বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হৃদয়ের স্পন্দনে মহানায়ক

রেজাউল করিম খোকন
  ০৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

১.

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।

পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে গোটা দেশজুড়ে বিজয় উলস্নাসে ফেটে পড়েছে সব মানুষ; সবাই ঘর বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে মিছিল করছে সবাই। আনন্দে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে গোটা জনপদ।

রাজুর মনটাও বেশ উৎফুলস্ন আজ। বাড়ির বাইরে মিছিলে সেস্নাগান শোনা যাচ্ছে। বাবাকে নিয়ে রাজুও সেই মিছিলে যোগ দেয়। 'জয় বাংলা'। 'জয় বঙ্গবন্ধু'। 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা'। বাংলাদেশ- বাংলাদেশ, আজ স্বাধীন।'

স্স্নোগানে স্স্নোগানে মুখরিত বাংলার আকাশ বাতাস। রাজুও মিছিলের অন্য সবার সঙ্গে গলা মিলায়। মিছিলটা এগিয়ে যায় অনেক দূর। এক সময় মিছিলটা শেষ হয়। যেখানে রাজনৈতিক নেতারা বক্তৃতা করেন।

'আজ আমরা স্বাধীন। পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই পেয়েছে। এ জন্য অনেক রক্ত ঝরেছে। কত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে আমাদের সবাইকে। আমরা সবাই জানি, আজ বিজয় উলস্নাস ঘরে ঘরে। কিন্তু আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। তাকে মুক্ত করে না আনা পর্যন্ত আমাদের এই আনন্দ পূর্ণতা পাবে না। তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে যত তাড়াতাড়ি মুক্তি দেবে ততই মঙ্গল। আমরা অপেক্ষায় রয়েছি, কবে তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসবেন।'

নেতাদের বক্তব্য শোনার পর রাজু বাবাকে প্রশ্ন করে, 'আচ্ছা আব্বা, বঙ্গবন্ধু কবে ফিরে আসবেন বাংলাদেশে? তাকে কি পাকিস্তানিরা ছেড়ে দেবে? যদি তারা আমাদের প্রিয় নেতাকে মুক্তি না দেয় তাহলে কি হবে?

ছেলের মুখে পরপর এতগুলো প্রশ্ন শুনে কিছুটা চমকে ওঠেন ডাক্তার রাকিব।

বাংলাদেশ দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন হয়েছে। বাঙালিরা আজ স্বাধীন জাতির মর্যাদা পেয়েছে। এ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এ দেশের সব মানুষকে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে মানুষটি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, সেই তরুণ বয়স থেকে নানা সংগ্রাম-আন্দোলনে সম্পৃক্ত রেখে গোটা দেশের মানুষকে সংগঠিত করে ধীরে ধীরে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। যার পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। বিজয়ের এই আনন্দময় মুহূর্তে সেই মানুষটি দেশের মাটিতে নেই। তাকে আটকে রেখেছে বর্বর পাক সরকার; সেই মানুষটি বাঙালিদের মহান নেতা; নিজেকে জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ দেশের ঘরে ঘরে এখন সবাই বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে। কবে তিনি মুক্ত স্বাধীন দেশে ফিরে আসবেন। সবাই তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করবে। বুকে জড়িয়ে ধরবে।

'রাজু, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা আর আটকে রাখতে পারবে না। আজ আমরা আর কারো পরাধীন নই। আমাদের মহান নেতাকে আটকে রাখার আর কোনো সুযোগ নেই পাকিস্তানিদের। বিশ্ববাসী দেখছে সবকিছু। একটি স্বাধীন দেশের স্থপতিকে তারা কোন শক্তিতে আটকে রাখবে? তাদের সব শক্তি শেষ হয়ে গেছে। বুঝলে বাবা। তুমি আজকের এই বিজয়ের দিনে মন খারাপ করোনা। বঙ্গবন্ধুর জন্য তোমার মন কাঁদছে বুঝতে পারি। তুমি একটুও ভেবোনা। বঙ্গবন্ধু অবশ্যই ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে এ জন্য।'

বাবার মুখে কথাগুলো শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয় রাজু। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে এক ধরনের দুশ্চিন্তা তবুও তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

২.

আজ ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। বাংলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে আরো এক নতুন উজ্জ্বল অধ্যায়ের সংযোজন ঘটতে যাচ্ছে।

আজকের এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেক আশীর্বাদ এবং বিজয় গাঁথা। অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা।

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এতদিন বিজয়ের আনন্দ অনেকটা পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। কোথায় যেন ঘাটতি ছিল। আজ সেই আনন্দ পূর্ণতা লাভ করতে যাচ্ছে। ৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়েছেন। সেদিন তাকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান বঙ্গবন্ধু। লন্ডন থেকে ভারতের দিলিস্ন হয়ে স্বদেশভূমিতে ফিরছেন বাংলাদেশের জাতির জনক।

\হবঙ্গবন্ধু একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস কাটাতে হয়েছে তাকে পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। এই সময় প্রতি মুহূর্তে মৃতু্যর প্রহর গুনতে হয়েছে মহান এই নেতাকে। পাকিস্তানের কারাগারে গোপনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সব ধরনের আয়োজন সম্পন্ন করেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির জন্য একটি বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য বিজয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে বাঙালি যখন বাস্তবতার মুখোমুখি- তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আসছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ২৯০ দিন পাকিস্তানে কারাগারে মৃতু্যযন্ত্রণা শেষে লন্ডন-দিলিস্ন হয়ে আপন দেশের প্রিয় জন্মভূমির মাটিতে পা রাখতে যাচ্ছেন তিনি।

আজ গোটা দেশ আনন্দে উচ্ছ্বাসে ভাসছে। ঘরে ঘরে অনেক খুশির হিলেস্নাল ছড়িয়ে পড়ছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি সবার হৃদয়ের স্পন্দন, বাংলার নয়নমনি আবার ফিরে আসছেন তার আপন বাসভূমে প্রিয় বাংলাদেশের মানুষের মানুষের মাঝে।

রাজুদের বাড়িতেও অনেক আনন্দ, উচ্ছ্বাস, খুশির বন্যা বইছে।

রাজুর বাবা ডাক্তার রাকিব সাহেব আজ ভালো খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতে বলেছেন। বিকালে মৌলভী সাহেব এসে দোয়া পড়বেন, বলে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নিরাপদে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হওয়ার মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানানোর জন্য মোনাজাত করা হবে। এখন সবাই রেডিওর সামনে দারুণ উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে। বাংলার আকাশে কখন বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি দেখা যাবে, কখন সেই বিমান ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণ করবে এবং কখন তিনি সেই বিমান থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসবেন- তা জানতে রেডিও সামনে উদগ্রীব হয়ে বসে অপেক্ষা করছে সবাই।

রাজুও বসে আছে রেডিওর খুব কাছে। উৎকর্ণ হয়ে শুনছে রেডিওর ধারা বিবরণী।

সকাল থেকেই ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দু'পাশে দাঁড়িয়েছে সাড়িবদ্ধ মানুষ। বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারা বিবরণী দেওয়া হচ্ছে সরাসরি। বিমানবন্দর ও রাস্তার দু'পাশে অপেক্ষমান লাখো জনতা, অন্যরকম উত্তেজনা সবার চোখেমুখে। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। লাখো মানুষের ভিড় রাজপথ জুড়ে। সবার কণ্ঠে উচ্চারিত স্স্নোগান 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'।

অবশেষে সব প্রতীক্ষার পালা শেষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিমান থেকে নামলেন। যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেই মাটিতে পা দিয়ে আবেগে কেঁদে ফেললেন তিনি। বিমানবন্দরে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী সব বাঙালি অশ্রম্নসজল নয়নে বরণ করছেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে।

রেডিওতে ধারা ভাষ্যকার আবেগময় কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে পা রাখার মুহূর্তগুলোর বিবরণ দিয়ে চলেছেন। যা শুনতে শুনতে আবেগে আনন্দে উচ্ছ্বাসে সবার চোখ বেয়ে অশ্রম্ন ঝরছে। এ অশ্রম্ন দুঃখ কিংবা শোকের নয়, পরম আনন্দের।

রাজু প্রিয় মানুষটির বাংলাদেশে নিরাপদে ফিরে আসার ব্যাপারটি নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা এবং শঙ্কার মধ্যে ছিল। বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসার ব্যাপারটি তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আবেগে আনন্দে অনেক খুশির জোয়ারে সেও ভেসে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক কিশোরের মধ্যে একজন রাজু অনেক আনন্দে কাঁদছে। খুব কাছের একজন প্রিয় মানুষকে ফিরে পাবার আনন্দে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না সে। রাজু তাকিয়ে দেখে রেডিওর সামনে বসে থাকা ছোট বড় সবাই তার মতো আবেগে উচ্ছ্বাসে কাঁদছে। অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা হয়ে ঘরের মধ্যে।

তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রমনা রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। এই সামান্য পথ অতিক্রম করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মুক্তিকামী বাঙালির জনস্রোত গিয়ে মিশেছে।

রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, 'বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে 'সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি কবে মানুষ করোনি'। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি, তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে নতুন কবিতা সৃষ্টি করতে।'

দরাজকণ্ঠে তিনি বলে চলেছেন, 'আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃতু্য এসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব, আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাব না। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাওয়ার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাঙলা আমার ভাষা, বাঙলার মাটি আমার স্থান।'

বঙ্গবন্ধুর আবেগময় বক্তৃতা শুনে কেউ নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। সবাই কাঁদছে। রাজুর কাছে আজকের দিনটা জীবনের একটি অনন্য স্মরণীয় দিন মনে হয়। হঠাৎ করেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। অল্পকিছু সময়ের জন্য জাতির পিতার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল তার। হিমালয়সম মহান এই ব্যক্তিটি তার মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করেছিলেন। ভালোভাবে, ঠিকমতো পড়াশোনা করে যোগ্য এবং বড় মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু তার নাম, কোন ক্লাসে পড়ে জানতে চেয়েছেন। এরপর ভালোভাবে লেখাপড়া করতে উপদেশ দিয়েছেন। নিজেকে স্কুলের অন্য সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সৌভাগ্যবান মনে করে রাজু। মনে মনে শপথ নেয়, মহান এই নেতার আদর্শ অনুসরণ করে ভালোভাবে লেখাপড়া করে নিজেকে অনেক বড় করবে। দেশের সেবায় নিজেকে নিবেদন করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে