে। রাজমিস্ত্রীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বিশ্বখ্যাত হয়েছেন। অ্যাবস্ট্রাক্টের বদলে রিয়ালিস্টিক রূপই তিনি বেশি ফুটিয়ে তুলেছেন। তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা ক্যানভাসে তুলির অঁাচড়ে বাস্তব করে তুলেছেন। পশু-পাখির প্রতি যে ভালোবাসা তিনি দেখিয়েছেন তা এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার। এক অভ‚তপূবর্ আশ্চযর্ নিমগ্ন মানুষই শুধু এ রকম করতে পারেন। মানুষ হয়েও এসএম সুলতান পশু-পাখির খুব কাছাকাছি আপন হয়ে থাকতেন, তিনি এক মহান আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী, এক অফুরন্ত সত্য, এক অনিন্দ্য বিস্ময়।