বাংলা কবিতায় নারী

প্রকাশ | ০৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

জাফরুল আহসান
মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ নিজেকে চিনতে চেয়েছে, জানতে চেয়েছে নিজের মতো করে। নিজস্ব সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়ে অন্যের মাঝে নিজেকে চেনার জানার প্রবণতা প্রতিটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ পাল্টে নিয়েছে নিজেকে, তেমনি কবির হাতে কবিতার গতিপথ বদলেছে। আধুনিক বাংলা কবিতা সময়ের প্রয়োজনেই গতিপথ পাল্টেছে। বাঁক নিয়েছে অনেকটা নদীর মতোই। 'মানুষ স্বভাবতই রূপবিলাসী স্রষ্টা। এজন্য স্বকীয় ভাবনা-কামনাকে রূপাশ্রয়ী করিবার ইচ্ছা তাহার সহজাত বৃত্তি। মানুষ বলিয়াই হয়তো সে রূপমুগ্ধ। সে যাহা চায় তাহাকে সে রূপের মধ্যে দেখিতে চায়। তাহার কামনা ও কল্পনা যতই সীমাহীন বা সূক্ষ্ণ হউক না কেন, উহাকে সে রূপের বন্ধনে আনিতে না পারিলে তাহার মন যেন শান্তি পায় না সুতরাং আত্মপ্রকাশের কামনা, পারিপার্শ্বিকের সহিত সংযোগ-কামনা, কল্পজগতের প্রয়োজনীয়তা এবং রূপপ্রিয়তা এ চারটিই মোটামুটি হিসাবে মানুষের সাহিত্যসৃষ্টির উৎস।' [সাহিত্য সন্দর্শন/ শ্রীশচন্দ্র দাশ/ পৃষ্ঠা-১৭ ] যিনি সৃষ্টি করেন তিনিই স্রষ্টা; অর্থাৎ যিনি সাহিত্য সৃষ্টি করেন তিনিই সাহিত্যিক। সাহিত্যিক আমাদের সমাজেরই একজন, তার বেদনাবিদ্ধ কিংবা আনন্দঘন মনোজগতে যে ভাবের উদ্রেক হয়- সে ভাবকে কল্পনার মোড়কে জড়িয়ে, রূপলাবণ্য মিশিয়ে সাহিত্যিক যখন তার পূর্ণতা দান করেন তখনই তা হয়ে ওঠে সাহিত্য। 'সাহিত্য হচ্ছে আলোর পৃথিবী, সেখানে যা আসে আলোকিত হয়ে আসে; কালো এসে এখানে নীল হয়ে যায়, অসুন্দর হয়ে যায়- সুন্দর শিল্পকলা। বাংলা সাহিত্যকে এমন সুন্দর করে রচনা করেছেন যুগ যুগ ধরে কত কবি, কত গল্পকার।' [লাল নীল দীপাবলি/ হুমায়ুন আজাদ/ পৃষ্ঠা ১১] সময় গড়িয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাহিত্যও এগিয়েছে, অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। বাংলা সাহিত্যের ঊষালগ্ন থেকে সাহিত্যে নারী ও তার শরীরী ভাষা কবির কলমে কীভাবে চিত্রিত হয়েছে সে চিত্রটিই তুলে ধরার চেষ্টা করছি। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে এবং বংশবিস্তারের মূলে ছিল নারী ও পুরুষের মিলন। সৃষ্টির আঁধার নারী; স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের কামনা-বাসনার সঙ্গী নারী পুরুষের কাছে পেয়েছে বিশেষ মর্যাদা। \হমানব সভ্যতার শুরুটা ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা। সন্তান উৎপাদনের পাশাপাশি সংসারধর্ম পরিচালনায় নারীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। পুরুষের সঙ্গে নারীকে শারীরিক শ্রম দিতে হতো; হাটে-মাঠে-ঘাটে। সংসারকেন্দ্রিক বেড়ে ওঠার প্রবণতা ছিল না বলেই অন্তরালে গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি নারী। ফসলের মাঠে পুরুষের সঙ্গে শ্রম দিয়েছে নারী। ক্ষেতের ফসল গোলায় তুলেছে নারী, সেই সঙ্গে বন থেকে কাঠ এনে উনুন জ্বেলেছে নারী। সংসারের প্রাত্যহিক দাবি মিটিয়ে সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে নারী। এমনতরো সমাজব্যবস্থায় নারী হয়ে ওঠে মূল চালিকাশক্তিও। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিস্তৃতি যে দীর্ঘস্থায়ী ছিল এ কথা বলার অবকাশ নেই; তবে পুরুষতান্ত্রিকতার ছায়া-প্রচ্ছায়াটা ছিল দীর্ঘ সময়। \হমূলত কৃষিবিপস্নবের ফলে পাল্টে যায় সমাজব্যবস্থা। বিপুল সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় পুরুষের ওপর। সম্পদের বিস্তার, জমির মালিকানা টিকিয়ে রাখা, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক লড়াই, দাঙ্গা-হাঙ্গামার পাশাপাশি নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখার সংগ্রামে পুরুষের জুড়িমেলা ভার। পুরুষ নেতৃত্বে ও ধারাবাহিকতায় ক্রমেই নারীরা হয়ে ওঠে ঘরমুখী। ঘরমুখো নারীরা সংসারধর্মে অধিক মনোযোগী হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তবে সেখানেও মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারই প্রভাব ছিল দীর্ঘসময়, যার প্রতিফলন বাংলা সাহিত্যেও দেখতে পাই। বাংলা কবিতার বয়স মাত্র হাজার বছরের বেশি। এখানে বলে রাখা ভালো ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় লিখিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে দেড়শ বছর বাংলা ভাষায় কিছুই রচিত হয়নি? উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ নেই বলে এ সময়টা ছিল নিষ্ফলা। নিস্ফলা মাঠে ফসল ফলেনি বলে সাহিত্যভান্ডার ছিল শূন্য। সঙ্গত কারণেই এ সময়টাকে আমরা 'অন্ধকারযুগ' বলে জানি। সাহিত্যেও প্রাচীন যুগ থেকে আজ অবধি কবি ও সাহিত্যিকরা তাদের রচনায় যেভাবে নারীকে চিত্রিত করেছেন তার ধারাবাহিকতায় প্রাচীনযুগে আমরা 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়' বা চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন হিসেবে পাই। যদিও অসমীয়, ওড়িয়া, মিথিলা ভাষার পন্ডিতরা চর্যাপদকে তাদের নিজ নিজ ভাষার আদি রূপ বলে দাবি করেন। হিন্দিভাষীরাও পিছিয়ে থাকেননি। ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী, ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ, ড. সুকুমার সেন, ড, শশিভূষণ দাশগুপ্ত চর্যাপদের ভাষা ও বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে একই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, চর্যাপদ বাংলা ভাষায় রচিত, এবং বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। চর্যার পদকর্তারা বৌদ্ধ সাধক হলেও চর্যাগীতিকাররা ছিলেন জীবনমুখী। সমকালিন জীবনচর্চা, বৃত্তি, পেশা এসব কিছুই তাদের রচনার শ্রীবৃদ্ধি করেছে। চর্যায় নারী চিত্রিত হয়েছে পুরুষের যৌনসঙ্গী হিসেবে। আবার কখনোবা গণিকারূপে নারীকে এঁকেছেন চর্যাকাররা। কৃষ্ণ ছাড়া রাধার রূপ-লাবণ্য-যৌবন সবই বৃথা। মিলনের আস্বাদ লাভের জন্য যৌবনকে অবহেলা করে কী লাভ? কৃষ্ণ কে না পেলে বিষ পান করতেও দ্বিধা নেই রাধার। যৌবনের জ্বালা তথা শরীরী মিলনে রাধা তৈরি হয়ে আছে। \হএখানে উলেস্নখ করা প্রয়োজন, মধ্যযুগে আরাকানেও বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছিল। আরাকানের রাজদরবারে যে কজন কবি স্থান পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে আলাওল, মাগন ঠাকুর ও কাজী দৌলত ছিলেন অন্যতম। কবি আলাওল (১৬০৭- ১৬৮০) ' পদ্মাবতী' কাব্যে পদ্মাবতীর রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে তা এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। উদ্ধৃতাংশ তুলে ধরছি- পদ্মাবতী রূপ কি কহিমু মহারাজ।/ তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুবন মাঝ আপাদলম্বিত কেশ কস্তুত্মরী সৌরভ।/ মহা অন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব তার মধ্যে সীমন্ত খড়গের ধার জিনি।/ বলাহক মধ্যে যেন স্থির সৌদামিনী। স্বর্গ হান্ত আসিতে যাইতে মনোরথ।/ সৃজিল অরণ্য মাঝে মহাসুক্ষ পথ পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনায় হীরামন পাখি রাজা রত্নসেনকে বলছে- ত্রিভুবনে পদ্মাবতীর মতো কেউ নেই। তার মাথার চুল পা পর্যন্ত লম্বা এবং তাতে সবসময় মৃগনাভির সৌরভ ছড়ায়। ঘনকালো চুলের অরণ্যে দৃষ্টি যেখানে পরাজিত, তরবারির তীক্ষ্ণতার চেয়েও অধিকতর তীক্ষ্ণ তার সিঁথি; মনে হয় স্বর্গ থেকে আসা-যাওয়ার জন্য সৌন্দর্যের দেবতা অরণ্যের মাঝে এক তীক্ষ্ণ পথ নির্মাণ করে দিলেন। রমণীর শরীর বিচিত্র তাৎপর্য নিয়ে শিল্পসাহিত্য তথা কবির চিন্তা ও চেতনার বিশাল অংশ দখল করে আছে। সাহিত্যে নারীর শরীর, রূপলাবণ্য, যে বিস্তৃত মনোমুগ্ধকর বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে তার হিসাব-নিকাশ করার সময় কই! বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনযুগ ও মধ্যযুগে নারী ও তার শরীরী বর্ণনার পাশাপাশি আধুনিক যুগের কবিদের চিন্তা ও চেতনায় নারীরা কীভাবে চিত্রিত হয়েছে কিংবা আধুনিক যুগের কবির ক্যানভাসে নারীর শরীরী বাস্তবতা কতটা আবৃত অথবা অনাবৃত; আরও কতটা আধুনিক হয়ে উঠল সে প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথমেই রবীন্দ্ররচনার বিশাল ভান্ডার থেকে দেখে নেবো তার কবিতায় নারীর শরীরী বাস্তবতা কীভাবে ধরা দিয়েছে। প্রেমের পূজারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার সমগ্র সৃষ্টিজুড়ে প্রেম ও নারী। তিনি যেমন প্রেমের কথা বলেছেন, বলেছেন বিরহের কথা, এমনকি বঞ্চনা ও উলস্নাসের কথাও বলেছেন যার অন্তরালে নীরবে-নিভৃতে নারীর মনোজগৎকেই আলোকিত করতে চেয়েছেন। নারী কখনো দেবী, কখনো প্রেয়সী, কখনো মানসী কিংবা জীবনসুন্দরী; একই সঙ্গে নারী বড় বেশি রহস্যময়ী। সেই সঙ্গে নারী লীলাসঙ্গিনী হিসেবে রবীন্দ্রবলয় আলোকিত করে রেখেছে। কাব্যসুন্দর প্রেয়সীর অন্তরালে শরীরী বাস্তবতার চিত্র দেখি কড়ি ও কোমল' পর্বে 'চুম্বন' কবিতায়- \হঅধরের কানে যেন অধরের ভাষা \হদোহার হৃদয় যেন দোহে পান করে। \হব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে \হদোহের সীমায় আসি দুজনের দেখা। \হপ্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে \হঅধরেতে থরো থরে চুম্বনের লেখা। \হ'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থে 'লজ্জা' কবিতায় নায়ক শরীরী মিলনে আগ্রহী তখন নায়িকাকে বলতে শুনি... \হথাক বধূ, দাও ছেড়ে, \হও টুকু নিও না কেড়ে \হএ শরম মোরে দাও রাখিতে- \হনায়িকা কি ছলা-কলার আশ্রয় খুঁজছিল? কেননা পরবর্তী মুহূর্তেই নায়িকাকে বলতে শুনি- \হবসন্তনিশীথে বধূ \হলহো গন্ধ, লহো মধু। ৭ সমর্পিত হয় নারী। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ঢেলে দেওয়ার মানসিকতায় প্রস্তুত। সবটুকু প্রেমাস্পদকে তুলে দিতে আর দ্বিধা নয়। \হ'মানস সুন্দরী কবিতার উদ্ধৃতাংশ দেখা যাক- \হ \হদুটি রিক্ত হস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি \হকণ্ঠে জড়াইয়া দাও মৃণাল পরশে \হরোমাঞ্চ অঙ্কুরি উঠে মর্মান্ত হরষে \হকম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল, \হমুগ্ধ তনু মরি যায়, অন্তর কেবল \হঅঙ্গের সীমান্ত প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে \হএখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে। রিক্ত হস্ত, কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, মুগ্ধতনু, আলিঙ্গন, অঙ্গের সীমান্ত প্রান্ত রবীন্দ্রনাথের দেহ চেতনাকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। আবেগী বর্ণনায় শরীরী বাস্তবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা 'চিত্রা' কাব্যের 'বিজয়িনী' কবিতায় রূপবতী রমণীর স্নান শেষের দৃশ্য দেখে নেবো- \হ \হঅঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল \হলাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল \হবন্দি হয়ে আছে, তারই শিখরে শিখরে \হপুড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র-ললাটে অধরে \হউড়ু- পরে কটিতটে স্তনাগ্রচূড়ায় \হবাহুযুগে, সিক্ত দেহে রেখায় রেখায় \হঝলকে ঝলকে। \হকবির হৃদয় ক্যানভাসে নারীর শরীরের প্রতিটি ভাঁজ চোখ বন্ধ করলেই উপলব্ধি করা যায়। এ যেন রক্তে মাংসে গড়া রমণীর চিরচেনা রূপ \হ'চিত্রাঙ্গদা' কাব্যনাটকে আমরা দেখি অর্জুনের কাছে আত্মনিবেদন প্রসঙ্গে চিত্রাঙ্গদা বলেছেন... \হকহিলাম, লহো, লহো, যাহা কিছু আছে \হসব লহো জীবনবলস্নভ। দুইবাহু \হদিলাম বাড়ায়ে। - চন্দ্র অস্ত গেল বনে, \হঅন্ধকারে কাঁপিল মোদিনী। \হস্বর্গমর্ত্য দেশকাল দুঃখ সুখ জীবনমরণ \হঅচেতন হয়ে গেল অসহ্য পুলকে। \হ৮ \হরবীন্দ্রনাথ নিপুণভাবে মিলনের চরম মুহূর্তের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এক কথায় প্রাণবন্ত। এ যেন চরিত্রের দাবি এবং স্বাভাবিক। এরপর আমরা যদি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যভুবনে চোখ রাখি, সেখানেও দেখবো বিভিন্ন কবিতায় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে নারীর শরীরী বাস্তবতার দৃষ্টান্ত মিলবে। নজরুল বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও মূলত রোমান্টিক ধারার কবি তিনি। ধূমকেতুর মতোই বাংলা সাহিত্যে যার আগমন। কালনাগের বিষের ধারক তিনি। জাহান্নামের আগুনে বসেও পুষ্পের হাসি হাসেন তিনি। যে ভৃগু ভগবানের বুকে পদচিহ্ন রাখতে দ্বিধা করেন না; সেই বিদ্রোহীকে চিনে নিতে আমাদের খানিকটা দ্বিধান্বিত হতে হয়। 'বিদ্রেহী' কবিতায় নজরুল যখন লেখেন- আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড় চিত-চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর- থর- থর- প্রথম পরশ কুমারীর। আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কনকন আমি চির শিশু চির কিশোর আমি যৌবন ভীতু পলস্নীবালার- আঁচল কাঁচলি নিচোর। এই সেই বিদ্রোহী, প্রিয়ার চাহনি দেখে কাতর হয়ে পড়ে, চুরি করে চুমু খেতে গিয়ে শরীরে শিহরণ জাগে। সে পলস্নীবালার ভালোবাসায় ভীতু, তার বক্ষ বন্ধনী কিংবা শাড়ির আঁচল হতেও দ্বিধা নেই কবির। পরিপূর্ণ একজন বিদ্রোহী অন্তরাত্মার কাছে সমর্পিত শরীরী বাস্তবতা 'বিদ্রোহী'কে নিমিষেই বানিয়ে ফেলে কোমল বিদ্রোহী। 'দোলন চাঁপা' কাব্যগ্রন্থে 'পূজারিনী' কবিতার উদ্ধৃতাংশে লক্ষ্য করি- নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো, এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো। \হইহাদের অতি লোভী মন \হএকজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয় \হযাচে বহুজন। \হশরীরী বাস্তবতা পুঁজি করে অভিজ্ঞতার স্ফুরণ ঘটতে দেখি কবিতায়। নারীকে কবি দেবী বলার পাশাপাশি বলতে দ্বিধা করেননি, নারী প্রচন্ড লোভী। বহুগামী নারী; এরা একজনে তৃপ্ত নয় বলেই বহুজনের স্বাদ আস্বাদনের কথা বলা হয়েছে। ভোগ-বিলাসের সামগ্রী হিসেবে নারীকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা দেখি নজরুলের 'ছায়নট' কাব্য গন্থে- তাপস কঠিন উমার গালে চুমার পিয়াস জাগে বধূর বুকে মধুর আশা কোলে কুমার মাগে। ৯ দেবীর আড়ালে একজন নারীর কামনা-বাসনার ইঙ্গিতময়তা লক্ষ্য করার মতো। কামরসের আস্বাদন শেষে কোলে কুমার চায় নারী, কেননা মিলনেই যে পূর্ণতা। এমনি অজস্র কবিতায় নারীর শরীরী বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। আমরা যাকে মানসচক্ষু বলি সেই মানসচক্ষের আড়ালে প্রতিবিম্বিত চিত্রটি কেবলি অনুভব করার। \হপ্রসঙ্গক্রমে 'সন্ধু হিন্দোল' কাব্যগ্রন্থের 'অনামিকা' কাব্যগ্রন্থের উদ্ধৃতাংশ দেখে নেওয়া যাক- \হযেদিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি কাম \হসেই দিন স্রষ্টা সঙ্গে তুমি এলে, আমি আসিলাম \হআমি কাম, তুমি হলে রতি, \হতরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি। সৃষ্টির শুরুতেই নর-নারী একে অপরের পরিপূরক। নর আছে বলেই নারী, নারী আছে বলেই নর। শিল্প-সাহিত্যে বরাবরই নারী যেন রহস্যময়ী। নারীকে ঘিরেই আলো-আঁধারীর এক ধোঁয়াশা জগৎ তৈরি হয়ে আছে সেই শুরু থেকেই। \হতারপরও বরাবরই নারীকে নিয়ে যে প্রশ্নটি বহুবার উত্থিত হয়েছে তা হলো- নারী কি কেবলি ভোগ-বিলাসের সামগ্রী? পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় নারীর বেড়ে ওঠা পরগাছার শিকড় মাটি স্পর্শ করে না বলেই ভিন্ন গাছকে অবলম্বন করে তার বেঁচে থাকা। শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটলেও স্বকীয়তা ও দৃঢ়তায় বরাবরই পরনির্ভরশীল। বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব 'নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন- \হ'মধ্যযুগে দেখিতেছি দেবই হউন আর দেবীই হউন, বাঙ্গালি যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছে তাহাদের মর্ত্যের ধুলায় নামাইয়া পরিবার- বন্ধনের মধ্যে বাঁধিতে এবং ইহজগৎ সংসার- কল্পনার মধ্যে জড়াইতে, হৃদয়াবেগের মধ্যে তাহাদের পাইতে ও ভোগ \হকরিতে, দূরে রাখিয়া শুধু পূজা নিবেদন করিতে নয়।' \হ[বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, আদিপর্ব/ নীহাররঞ্জন রায়/বাঙালির \হহৃদয়াবেগ/প্রাণধর্ম ও ইন্দ্রিয়ালুতা/পৃষ্ঠা ৭১৫ ] \হবাংলা কবিতার বহুমাত্রিকতা বরাবরই আমাদের অভিভূত করে। বাংলা কবিতার অন্যান্য প্রকরণের যে বিশাল রত্নভান্ডার রয়েছে তার অধিকাংশই আমাদের অজানা। মেধা-মননে এবং আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানামাত্রিক তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা আমাদের কাব্যাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করবে। \হবাংলা কবিতার এই যে দীর্ঘ পথচলা তা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বন্ধুর এ পথের বাঁকে বাঁকে ধর্ম-বর্ণ-জাত-গোষ্ঠীর