গ্রন্থালোচনা

চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট

প্রকাশ | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

দীপংকর দীপক
মরণ নেশা ইয়াবার দংশনে এক তরুণের করুণ পরিণতির কথা শব্দাক্ষরের কাহিনীচিত্রের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল। ‘চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট’ নামের এ উপন্যাসে ইয়াবাসক্ত ওই তরুণের দাম্পত্য জীবনের করুণ চিত্র প্রাধান্য পেয়েছে। উপন্যাসের নায়ক বখতিয়ার। মেধাবী ছেলে। ভালো বেতনে চাকরি করে। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান চন্দ্রমুখীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। আর পঁাচটা দম্পতির মতো সুখের সংসার গড়ে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বখতিয়ার ইয়াবায় আসক্ত হয়। প্রথম দিকে বুঝতে পারেনি চন্দ্রমুখী। কিন্তু ধীরে ধীরে বখতিয়ারের চালচলনে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি নববধূ। বখতিয়ারকে শোধরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কথায় আছে, নেশায় বোধ-বুদ্ধি সব লোপ পায়। বখতিয়ার নেশার বেড়াজাল থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। রাগে-ক্ষোভে চন্দ্রমুখী বাপের বাড়ি চলে আসে। অফিসে অনিয়মের কারণে বখতিয়ারের চাকরিটা চলে যায়। অথর্ সংকটে পড়ে সে। বাধ্য হয়ে হাত পাতে স্ত্রীর কাছে। লজ্জায় মাথা হেড হয়ে যায় চন্দ্রমুখীর। মেয়েটি তাকে যতই এড়াতে চায় বখতিয়ার তার ওপর তত বেশি ভর করে। এতে প্রচÐ মানসিক চাপে ভোগে চন্দ্রমুখী। কিছুই তার ভালো লাগে না। কী করবে তাও বুঝে উঠতে পারে না। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে। একদিন পত্রিকায় দেখে ইয়াবাসহ বখতিয়ারকে আটক করেছে পুলিশ। খবরটি পড়ে নিজের প্রতি চরম ঘৃণা হয় চন্দ্রমুখীর। বখতিয়ারকে বিয়ে করার ভুল সিদ্ধান্ত জীবন দিয়ে শোধরানোর পরিকল্পনা করে মেয়েটি। বাবা-মা যাতে নিপীড়নের শিকার না হয় সেজন্য একটি সুইসাইড নোট লেখে। নোটটি লেখা শেষ করে খাটের ওপর বসে। হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা ২০টি ঘুমের ওষুধ সেবন করে সে। ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিছানায় ঢলে পড়ে। জীবনের সব শ্রান্তি দূর করে চিরনিদ্রায় শায়িত হয় চন্দ্রমুখী। ‘চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট’ উপন্যাসের পরতে পরতে শিক্ষামূলক নানা বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে মাঝারি আকারের এ উপন্যাসে শিক্ষার দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ হচ্ছে ৪৮ নম্বর পৃষ্ঠাটি। এ পৃষ্ঠার তিনটি বাক্য প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূণর্ বাতার্ বহন করে। প্রথমটি, ‘যত জিইয়ে রাখবি, তত ঝামেলা বাড়বে।’ দ্বিতীয়টি, ‘তুই মনে মনে যদি পজিটিভ ভাবিস তোর ব্রেইনও পজিটিভ কাজ করবে।’ তৃতীয়টি, ‘আপ ভালো তো জগৎ ভালো।’ তা ছাড়া এ পৃষ্ঠার আরেকটি বাক্যও পাঠকদের দৃষ্টি আকষর্ণ করবে। সেটি হচ্ছে, ‘সংসার জীবনটা বড় বিচিত্র।’ উপন্যাসের ৩৬ পৃষ্ঠায়ও একটি চমকপ্রদ বাক্য রয়েছে। তা হচ্ছে, ‘কমের্র মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্য পরিবতর্ন করতে পারে।’ কথাটি যেমন খঁাটি, তেমনি অনুপ্রেরণাদায়ক। ৫৭ পৃষ্ঠায় বতর্মান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূণর্ একটি শিক্ষামূলক বাণী রয়েছে। ডিজিটাল যুগে এসে এখন অনেকেই মুঠোফোনে হয়রানির শিকার হন। উপন্যাসের নায়িকা চন্দ্রমুখীও বিভিন্ন কারণে ফোন আতঙ্কে ভোগে। তাই সে একদিন মুঠোফোনটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে, ‘যে জিনিস আতঙ্ক ছড়ায় সেটা সঙ্গে না রাখাই নিরাপদ।’ ‘চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট’ উপন্যাসের প্রতিটি পবের্ সচেতনতামূলক নানা বিষয়ও রয়েছে। এসব বাতার্ একজন পাঠককে তার জীবনযাত্রায় আরও বেশি সচেতন করে তুলবে। এ উপন্যাসের ১১ পৃষ্ঠায় চন্দ্রমুখীর উদ্দেশ্যে মা আরিফা জাহান বলেন, ‘তোর তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করা ঠিক হয়নি। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ ব্যাপারে তুই সবচেয়ে বেশি তাড়াহুড়ো করলি। বিষয়টি নিয়ে আরও বোঝাপড়া দরকার ছিল।’ বাস্তবে চন্দ্রমুখী মেধাবী হলেও আবেগ ও ভালোবাসার কাছে হেরে গেছে। সে বখতিয়ারকে পুরোপুরি চিনতে পারেনি। তাই বিয়ের পর বখতিয়ারের আসল রূপ বেরিয়ে এলে তার ভুল ভাঙে। তরুণ প্রজন্মের অবিবাহিত মেয়েরা উপন্যাসের এ প্যারাটি পড়লে নিজের ভবিষ্যৎ নিধার্রণে কিছুটা হলেও সচেতন হবে। প্রতিটা মায়ের কাছেই সন্তান অধিক মূল্যবান। সন্তান কুপথে চলে গেলে বাবা তাকে এড়িয়ে চললেও মায়েরা কিন্তু তা পারেন না। একে বলে মাতৃধমর্। চুম্বকের ধমর্ লৌহজাতীয় পদাথের্ক আকষর্ণ করা, পানির ধমর্ পাত্র অনুসারে রং ধারণ করা; তেমনি মায়েদের ধমর্ সন্তানকে চিরদিন বুকে আগলে রাখা। এ উপন্যাসে বখতিয়ারের মা রেহানা আক্তার ছেলেকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে মরিয়া। সন্তানের চিন্তায় সবসময় অস্থির তিনি। উপন্যাসের মাঝামাঝিতে এসে বখতিয়ারের কয়েকদিন ধরে খেঁাজ নেই। তাই মা নিদ্রাহীন। ওদিকে বাড়ির সামনে কয়েকটা কাক কা কা স্বরে ডাকছে। সাধারণ মানুষের ধারণা, এটা অমঙ্গলের লক্ষণ। তাই সন্তানের চিন্তায় আরও ভেঙে পড়েন তিনি। এ ব্যাপারে কঠোর মনের স্বামী বোরহান উদ্দিনের কোনো সহায়তা না পেয়ে করুণ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘হে মাবুদ, তুমি আমার ছেলেটাকে রক্ষা কর। ওর কিছু হলে আমি বঁাচব না।’ এদিকে চন্দ্রমুখীর মাও মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদের সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বখতিয়ারের ব্যাপারে চন্দ্রমুখীকে নানাভাবে আশ্বস্ত করেছেন। বখতিয়ারকে মানিয়ে নেয়ার বিষয়ে তিনি চন্দ্রমুখীকে পরামশর্ দিয়ে বলেন, ‘ধৈযর্ ধর! আরও সময় নে। বখতিয়ারের পজিটিভ বিষয়গুলো খুঁজে বের কর। নিশ্চয়ই ওর কিছু পজিটিভ দিক আছে। তা না হলে ওকে কেন ভালোবেসেছিলি! তারপর নেগেটিভ দিকগুলো যদি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যায়, তাহলে দেখবি পজিটিভ ব্যাপারগুলো শক্তিশালী হবে। তখন আর ওকে খারাপ লাগবে না।’ সাহিত্য রচনায় বরাবরই সাবলীল শব্দ ব্যবহার করে মোস্তফা কামাল তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টি আকষর্ণ করেছেন। এ উপন্যাসেও তিনি শব্দ চয়নে খুবই সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে সমকালীন কিছু শব্দ ব্যবহার করে তিনি উপন্যাসকে গতিশীল করে তুলেছেন। এসব শব্দের মধ্যে রয়েছেÑ লাই দিয়া, আউলাইছে, বিল চুকিয়া, তাড়াহুড়ো, কিরাকছম, গিজগিজ, ফ্যাসফ্যাস, খেই খেই, কুলাঙ্গার ছেলে, ঘটঘট, গোগ্রাস প্রভৃতি। শব্দ ব্যবহারের এ সাবলীলতা ও সমকালীনতা তরুণ প্রজন্মকে সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করবে। উপন্যাসের কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ‘চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট’ একটি সামাজিক উপন্যাস। সাধারণত সামাজিক উপন্যাসে সংগ্রামমুখী জীবনচিত্র, পারিবারিক টানাপড়েন, সচেতনমূলক নানা বাতার্ ও কমর্সম্বন্ধীয় বিষয়বস্তুর অবতারণা থাকে। এ উপন্যাসেও তা যথাযথভাবে রয়েছে। তা ছাড়া সাথর্ক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে নামকরণও একটি গুরুত্বপূণর্ বিষয়। উপন্যাসের নাম বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূণর্ হতে হবে। সেদিক থেকেও এ উপন্যাসটি পরিপূণর্। ‘চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট’ শিরোনামটি পড়লেই এর প্রেক্ষাপট সম্পকের্ বোদ্ধা পাঠকরা অনেকটা অবগত হবেন। উপন্যাসের নায়িকা চন্দ্রমুখী। আর সুইসাইড নোট হচ্ছে তার আত্মহত্যার কারণপত্র। সামাজিক-পারিবারিক টানাপড়েন ও প্রেমঘটিত ব্যথর্তার কারণে এ উপন্যাসে চন্দ্রমুখী আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার আগে লিখে যায় ৮ পৃষ্ঠার একটি চিরকুট। এতে উঠে আসে তার অতীত জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসা ও ব্যথর্তা-হতাশার নানা চিত্র। এবারের একুশে গ্রন্থমেলায় ‘চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রæব এষ। বইটির দাম মাত্র ২০০ টাকা। বতর্মানে এটি অনলাইন পরিবেশক রকমারি ডট কমেও পাওয়া যাচ্ছে।