শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

ভাষাসংগ্রামী, কবি ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক

সালাম সালেহ উদদীন
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক। বাংলাদেশের একজন মুক্তমনা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ে গবেষণা তার বিশেষ কৃতিত্ব। টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাকে রবীন্দ্রত্বাচার্য উপাধিতে ভূষিত করে। দেশের যে কজন লেখক সাহিত্যাঙ্গনে ও গবেষণায় আলো ছড়িয়েছেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন চিকিৎসক। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুরে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল হামিদ এবং মাতা রহিমা খাতুন। তিনি ১৯৪৭ সালে নড়াইল মহকুমা হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। পরে তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখায় হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সীগঞ্জ থেকে ১৯৪৯ সালে পাস করেন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ডাক্তার হয়েও তিনি সাহিত্যকর্মে মনোযোগ দেন। তার উলেস্নখযোগ্য বই- রবীন্দ্রভুবনে পতিসর, ভাষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, দেশবিভাগ: ফিরে দেখা, রক্তের নিসর্গে স্বদেশ, বিপস্নব ফেরারী তবু, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভালোবাসা ভালো নেই, নির্বাচিত কবিতা, আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা, প্রসঙ্গ : বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম : কৃষি ও কৃষক। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছোটদের জন্যও তিনি লিখেছেন একাধিক বই। এটা বৃহত্তর সমাজের প্রতি, দেশের শিল্প সংস্কৃতির প্রতি তার দায়বদ্ধতারই পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও তার বইয়ের সংখ্যা কম নয়। এ দেশে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত স্থান শিলাইদহ, শাহাজাদপুর ও পতিসর। প্রথমদিকে পতিসরের কথা এ দেশের রবীন্দ্রপ্রেমীরা ভুলেই গিয়েছিল। পতিসরকে রবীন্দ্রতীর্থ হিসেবে প্রথমে আলোচনায় আনেন তিনি, বরীন্দ্রভুবনে পতিসর বইটি লিখে। এটি একটি অসাধারণ বই। শিলাইদহকে নিয়ে প্রমথনাথবিশী থেকে শুরু করে শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর মতো গবেষক পন্ডিতরা লিখেছেন। পতিসর একেবারে আড়ালেই ছিল, সামনে নিয়ে আসেন আহমদ রফিক। দেশের গ্রামীণ মানুষ তথা কৃষকশ্রেণির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকা এবং তার চিন্তা ও কর্মের অসামান্য দিক বিধৃত হয়েছে পতিসরে। পতিসরই ছিল প্রাণকেন্দ্র। পঞ্চাশের দশকে জমিদারি উঠে যাওয়ার পর পতিসর যেন বেওয়ারিশ হয়ে যায়। অভিভাবকহীন অসহায় ও দুস্থ যেন পতিসর। বিন্দুমাত্র ইতিহাস চেতনার প্রমাণ দেয়নি পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। অথচ পতিসরেই কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার কৃষি উন্নয়ন চিন্তার জন্য প্রজারা তাকে সংবর্ধিত করেছিল এবং একটি মানপত্র দিয়েছিল। ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্দিরা দেবীকে কালিগ্রাম থেকে লেখা এক চিঠির কথাগুলো থেকে পতিসরের মাটি মানুষ ও নিসর্গ সৌন্দর্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের গভীর আবেগ ফুটে উঠেছে। পতিসরের মাটি মানুষের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে, জীবন ও জনপদের সঙ্গে তার আত্মিক পরিচয় ঘটে। কবিচেতনায় নতুন উপলব্ধির জন্ম নেয়। হতশ্রী গ্রামীণ জীবন তাকে নগ্ন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। পতিসরের রূপবৈচিত্র্য তাকে সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় নতুন, বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত উৎসমুখ খুলে দিয়েছিল। তার সৃষ্টিকে করেছিল বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। জমিদার রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ফুটে ওঠে ভিন্নতর এক সাহিত্যসাধক ও সমাজকর্মীর অস্তিত্ব। উলেস্নখ্য, বিভাগপূর্ব বঙ্গদেশের মধ্য ও উত্তর অঞ্চলে ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ছিল নদীয়া, পাবনা ও রাজশাহী জেলার মধ্যে। নদীয়া জেলার বহরামপুর পরগনার সদর কাছারি শিলাইদহ, পাবনা জেলার ইউসুফশাহী পরগনার ডিহি শাহাজাতপুরের সদর শাহাজাতপুর আর রাজশাহী জেলার কালিগ্রাম পরগনার সদর ছিল পতিসর গ্রামে। সুতরাং নানা কারণেই রবীন্দ্রভুবনে পতিসরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।

গল্পও লিখেছেন তিনি। ১৯৯২ সাল থেকে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তিনি নিয়মিত কলাম লিখে আসছেন। প্রবন্ধ রচনা ও রবীন্দ্রগবেষণার পাশাপাশি তিনি কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। অনেকটা নিভৃতচারী এই লেখকের রয়েছে বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। তার কবিতায় উঠে এসেছে ভাষাসংগ্রাম ও ভাষাচেতনা, শ্রেণিসংগ্রাম, শ্রেণিবৈষম্য, পুঁজিবাদ, ব্যক্তিক নিঃসঙ্গতা, অপ্রাপ্তি, শূন্যতা, বিরহকাতরতা ও প্রেম-ভালোবাসা। তবে তার উপস্থাপনের ধরন আলাদা। ৩২ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে তার বিপস্নব ফেরারী, তবু কাব্যগ্রন্থটি। সত্তর দশকের নৈরাজ্য পেরিয়ে, আশির হতাশাগ্রস্ত রাজনীতির প্রতিটি বাঁকের জীবনঘনিষ্ঠ অনুভব উঠে এসেছে তার এই কাব্যগ্রন্থে। তার রাজনৈতিক চেতনার প্রতিভাস ঘটেছে প্রতিটি কবিতায়। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিক অন্তঃসারশূন্যতা উজ্জ্বলভাবে ধরা দিয়ে বিভিন্ন উপমা চিত্রকল্পের মাধ্যমে। উলেস্নখযোগ্য চরণ- বুকের ভেতরে গনগনে তরল তাপের তীক্ষ্ন ডাক জেগে ওঠে/ মেঘের চৈতন্যজুড়ে দুন্দুভি বাজে না/ বিলাসী বর্ষণ আনে আবহ বার্তা, উদ্ভ্রান্ত সমকাল নিজেকে চেনে না/ স্বনামি বন্দরে একা জেগে আছে প্রত্যাশার বেনামি আশ্রয়/ আমাদের চেতনাজুড়ে, পথজুড়ে চলমান সারি সারি ছায়া/ গাছের স্বভাবে কোনো অস্থিরতা নেই, তথাপি পাতায় গান রংফেরা আলোর পিপাসা/ মৃতু্যকে বারবার ভুল পথে হাঁটতে দিও না। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতা, স্মৃতি নয় অসংখ্য মিনার। এখানে তার উচ্চারণ-স্মৃতি নয়, অসংখ্য শিকড়/ অথবা শিকড় নয়. অসংখ্য মিনার/ সত্তার নির্মেঘ ছবি দিগ্বিজয়ী বর্ণমালা/ আমরা উড়াবো আজ ভোরের শিশির, বাতাসে সুঠাম এক চৈতন্যের ঘুড়ি। এই কবিতায় আমাদের বর্ণমালা শহীদ মিনার ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

প্রকৃত অর্থেই তিনি শিল্প-সংস্কৃতির নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি। স্বদেশী-চেতনা ও দেশপ্রেম সবসময় তার ভেতর কাজ করে এবং লেখক সত্তায় সদা ক্রিয়াশীল। দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একনিষ্ঠ নিবেদিতকর্মী তিনি। তিনি তার জীবন ও কর্মের মধ্যদিয়ে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়েছেন যা অনুকরণীয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি নিরহংকার শান্ত স্বভাবের ও মৃদুভাষী। তার বিনয় প্রকাশের ধরন অন্য রকম। তার চলাফেরা ও ব্যক্তিত্বের স্বতন্ত্র ধারা সবাইকে আকৃষ্ট করে। তার গবেষণাকর্মের প্রাচুর্য ও প্রাবন্ধিক-সত্তার বিস্তার দেখে প্রকৃতই বিস্মিত হতে হয়। নিরন্তর কর্মসাধনায় এমনভাবে নিবিষ্ট থাকা খুব সহজ কাজ নয়। ঢাকা সিটি করপোরেশন ইস্কাটনে তার বাসার সামনের সড়কের নামকরণ করেছে 'ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক সড়ক'। ৯২ বছর বয়সেও তিনি নিরন্তর লিখে চলেছেন। এখনো নিয়োজিত রেখেছেন রবীন্দ্রগবেষণায়। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112356 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1