শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল হাসানের কবিতায় রোমান্টিজম ও দ্বন্দ্ব

আবু আফজাল সালেহ
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

কবি আবুল হাসান (জন্ম: ৪ আগস্ট, ১৯৪৭- মৃতু্য: ২৬ নভেম্বর, ১৯৭৫)। স্বল্প সময়ের আধুনিক কবি তিনি। তিনি পেশায় সাংবাদিকও ছিলেন। তার প্রকৃতি নাম আবুল হোসেন মিয়া; সাহিত্যিক নাম আবুল হাসান। সত্তর দশকের গীতল কবি হিসেবেও জনপ্রিয় তিনি। এখন সবকিছুই শিল্প- সেটা সার্থক বা ব্যর্থক যাই হোক না কেন! কবি আবুল হাসানের শিল্পবোধ দারুণ অনুভূতিময়। ষাটের দশকের অন্যতম জনপ্রিয়, মেধাবী কবি, প্রতিভার অধিকারী আবুল হাসান। মাত্র ২৮ বছরের জীবনকাল। এর মধ্যে আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও অগ্রন্থিত বেশকিছু কবিতা। এছাড়াও রয়েছে গল্প ও কাব্যনাটক। মাত্র এক দশকের কাব্যসাধনায় তিনি আধুনিক বাংলার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন। তার প্রকাশিত তিনটি গ্রন্থ হচ্ছে- রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২), যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪), পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)। এছাড়া আবুল হাসান গল্প- সংগ্রহ (১৯৯০),ওরা কয়েকজন (কাব্যনাট্য, ১৯৮৮) উলেস্নখযোগ্য। তিনি ১৯৭৫ সালে মর্যাদাবান বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ একুশে পদক পান। শক্ত শক্ত ও রক্তজবার মতো উচ্চাররণে কবি আবুল হাসান কবিতার বুনন দিয়েছেন। শুধু বুননই দেননি, শিল্পগুণে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কবি আবুল হাসানের কবিতায় শব্দ, বাক্য ও স্বরে ভিন্নতার পাশাপাশি নান্দনিকতায় আছে। নান্দনিকতার আবহে বিদ্রোহী সুরও বাজিয়েছেন তিনি।

কবি আবুল হাসান কবিতায় রোমান্টিজম এনেছেন। প্রেমের পাশাপাশি দ্বন্দ্বও দেখেছেন। আবেগের মধ্যে বাস্তবতা বুঝে নিতে চান তিনি। এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরতেই পারি-

(১) 'তুমি কি আমার আকাশ হবে?/ মেঘ হয়ে যাকে সাজাব/আমার মনের মতো করে।/তুমি কি আমার নদী হবে?/যার নিবিড় আলিঙ্গনে ধন্য হয়ে/তরী বেশে ভেসে যাব কোন অজানা গন্তব্যের পথে।/তুমি কি আমার জোছনা হবে?/যার মায়াজালে বিভোর হয়ে/নিজেকে সঁপে দেব সকল বাস্তবতা ভুলে।/তুমি কি আমার কবর হবে?/ যেখানে শান্তির শীতল বাতাসে/বয়ে যাবে আমার চিরনিদ্রার অফুরন্ত প্রহর।'-(আকাঙ্ক্ষা)

(২) 'চোখ ভরে যে দেখতে চাও/রঞ্জন রশ্মিটা চেনো তো?/বুক ভরে যে শ্বাস নিতে চাও/জানো তো অক্সিজেনের পরিমাণটা কত?/এত যে কাছে আসতে চাও/কতটুকু সংযম আছে তোমার?/এত যে ভালোবাসতে চাও/তার কতটুকু উত্তাপ সইতে পারবে তুমি?'-(প্রশ্ন)

(৩) 'অতো বড় চোখ নিয়ে, অতো বড় খোঁপা নিয়ে/অতো বড় দীর্ঘশ্বাস বুকের নিঃশ্বাস নিয়ে/যতো তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারশ/যতো তুমি খুলে দাও ঘরের পাহারা/যতো আনো ও-আঙুলে অবৈধ ইশারা/যতো না জাগাও তুমি ফুলের সুরভী/আঁচলে আগলা করো কোমলতা, অন্ধকার/মাটি থেকে মৌনতার ময়ূর নাচাও কোন/আমি ফিরব না আর, আমি কোনো দিন/কারো প্রেমিক হব না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ/আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হব।'- (প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী)।

কবি আবুল হাসানের কবিতায় শৈল্পিক ভাষা অনন্য। উপমা-অলংকার ও চিত্রকল্প ব্যবহারে পারঙ্গমতার পাশাপাশি সার্থকতারও পরিচয়ও রেখেছেন। এখানে কবি সার্থক ও অনন্য। তার কবিতা পাঠ করে মনে হয় কবিতাগুলো শুধু নির্মাণ করার চেষ্টা তিনি করেননি বরং কবিতা হয়ে উঠেছে আপনা-আপনিই। আশার পাশাপাশি হতাশার কথাও এসেছে তার কবিতায়। অনেকের মতো নষ্টালজিয়াও ভুগেছেন তিনি। এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরা যেতে পারে-

(১) 'ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভেতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও।'- কী দারুণ ব্যঞ্জনায় ব্যঙময় হয়ে উঠেছে!'-(ঝিনুক নীরবে সহো, পৃথক পালঙ্ক)

(২) 'আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি/জীবনের অস্তিত্বে মরছি...।' (অসভ্য দর্শন, রাজা যায় রাজা আসে)

(৩) 'চিকন কঞ্চির মতো ছিপছিপে রোদের ভেতরে আসি'-(বয়ঃসন্ধি, রাজা যায় রাজা আসে)

(৪) 'এইভাবে ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হয়নি, আমি ভুল করেছিলাম।/...আমি পুষ্পের বদলে হাতে তুলে নিয়েছিলাম পাথর।/আমি ঢুকে পড়েছিলাম একটি আলোর ভেতরে, সারাদিন আর/ফিরিনি।'- (ভ্রমণযাত্রা, যে তুমি হরণ করো)

(৫) 'গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান ছিলাম।/জ্যোৎসস্নায় ফেরা জাগুয়ার চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমার প্রেমিক হৃদয়।/... বাঘিনীর মুখে চুমো খেয়ে আমি বলেছি, আমাকে উদ্ধার দাও।/সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে আমি পান করেছি মৃতু্য'।- (গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর, যে তুমি হরণ করো)

প্রেমের কবিতাতেও এনেছেন নতুনত্ব। অনেক কবিতায় নিয়ে এনেছেন রোমাঞ্চ; প্রেম-বিরহের দারুণ আবহ! কিছু কবিতাংশ তুলে ধরছি-

(১) 'তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে/আর আমার হাতঘড়ি/নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে/শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলো ঝেড়ে ফেলেছি আমার অ্যাস্ট্রেতে...'- (প্রতীক্ষার শোকগাথা, রাজা যায় রাজা আসে)

(২) 'দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদি রাখব না আর আমার ভেতর।/যেখানে বুনব আমি তিন সারি শুভ্র হাসি, ধৃত পঞ্চইন্দ্রিয়ের/সাক্ষাৎ আনন্দময়ী একগুচ্ছ নারী তারা কুয়াশার মতো ফের একপলক তাকাবে...'(কালো কৃষকের গান, যে তুমি হরণ করো)

আশার পাশাপাশি যেমন নিরাশা-হতাশা থাকে, তেমনই বৈষম্যও বিদ্যমান। নারী-পুরুষ ও ধনী-গরিব বৈষম্য সর্বত্রই বিরাজমান। কবি আবুল হোসেনের এমন বৈষম্যের ক্ষেত্রে চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে নানান কবিতায়। যেমন-

(১) 'এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া/ তোমার ওখানে যাব, তোমার ভেতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,/যিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ', শুদ্ধ হব/কালিমা রাখব না।'-(তোমার চিবুক ছোঁব না, যে তুমি হরণ কর)

(২)'অতটুকু চায়নি বালিকা।/অত শোভা, অত স্বাধীনতা।/চেয়েছিল আরও কিছু কম,... একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী।'- (নিঃসঙ্গতা, যে তুমি হরণ করো)

(৩) 'ছেলেটি খোঁড়েনি মাটিতে মধুর জল।/ মেয়েটি কখনো পরে নাই নাকছাবি।/... ছেলেটির চোখে দুর্ভিক্ষের দাহ,/ মেয়েটির মুখে কত মায়া মৌনতা;...'- (যুগলসন্ধি, পৃথক পালঙ্ক, ১৯৭৫)

প্রেমের বা রোমান্টিজমের তীব্রতা পাঠকের মনে নাড়া দেয়; এবং হৃদয়ে প্রোথিত করে। শব্দ বা ভাষা প্রয়োগের প্রাঞ্জলতা কবির মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়। কবি আবুল হাসান শুধু যৌবনের উদ্দামতাই তুলে ধরেননি; জীবন, জীবন বোধ, তার পারিপার্শ্বিকতার জটিলতা, সমকালীন রাজনীতি, স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের হতাশা নিয়েও কবিতা রচনা করেছেন। সময়কে এড়িয়ে যাননি তিনি। আবুল হাসানের কবিতা যতই আলোচনায় আসবে ততই তার কবিশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে