শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পী লিওনার্দোর চিন্তার বক্রতা

শতদল বড়ুয়া
  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

চিন্তার বক্রতা কথাটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রকার কূপমন্ডূকতাসম্পন্ন কূটবুদ্ধি প্রসূত চিন্তা বা মানসিক অবস্থার কথা প্রতীয়মান হলেও কিন্তু গতি ও অন্যান্য অনেক কিছুর মতো স্থানে ও কালে চিন্তা ও বক্রগতি সম্পন্ন বা বক্রগতি লাভ করার ধারণার কথাই মূলত ঘোষণা করা হচ্ছে। চিন্তার বক্রতার কারণেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের যাত্রা পথিক কোপার্নিকাসই প্রথম ভেবে নিয়েছিলেন পৃথিবী গোল, গ্যালেলিও ভেবে বের করেছিলেন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে না ঘুরে পৃথিবীটাই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। চিন্তার বক্রতা কাজে লাগিয়েই কূটনীতিক ও রাজনীতিকরা অনেক অসাধ্য সাধন করেন। গোয়েন্দা ও চররা এই প্রক্রিয়াকে বেশি ব্যবহার করেন। এটাকে কাজে লাগিয়ে তারা আবিষ্কার করে নিতে পারেন অনেক গোপন তথ্য।

যেমন ধরুন- পতেঙ্গা সমুদসৈকতে (চট্টগ্রামে) কোনো ভাড়ার ঘোড়া পাওয়া যায় না। আপনি কখনো সমুদ্রসৈকতে যাননি। আপনার কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে বুদ্ধিমান একজন কথা প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় বলে গেল- সে একবার এখানে (পতেঙ্গায়) ভাড়া ঘোড়ায় চড়ার সময় পড়ে যায়। কারণ ঘোড়ায় উঠার জন্য কোনো ঝুলন্ত লাগামের ব্যবস্থা ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে সে আপনার দিকে তাকিয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ সহকারে সাক্ষীসূচক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল- 'কেমন, তাই না?' এতে করে হঁ্যা বা না সূচক জবাব ও তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেই সেই চালাক বন্ধুটি আপনার অজান্তেই জেনে নিল আপনি সমুদ্রসৈকতে গিয়েছেন কি না।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জীবন দর্শনটা প্রণিধানযোগ্য। এ মহান শিল্পী ছিলেন ফ্রান্সের এক গণিকার সন্তান। তৎকালীন ফ্রান্সের জাতীয় দর্শন, সামগ্রিক জীবনবোধ ও সামাজিক চিন্তাধারা এবং পরিস্থিতির কারণে এ সমস্ত গণিকালয়গুলোর স্থানান্তর ও উচ্ছেদ সাধনের ফলে তার মাকে নিয়ে খুব সংকটেই পড়েছিলেন। এই বিপাকে যেখানে নিজের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা বা স্থায়িত্ব ছিল না যেখানে এই পুত্র সন্তানকে নিয়ে করবে কী এবং তার এ নিরাপরাধ শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার এক পরিচিত অবিবাহিত যুবক খদ্দেরের কাছে রেখে সেই গণিকালয় থেকে প্রস্থান করে। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ওই মামু কে আর বিশেষ জোর দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমরা যা জানি, সেই এতিম বালক এসবের কিছু জানতো না। তার পালক পিতা সেই অবিবাহিত চাকরিজীবী কর্মচারীটা বদলি ও অবিবাহিত অবস্থায় তাকে রাখার সমস্যার কারণে একজন মুচির তত্ত্বাবধানে রেখে অন্যত্র চলে যান। মুচির সঙ্গে কাজ করতে করতে সে বেড়ে উঠতে লাগল নিজের অজান্তেই। অবসর সময়ে আড্ডা জমাতো মফস্বল শহরের অন্যান্য যুবকদের সঙ্গে। এমনিতেই কোনো শহরের বিশেষ বিশেষ স্থানে যুবকদের আড্ডা জমে উঠে। সেই ধরনের যাতায়াত সূত্রে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় রকমারি পেশার ও বেকার যুবকদের সঙ্গে। তাদের কেউ ছিল শিল্পপতির পুত্র, কেউ কেউ সংস্কৃতিমনা শিক্ষিত যুবক, ছাত্র ও বেকার। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের ফলে আর্ট কলেজের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গেও তার বুন্ধত্ব ও ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র গড়ে ওঠে। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনো বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আর্ট কলেজগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে ক্লাব, একাডেমি, সভা-সমিতির হল বা মিলন কেন্দ্রগুলো। আর্ট কলেজের নিয়মিত রুটিনমাফিক কার্যক্রম সমাপ্তির পর প্রায়ই শুরু হতো আড্ডা, সম্মেলন, সভা-সমিতি ইত্যাদি। এভাবে এ সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ও যোগাযোগের ফলে কিছু অঙ্কনমুখী চিন্তাধারার উন্মেষ ও বিকাশ লাভ করতে থাকে কিশোর ভিঞ্চির ভেতর।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এভাবে সে ২৪ বছর বয়সে সেই আর্ট কলেজে পড়ুয়া তার একজন বান্ধবীকে প্রেম নিবেদন করলে মেয়েটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলে পিতৃমাতৃহীন ও ঠিকানাহীন কোনো ছেলেকে একজন অভিজাত কূলবংশের যুবতীর প্রেম প্রণয় বা পাণি গ্রহণ কোনো অবস্থাতে সম্ভব নয়। এই প্রত্যাখ্যানে লিওনার্দো মনে প্রচন্ড আঘাত পান। হয়তো জীবনের প্রতি এভাবেই তার একটা বিকৃত মনোভাবের উদয় হলো। পরবর্তী পর্যায়ে ভিঞ্চির বিবাহ বর্জনসহ ভবঘুরে জীবন ও চিন্তাধারা সবকিছুতেই তার ত্যাগের একটা চরমপন্থী মনোভাব প্রমাণ করে।

\হকেননা, ইচ্ছা করলে এই মহাপুরুষ এত উত্থান ও পতনের মধ্যে দিয়েও বস্তুগত ও পার্থিব বা ন্যূনতম আর্থিক সমৃদ্ধি প্রদর্শন করে যেতে পারতেন। এভাবে একপর্যায়ে পালক পিতার প্রত্যাখ্যান, বন্ধু মহলের বিদ্রম্নপ ও উপেক্ষা, সমাজের মননহীন অবিবেচনা ও প্রতিভা বিকাশের বাধা বা অবমূল্যায়ন, প্রেম প্রত্যাখান- এসব মিলে তার ব্যথা কাণায় কাণায় পূর্ণ হয়ে উঠে এবং সে হয়ে পড়ে গভীর চিন্তাশীল। বারবার ভিঞ্চি তার প্রতিভা বিকাশের চেষ্টা করে। পূর্বেকার ফ্রান্সের সমাজের মানুষের সামগ্রিক মানসিক গঠন বা মননশীলতার স্তর আজকের মতো এমন উঁচুস্তরে ছিল না যে তাকে গ্রহণ করবে, যে কি না একজন পতিতার পুত্র। ওই সময়কালীন একটা অবস্থা নিশ্চয়ই পেরিয়ে এসেছে সমাজ তার গতিশীলতার মধ্য দিয়ে। শিল্প জগতে তার বন্ধুরা তার এই সাহচর্য ও সহযোগিতার সূত্র ধরে তাকে খাটিয়ে নিতেও কার্পণ্য করত না। যা হোক, এটা ভালোই ছিল তার জন্য। এভাবে তিনি সাহিত্য ও শিল্পজগতের সংস্পর্শে এসে একজন ক্ষুদে ব্যবসায়িক শিল্পী হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। এতে জীবিকা নির্বাহ হলেও তার পুরো প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। অল্পবয়সি এই কিশোর সদা ভাবতো ও অভিভূত হয়ে যে, তার লেখা বা চিত্র অতি উচ্চমানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সমাজে তার কোনো সঠিক মূল্যায়ন হতো না বা প্রশংসা পেত না। সে যাই হোক, এভাবে তার শিল্পযাত্রায় বু্যৎপত্তি ও উচ্চমার্গের অভিপ্রায় দেখে অনেকে নীরবে হাসতেন। তার বন্ধু-বান্ধবীদের অধিকাংশ তাকে তার এই প্রয়াস দেখে ঠাট্টা বা ইয়ার্কি করতে সামান্যতম দ্বিধাগ্রস্ত হতো না। এতে করে মানুষ সম্পর্কে তার এক অদ্ভুত ও ভিন্নধর্মী ধারণা জন্ম নেওয়াই স্বাভাবিক।

যা হোক মানব চরিত্র, বিরূপ সমাজ বা জীবন এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত কারণে যে বদ্ধমূল ধারণাই তার মনে জন্ম নিতে থাকুক না কেন সে যে অতি উচ্চমানের মননশীল ব্যক্তি ছিলেন তা আজ স্পষ্ট প্রতীয়মান। হতে পারে এটি সমাজের সামগ্রিক মননশীলতার পশ্চাদপদতা- যার কারণে প্রচন্ড প্রতিভাবান ও ব্যক্তিত্বশীল হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার প্রতিভার যোগ্য স্বীকৃতি পাননি।

ভাবে মনে হয় তার ঊনত্রিশ বছর বয়সের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন যে, তার জন্মসূত্রে কোনো দোষ রয়েছে। অর্থাৎ তিনি একজন বেশ্যার সন্তান বলেই তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতিভার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে একমাত্র অন্তরায়। খুব সম্ভব সেই সময়েই তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, তিনি পিতৃহীন নন, কারণ পিতৃহীন সন্তান জন্ম নিতে পারে না। তিনি মাতৃহীন নন, মাতাহীন সন্তান জন্ম নিতে পারে না। তিনি পরিচয়হীন নন। যেভাবে হোক মাতৃপরিচয় বের করতে হবে। তিনি তার যাবতীয় কর্মকান্ড ও উদ্দেশ্য নিবন্ধন করেন তার মাতৃপরিচয় অন্বেষণে। এ কাজটিই তখন তার জীবনের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

মাতৃপরিচয় জানতে তিনি ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন চষে বেড়ান। জীবিকা নির্বাহের জন্য পেশাজীবী শিল্পীর কাজও তাকে করতে হতো। এভাবে দেশান্তরিত শিল্পী জন্মস্থানের বন্ধু-বান্ধবদের অবজ্ঞা ও তার সহজ সরল স্বাতন্ত্র্যকে যেভাবে উপহাস করা হয়েছে সেই অভিমান ও গস্নানির কথা ভেবেই খুব সম্ভব দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান নেন ও প্রবাস জীবনকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন হয়তো বা।

যা হোক, প্রচন্ড মানসিক চাপ, আত্মগস্নানি- অভিমান, ক্ষোভ, ব্যর্থতা ইত্যাদি মিলিয়ে যখন সে হারিয়ে যাচ্ছিল অবক্ষয়ের অতলান্তে। এ সময় তার চিন্তায় খেলে গেল বিদ্যুতের এক ঝলক। উদয় হলো নতুন একবোধ। উন্মেষ হলো নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি। তখন তার বয়স পঁয়তালিস্নশ বছর। তিনি ভাবলেন যে, মাতৃহীন পরিচয়ের অভাবে তিনি নিগৃহীত হয়েছেন, যে কারণে তার অবমূল্যায়ন হয়েছে। সে একমাত্র মাতৃ পরিচয় উদ্ধারের জন্য মায়ের খোঁজে যদি তিনি গোটা পৃথিবী তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকেন তাহলে মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তিনি ভাবলেন, মাকে খুঁজে পেতে পারেন তার অবয়বের মধ্যে। কারণ তিনি হিসেব করলেন তার নিজের বয়স দিয়ে যে, তার মা যৌবনে যুবতী বয়সে যদি তাকে জন্ম দিয়েও থাকেন তাহলে এত দিন মা বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। ভিঞ্চির এই বক্র চিন্তার কথা কেউ জানেন না। ঘটনাটি দাঁড়ায় এরকম- ভিঞ্চি যা চিন্তা করেন কেউ তা জানেন না। আর ভিঞ্চি সম্পর্কে লোকে যা জানে ভিঞ্চি তা জানেন না। যা হোক, তিনি আবার ফ্রান্সে ফিরে এসে তৈলচিত্র প্রদান যুবতীর প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করেন। পুরনো বন্ধুরা ভিঞ্চির মনে আবার নবযৌবনের উদ্রেক হয়েছে বলে কৌতুক করতেও ছাড়েননি। অনেকে কৌতূহলবশত তার প্রবাসের সম্ভাব্য স্থানগুলোতে খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন- লিওনার্দোর আঁকা ছবিতে প্রতিকৃত মেয়েটি কে? কেউ মন্তব্য করলেন নতুন প্রেমিকা, ভ্রষ্টা ইত্যাদি। অপবাদ ও অপমানের শেষসীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে। আর এ অপবাদের শেষসীমা পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার তীব্র চেতনা ও ক্ষুরধার অনুভূতির পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে (এ ব্যাপারটাকে ক্রিয়ার সমপ্রতিক্রিয়ার বিধিতে মেনে নেওয়া যায়)। এই তীব্র ভাবাবেগকে তিনি তার শিল্পের ক্ষেত্রে প্রকাশ করলেন। শিল্পীদের দৃষ্টি ভিন্ন। আমরা যা যেভাবে দেখি শিল্পীরা তা সেভাবে দেখেন না, তারা দেখেন অন্যভাবে। তিনি তার যুবক বয়সের অবয়ব অনুকরণে মেয়েলি প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করেন। তার নিজের যৌবনের বাহু, ঘাড়, মাথা প্রভৃতি রমণীয় ঢং-এ আঁকতে শুরু করেন। অর্থাৎ তিনি মেয়ে হলে শারীরিক গঠন ও আকৃতি যেমন হতো শিল্পের প্রকরণের মাধ্যমেই তিনি সেভাবে তার শারীরিক কাঠামোর অনুকরণে তার মাতৃরূপটি ফুটিয়ে তোলেন। বাহু পুরুষদের না হয়ে মেয়েলি হলে নিশ্চয়ই শিরাবিহীন মাংশল হতো। গ্রীবা হতো ভরাট, চক্ষুর কোটর হতো কটন, আঙুল হতো মাংসল, চুল হতো লম্বা, মুখমন্ডল হতো গোঁফ বা দাড়ি বর্জিত। তার স্বল্প কুঞ্চিত কেশরাশি হতো ঢেউ খেলানো জলতরঙ্গ। এভাবে এক সুন্দরী তরুণীর ছবি আঁকতে গিয়ে শিল্পীকে নানা মানসিক নির্যাতন, কৌতুক, কৌতূহল, ঔৎসুক্য, বিদ্রম্নপ ইত্যাদি কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে অবিরত। তবুও তিনি ছাড়েননি এই মত এবং পথ। নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে বদ্ধপরিকর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<111593 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1