জন্মদিনে শুভেচ্ছা

নাসির আহমেদের কবিতা কাব্যরসের অনন্য জগৎ

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

সুমন সরদার
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা কবিতার বিষয় ও নির্মাণশৈলীরও পরিবর্তন ঘটে। জন্ম নেয় নতুন নতুন অনুষঙ্গ, উপলব্ধি ও ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব। এসব থেকে উপলব্ধির আগুনে পুড়ে কবিরা মননের নিগূঢ় প্রদেশে অবগাহন করতে চান। কবি নাসির আহমেদের এ অবগাহন সহজাত। সহজাত ভঙ্গির গন্ডিতে থেকেই তিনি তার কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন আশা-বেদনা-মৃতু্যর এলিজি। তার কবিতার বাঁকে বাঁকে শিল্প ভাবনার পরিপক্বতা এনে দেয় এক ভিন্নমাত্রা- "চাঁদ নিতে যায় মেঘে কুয়াশায়, জানি তাও জানি। তারপরও কুহু, তারপরও হুহু বাতাসের বাঁশঝাড়ে নীল জ্যোৎস্নায় কুয়াশামুক্ত স্বপ্নে পাতারা ঝরে।" (স্বর্ণলতার ভাষা/ গোপন তোমার সঙ্গে) কিংবা "হরিণ কোথাও নেই। বাড়ির সামনের মাঠে রৌদ্রে ও জ্যোৎস্নায় ঝলমল করে শুধু সবুজ ঘাসের বুকে রক্ত চাপ চাপ; তুমুল লড়াইয়ে মত্ত স্বগোত্রীয় ষাঁড়দের উষ্ণ রক্ত ঝরে।" (একটি বাড়ির পরিপার্শ্ব/ আকুলতা শুভ্রতার জন্য) এমন অসংখ্য জীবনঘনিষ্ঠ শৈরিপক উচ্চারণে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বা দিচ্ছন। যা থেকে নিৎসৃত হয় ঘন কাব্যরস। রবীন্দ্রনাথ তার 'কাব্য' প্রবন্ধে লিখেছেন, ".... একটা প্রস্তর-মূর্তির মধ্যে কেহ বা প্রস্তরটাকে আসল জিনিস মনে করিতে পারে, কেহ বা মূর্তিটাকে। সে স্থলে মীমাংসা করিতে হইলে বলিতে হয়, প্রস্তর তুমি নানা স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে পারো, তাহার জন্য মূর্তি ভাঙিবার আবশ্যক নাই; কিন্ত এ মূর্তি আর কোথাও মিলিবে না। কবিতা হইতে তত্ত্ব বাহির না করিয়া যাহারা সন্তুষ্ট না হয় তাহাদিগকে বলা যাইতে পারে, তত্ত্ব তুমি দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস প্রভৃতি নানা স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে পারো, কিন্তু কাব্যরসই কবিতার বিশেষত্ব।" অনেকেই মনে করেন, কবি নাসির আহমেদের কবিতার মূল সুর প্রেম। কবিতায় প্রেম অনুষঙ্গের প্রতি একটা পক্ষপাত তার কাব্যজীবন পরিব্যপ্ত। যা অস্বীকার করা যায় না। ব্যক্তি নাসির আহমেদ কত বড় প্রেমিক, তা বিবেচ্য নয়। কাব্যক্ষেত্রে উপলব্ধির বাতাবরণে প্রেমকে কতটুকু সংশ্লিষ্ট করতে পেরেছেন, হতে পারে তা বিবেচ্য। তার প্রেমের কবিতার ভেতরে অনুসন্ধানে ধরা পড়ে এক গোপন বার্তা। তিনি প্রেম অনুষঙ্গকে নিয়ে যান আধ্যাত্মিকতার রাজ্যে, একইসঙ্গে অবগাহন করান চিত্রকল্পের জালবিছানো জীবনঘনিষ্ঠ নান্দনিক কাব্যরসে। একটি কবিতাংশের উদাহরণ দেয়া যাক- "তবু যেন গ্রীষ্ম নয়, বর্ষা বা শরৎ নয়, বসন্তও নয় আমার অস্তিত্বে এই চরাচর শুধু সেই শীতার্ত প্রান্তর- ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মতো অপ্রাপ্তির দুঃসহ বরফ আদিগন্ত জমে ওঠে নিত্য যার বুকে আর সেই সহ্যাতীত শীতে একান্ত চাদর ছাড়া বিকল্প পোশাক নেই কোনো।" (শীতার্ত চরাচরে/ আকুলতা শুভ্রতার জন্য) এই কবিতাংশের ওপর প্রথম মনোযোগে ধরা পড়ে এক কল্পিত নারীর অদৃশ্য মুখ। চাদরের প্রতীকে নারীকে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তাই যদি হয়, তিনি চারটি ঋতুর নাম বললেন কেন? গ্রীষ্মে কেন নারীর প্রতীকে হবে চাদর। নারীর জন্য তৃষ্ণায় কাতর কবির বুকে বরফ না জমে তো হাহাকার কিংবা অস্থিরতা অনুভব করার কথা। প্রশ্ন থেকে যায় এখানে। এই কবিতাংশে আরেকটু গভীর মনোযোগী হলে ধরা পড়বে অন্যকিছু। কি শীত, কি গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তে অসার শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে যায় বরফের মতো, সাদা চাদরে বা কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়, এছাড়া বিকল্প নেই। এখানে নারীর উপস্থিতির জলতরঙ্গ বাজিয়ে কবি বোঝালেন অন্যকিছু! কিংবা এভাবে উপস্থাপনে কবি কি পাঠকের সামনে মেলে ধরলেন পুনরুৎপাদনের বীজ? সহজ-সরল ভাষায় খুব গভীর ও আপাতত অদৃষ্টের দিকে ইঙ্গিত করেই কবি নাসির আহমেদ সৃষ্টি করেন কবিতা ও ভেতরের কাব্যরস। কবি নাসির আহমেদ তার কবিতায় বিস্তর কল্পনা ঢেলে দেন। এই কৌশল কবিদের চিরায়ত। কিন্তু কবিমাত্রই কল্পনা করেন না, সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে এমনকি সাধারণ মানুষও কল্পনা করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা প্রকাশ করেন না বা করতে পারেন না। তাই তা প্রকাশের দায় কেবল কবির। কবিদের ক্ষেত্রে এই প্রকাশ ঘটে কবিতার শরীরে। শুধু কল্পনা বা ভাব প্রকাশ করে দু'কলম লিখলেই তো কবিতা হয় না। চাই বাক্‌ভঙ্গি, বিন্যাস সৌকর্য, শব্দচয়ন, ছন্দ, বিষয়বস্তু, চিত্র, চিত্রকল্প, দর্শন, কালচেতনা আরো কত কি! এগুলো থাকলেই কি কবিতা হয়? একটি কবিতায় এর সবগুলো বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলেও কবিতা নাও হয়ে উঠতে পারে। আবার, এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো না থাকলেও কবিতা হতে পারে। বড় কথা, কবিতায় থাকতে হবে কাব্যরস। কিন্তু কী স্বাদের এ কাব্যরস? রবীন্দ্রনাথ তার 'কাব্য' প্রবন্ধে যখন বলেন, "এই কাব্যরস কী তাহা বলা শক্ত। কারণ, তাহা তত্ত্বের ন্যায় প্রমাণযোগ্য নহে, অনুভবযোগ্য। যাহা প্রমাণ করা যায় তাহা প্রতিপন্ন করা সহজ; কিন্তু যাহা অনুভব করা যায় তাহা অনুভূত করাইবার সহজ পথ নাই, কেবল ভাষার সাহায্যে একটা সংবাদ জ্ঞাপন করা যায় মাত্র। কেবল যদি বলা যায় 'সুখ হইল' তবে একটি খবর দেওয়া হয়, সুখ দেওয়া হয় না।" রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলা যায়, নাসির আহমেদের কবিতায় তত্ত্ব নয়, রস বিদ্যমান। এক্ষেত্রে নাসির আহমেদের একটি কবিতাংশের উদাহরণ দেয়া যাক- "তবু আশায় বুক বেঁধেছি : বৃষ্টি হবে বৃষ্টি শ্রাবণ-পদাবলি হবে দুঃখ দিয়েই সৃষ্টি। বাদল জলে ভাসবে কিছু বাউল ঝরাপাতা শব্দে তোমার অশ্রম্নভেজা শ্রাবণ দিনের গাথা এমনি করেই হোক রচিত স্বপ্নকথার শ্লোক। রহস্যময় মেঘবালিকা তবু তোমার চোখ অনেক গভীর কথার গহিন বিস্মিত এক আয়না চোখের মেঘে বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি ছোঁয়া যায় না।" (শ্রাবণের দুঃখপদাবলি-১৩/ শ্রাবণের দুঃখপদাবলি) কবি নাসির আহমেদ সত্তর দশকের কবি। এ বছর ৫ ডিসেম্বর তার ৬৯তম জন্মদিন। কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ পেয়েছেন নানা গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি ও পুরস্কার। এই মহামারিতে তাকে ঘিরে কোনো আড়ম্ভবতা নেই। তবে তিনি দুই হাতে লিখে যাচ্ছেন এখনো। কবির জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা।