জন্মদিনের শুভেচ্ছা

দিলারা মেসবাহ জীবনবাদী কথাশিল্পী

প্রকাশ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

বাবুল আনোয়ার
দিলারা মেসবাহ সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের এক বিশিষ্ট নাম। গল্প- উপন্যাসের মধ্যে ব্যাপ্ত তিনি দীর্ঘ চার দশক ধরে। নিরবছিন্নভাবে লিখছেন। জীবন, জগৎ ও সংসারের নানা বিষয়, নানা অনুষঙ্গ তার লেখায় অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে। মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপড়েন, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযুদ্ধের সংগ্রাম, হৃদয়ের কুসুমিত অনুভব, অন্তর্দ্বন্দ্ব, বেঁচে থাকার স্বপ্নময়তা তার লেখা জুড়ে বিবৃত শিল্পীর নিপুণ তুলির আঁচড়ে। তার গল্প, উপন্যাস জুড়ে যে জীবন তা আমাদের যাপিত দিন- রাত্রির অজর কথকতা। তার লেখা প্রান্তজলের জীবনচিত্র। নানাভাবে নানা স্বরে তা প্রতিফলিত হয়েছে। তার গল্প, উপন্যাসের চরিত্রগুলো আমাদের চেনা- জানা আপনজনের। যারা নিরন্তরভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও স্বপ্নময়তায় ব্যস্ত। দিলারা মেসবাহ সাধারণ মানুষের এ আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্তরীণ চিত্র তুলে ধরেন জীবনবাদী শিল্পীর আন্তরিকতায়। মানবিক আর্তনাদের প্রতিফলন তার গল্পগুলোতে হরহামেশাই যেমন : 'সারাবাড়ি উঠানময় রহস্যের কুয়াশা কুন্ডলী পাকায়। পাড়াপড়শির ফিসফিসানি বাড়তেই থাকে। একটা মিহিন শোকগীতি নবিতুনের নিজের হাতে বোনা চালতা ফুলের পাপড়ি চুঁইয়ে ঝরতে থাকে- ঝরতেই থাকে! -(নবিতুনের যাত্রাপালা, মাটি ও মানুষের কুহক) মধ্যবিত্ত জীবনের নানা বিষয়কে তিনি ধারণ করেছেন বাস্তবতার আলোকে। আমাদের চারদিক জুড়ে যে জীবন তা মাঝে মাঝে থমকে যায়, আসে বিপর্যয়। তাতে তো জীবন থেমে থাকে না। নতুন ছন্দে নতুন প্রত্যাশায় শুরু হয় পথ চলা। লেগে থাকে নানা ভাবনা-চিন্তা, আবেগ- অনুরাগ। এসবের প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করি তার রচনায় আন্তরিকতার ছোঁয়ায়। যেন একদম তিনি চরিত্রের গভীরে ঢুকে তুলে আনেন জীবনের কথামালা। যে নেই, তার জন্য আকুল হয়ে ওঠে প্রাণ। নানাভাবে, নানা কারণে তাকে ভোলা যায় না। এমনতর মানবিক বোধের অনুরণনে তার গল্প, উপন্যাসগুলো জীবন্ত। 'এক জোড়া পয়মন্ত ইলিশ' গল্পগ্রন্থে তার প্রতিফলন পৃষ্ঠাজুড়ে নানাভাবে, নানা বৈচিত্র্যে বিধৃত। লেখকের ভাষায় অনবদ্য, যেমন 'দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। আজ যদি সেই মানুষটা বেঁচে থাকত, তা হলে পদ্মা, মেঘনা ছেঁকে ইলশা আনতো টাটকা জোড়ায় জোড়ায়। আদুরের কন্যার সুখের জন্য। বারবার ইলিশের শোক তাকে অস্থির করে তুলছে। -পায়েসে লবণ দেয়ার দুর্নামে নাজু খালার সুন্দর লেখাপড়া জানা মেয়েটার বিয়ে ভেঙে গেছিল। শিউরে ওঠে মাহফুজা। 'এরকম সাধারণ বিষয় নিয়ে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার মতো অজস্র ঘটনা আমাদের সমাজকে আছন্ন করে রেখেছে। লেখক সেই সনাতন মূল্যবোধ ও অসারত্বের শেকড় তুলে ফেলতে চান। সে নিরন্তর শুভ কামনার প্রচেষ্টা, প্রয়াসে তার লেখা আমাদের মোহগ্রস্ত করে রাখে। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষজন বিশেষ করে নারীদের এগিয়ে নেয়ার জন্য তার লেখায় এক ধরনের প্রত্যয় লক্ষণীয়। আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল অর্জনকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ঘনিষ্ঠভাবে। তার লেখায় তা ফুটে ওঠে নিবিড় পরিচর্যায়। 'লাল মলাটের একাত্তর ও অন্যান্য' গ্রন্থে তার 'লেলিহান একাত্তর' লেখাটিতে ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহতা ওঠে আসে এ রকমভাবে 'সারারাত পাখির মতো হত্যা করল জানোয়াররা। হাজার হাজার বাঙালি। আগুনের লেলিহান শিখায় ভস্ম করল কত বসতভিটে জনপদ বস্তির ঝুপড়ি আশ্রয়!' এভাবে দিলারা মেসবাহর কথাসাহিত্য আমাদের যাপিত জীবনের অনবদ্য চিত্র হয়ে ফুটে ওঠে। রেখাপাত করে, ভাবিয়ে তোলে। বোধ ও মননকে জাগিয়ে তোলে। দিলারা মেসবাহর সাহিত্যকর্মের একটা বিশেষ দিক হলো তার শিশু সাহিত্য। এক্ষেত্রে তিনি তার নিবেদন খুবই তাৎপর্যময়। শিশু মননের অন্তর্গত দিককে চমৎকারভাবে তুলে ধরতে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাবলীল ভাষায় তার উপস্থাপনা আমাদের শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে। দিলারা মেসবাহর জন্ম ২৮ আগস্ট, ১৯৫০ সালে পাবনার বিখ্যাত লোহানী পরিবারে। পিতা তাসাদ্দুক হোসেন লোহানী শিক্ষাবিদ ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক। মা বেগম বদরুননেসা লোহানী। বাবার বদলি চাকুরির সুবাদে বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাকে লেখাপড়া করতে হয়। এর মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষ ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ ঘটে তার ছাত্রজীবন থেকে। স্বামীর কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থানগত কারণেও তার অভিজ্ঞতার পরিস্ফুটন ঘটে নানাভাবে। আর অনিবার্যভাবে তা তার লেখার জগৎকে করে প্রসারিত। তাই কখনো ঢাকা বেতারের টকার, স্ক্রিপ্ট রাইটার, সদালাপী ছদ্ম নামে রম্যরচনা, সাপ্তাহিক রোববারে দীর্ঘদিন 'প্রিয়দর্শিনী' নামে কলাম লিখেন তিনি। ১৯৬৫ সালে 'সবুজ পাতা'য় কবিতা প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি শুরু। বর্তমানে ছোটগল্প, নিবন্ধ, শিশুতোষ রচনায় তিনি নিরন্তরভাবে মগ্ন। পাশাপাশি বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৬ সালে 'রত্নগর্ভা মা' তাকে ক্রেস্ট ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। দিলারা মেসবাহর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য মিলে ৩৮টি গ্রন্থ। এর মধ্যে কয়েকটির নাম উলেস্নখ করা হলো : কবিতাগ্রন্থ, কষ্টের কাঠঠোকরা (১৯৮৬), শুকনো পাতা মানিব্যাগে (২০০), উপন্যাস : স্বপ্নলোকের চাবি (২০০০) নাগরদোলার দিন (১৯৯৩)। \হছোট গল্প : পলাতকা ছায়াগুলো (১৯৯০), অন্ধকার ও অপরূপ ডানা (১৯৯৩), ভাতের গল্প (১৯৯৭), বায়োস্কোপ (২০০৫), এক জোড়া পয়মন্ত ইলিশ ( ২০২০)। শিশুসাহিত্য : কিশোর উপন্যাস- আরো ভূতের গল্প (২০০২), এক যে পিঁপড়া (২০০৫), ওপেনটি বায়োস্কোপ( ২০০৫), রিনির ভুবনখানি (২০১৪)। কিশোর গল্প : টাইগার (২০০৫), ভূত ও ভেনট্রিলোকুইজম (২০০৮), আমেরিকার গল্প ( ২০০৮), ইষ্টিকুটুম মিষ্টিকুটুম, সোনালি মাঠের গল্প (২০১৮), অভিমান (২০১৮), কিশোর সমগ্র-১, কিশোর সমগ্র-২, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক : লাল মলাটের একাত্তর (২০২০)। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি উলেস্নখযোগ্য সংকলন সম্পাদনা করেন তিনি। আশরাফ সিদ্দিকী সাহিত্য পদক, লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, জসীমউদ্‌দীন স্বর্ণ পদক, নন্দিনী সাহিত্য পদকসহ ১০টির মতো বেসরকারি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি। দিলারা মেসবাহর সাহিত্য সাধনায় এই যে নিরন্তর পথচলা তার জীবন, সংসার, জগতের নিপুণ আলেখ্য। তার কথাসাহিত্যের নির্মাণ আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে নিজস্ব বৈভবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালিত্ব, আমাদের সংস্কৃতি, চিরায়ত জীবনযাপনের চিত্রকে ধারণ করেছেন তিনি লেখনির নিবিড় ঐশ্বর্যে। দীর্ঘ পথচলায় তার সৃষ্টির মূল্যায়নে সময়ের দাবিকে অনিবার্য করে তুলেছে।