সমীকরণ

প্রকাশ | ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০

সুলতানা ফিরদৌসী
লামিয়ার আজ আঠারো পূর্ণ হলো। আঠারো বছর বয়সটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সিনেমা হলে অ্যাডাল্ট ছবি দেখা যায়। ভেটো দেওয়া যাবে। আমার নানু বলছিলেন, 'আজ থেকে তুই বড় হয়ে গেলি-। এসব শুনতে শুনতে মাথাব্যথা করছে। সামনে আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। আমি জানি আমার পড়া উচিত। ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখছিলাম, আম্মুর ক্যাচক্যাচ শব্দের চোটে আমার ঘুম ছুটে গেল আচমকা! -কিরে আবার শুয়ে পড়লি। -কটা বাজে খবর আছে? -নাশতা খাবো একসঙ্গে। -আমার অফিস আছে, -দেরি হয়ে যাবে! আমি ঘাপটি মেরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম খানিকক্ষণ। তারপর উঠে মায়ের সঙ্গে নাশতা করছি আর রাগে গজগজ করছিলাম। -আম্মু সকালবেলা তোমার কি হয়? -প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমার লেকচার শুনতে ভালো লাগে না। আমার আঠারো বছর পূর্ণ হলো এখন একটু আমাকে আমার মতো থাকতে দাও! -আম্মু চুপ করে তাকিয়ে দেখছে। -বাবা, সন্তান যত বড় হোক না কেন মায়ের কাছে সে ছোট-ই থাকে। তোর সামনে পরীক্ষা আমার চিন্তা-ভাবনা করতে হয়, ভুলে যাসনে, তোর বাবা বেঁচে নেই? -না, তুমি অতিরিক্ত মাতব্বরি করো। -ওগুলো একটু কমাও। -না হলে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। -মার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। -কিছু না বলে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে বন্ধুদের ফোন দিলাম, দেখলাম সবাই পড়া নিয়ে ব্যস্ত। অগত্যা আমি পড়তে বসলাম। আম্মু বলছে সন্ধ্যা ছ'টার মধ্যেই চলে আসবে। \হটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি পড়লাম, একটু খিদে পেয়েছে, ফ্রিজে দেখলাম ভাত-তরকারি, গরম করে খেলাম। এর মধ্যে একটা ফোন এলো, -হ্যালো, অন্যপ্রান্তে একজন পুলিশ অফিসার ইনচার্জ। -আমি বললাম এটা আমার মায়ের ফোন, আপনার কাছে কীভাবে এলো? -উনি তার পুলিশ কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়ে চলে আসতে বলল। -আমার টেনশন বেড়ে গেল! -কি ব্যাপার, আমার মা কোথায়? -আপনি চলে আসেন, তারপর বলছি। আমি তাড়াহুড়ো করে চলে এলাম। আমার মায়ের মোবাইলটা আমাকে দিল, বললাম হঁ্যা- এটা আমার মায়ের ফোন। তারা বললেন, সকাল সাড়ে ১০টায় একটা মোবাইল পাওয়া যায়। -তুমি অনেক ছোট। -তোমার মায়ের লাশ উদ্ধার করতে হলে, বড় কাউকে নিয়ে এসো। আমার তো ওখানেই যেন শরীর টলতে টলতে পড়ে যাবে। আচমকা হানায় জ্ঞান হারাবো, পৃথিবীতে আম্মু ছাড়া আর কেউ নেই। কাঁদতে কাঁদতে প্রায় ঘণ্টাখানেক টানা বসে আছি। -হঠাৎ মনে হলো কেউ আসছে। -সামনে দাঁড়িয়ে আছে আম্মু! আমার মুখের পেশি শিথিল হয়ে গেল, চোখের দৃষ্টি নরম। পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম, প্রশান্তির অনুভূতি। -আমার আচরণে আম্মু অবাক। -বারবার জানতে চাইল, কি হয়েছে তোমার, সকালে খারাপ ব্যবহার করে এখন আবার পরিবর্তন! -আমি পুলিশের ফোনসহ ঘটনাটা খুলে বললাম। -আসলে আমার ফোন সকালে তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার সময় হারিয়ে বা পড়ে যায় পথে। -আমি এখন অন্য একটা মানুষ। -জেদি, একরোখা আর নেই। -আজকের দিনটা আমার আপস করতে শিখিয়েছে, জীবনের সত্যের মুখোমুখি হলাম। আমার আপন বলতে শুধু আমার মা কেঁদে কেঁদে বারবার বললাম, আম্মু। তোমার অবাধ্য আমি কখনো হবো না। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না মা বলেছিলেন, তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। \হলামিলয়ার ঠোঁট কেঁপে উঠল। আয়ত চোখ পূর্ণ হয়ে উঠল অশ্রম্নতে। কয়েক ফোঁটা পড়ল ঝরে মাটিতে। শিশিরের মতো।