উত্থান-পতন, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যদিয়ে নির্মিত হয়েছে আজকের পটভূমি। যুগে যুগে এ ১০ পটভূমি নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন কবি। কবিদের ভূমিকা অনেকটাই বৈজ্ঞানিকের মতো, উপাসকের মতো। কবি ভাবেন আগামীকালের কথা। স্বভাবতই কবির চিন্তা প্রকৃতি, আলো-আঁধারির খেলা, নৈসর্গিক পটভূমি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যে কতটা উজ্জ্বল হতে পারে তারই দৃষ্টান্ত দেখব 'ঝরা পালক' কাব্যগ্রন্থের 'দক্ষিণা' কবিতায়- এসেছে নাগর- যামিনীর আজ ডাগর রঙিন আঁখি কুয়াশার দিনে কাঁচুলি বাঁধিয়া কুচ রেখেছিল ঢাকি আজিকে কাঞ্চী যেতেছে খুলিয়া, মদ ঘূর্ণনে হায় নিশীথের স্বেদ মীধুধারা আজ ক্ষরিছে দক্ষিণায় রূপসী ধরণি বাসকসজ্জা রূপালী চাঁদের তলে বালুর ফরাশে রাঙা উলস্নাসে ঢেউয়ের আগুন জ্বলে! \হ[দক্ষিণা / জীবনানন্দ দাশ] \হএভাবেই আধুনিক কবিতার শরীরজুড়ে কবির কামনা ও বাসনার প্রলেপ ছড়িয়ে আছে। আধুনিক প্রসাধনে নারীকে সুসজ্জিত করার কুশিলবরা কবিতার প্রচ্ছদে নারীর শরীরকে উপলব্ধি করেছেন বারবার। কবির চিন্তা-চেতনার আধুনিকতার উজ্জ্বল আলোকরশ্মি প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের দেব-দেবী নির্ভর সাহিত্যের সীমানা পেরিয়ে কবিতা উঠে এলো মানুষ ও মাটির কাছাকাছি। হৃদয়গত অনুভূতিকে ভেঙেচুরে কবিতার শরীরজুড়ে নারীর শরীরী বাস্তবতা প্রকট থেকে প্রকটতর হলো। বিভিন্ন রূপে এবং নান্দনিকভাবে নারী তার উপস্থিতির জানান দিল। আমরা আবারও ফিরে যাব জীবনানন্দের কবিতার কাছে। \হজীবনানন্দ দাশ মূলত প্রকৃতিপ্রেমী। কাব্যভাষা, স্বভাব, সুর ও কবিতার বিষয়বস্তু প্রকৃতি কেন্দ্রিক। প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাসজুড়ে অবাধ বিচরণ তার। বাংলার ঋতু-বৈচিত্র্য যেভাবে বদলে দেয় প্রকৃতির জলরঙ কিংবা তৈলরঙ অথবা সাদা কালো, আলো আঁধারির পটভূমি ঠিক তেমনি জীবনানন্দের কবিতায় আমরা শরীরী বাস্তবতা উপলব্ধি করি- যৌবনের সুরাপাত্রে গরল-মদির ঢালোনি অধরে তব ধরা মোহিনীর ঊর্ধ্বফণা মায়া ভুজঙ্গিনি আসেনি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি চুমিয়া চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু বিষবহ্নি ঢালোনিকো বাসনার বধূ \হঅন্তরের প্রাণপাত্রে তব [ঝরাপালক/কিশোরের প্রতি/জীবনানন্দ দাশ] এ প্রসঙ্গে আল মাহমুদের নাম উলেস্নখ না করলেই নয়। আল মাহমুদের কবিতায় প্রধান বিষয় নারী। নারীর প্রেম, শরীরী আকর্ষণ দৈহিক মিলনের ইঙ্গিতময়তা তার কবিতায় ১১ বিশেষ একটা জায়গা দখল করে আছে। অর্থাৎ তার কবিতায় নারীর প্রভাব ব্যাপক ও গভীর। আল মাহমুদের কবিতায় নারী প্রসঙ্গে ড. ফজলুল হক তুহিন লিখেছেন- \হ'বাস্তব জগতের রক্ত মাংসের নারী আল মাহমুদের কবিতায় প্রধান রূপে বিবেচিত, তবে তার নারী ভাবনার ক্রমপরিবর্তন লক্ষণীয়। স্পষ্টত কয়েকটি দিক থেকে তিনি নারীকে দেখেছেন; প্রথমত গার্হস্থ্য প্রেম ও যৌনসঙ্গী, দ্বিতীয়ত প্রকৃতির প্রতীকে।' [আল মাহমুদের কবিতা বিষয় ও শিল্পরূপ \হ[ড. ফজলুল হক তুহিন, পৃষ্ঠা ৯১] \হপ্রসঙ্গক্রমে আল মাহমুদের উদ্ধৃতাংশ তুলে ধরছি- স্পর্শ করো, পান করো, অলৌকিক অমৃতের ভাঁড় কর্পূর মিশ্রিত এই ঘূর্ণিঝড় নিশ্বাসে নামাও উষ্ণ মহাদেশে আজ ভস্ম হোক তোমার কৈশোর অকস্মাৎ বেড়ে ওঠো, অকস্মাৎ পূর্ণাঙ্গ পুরুষে রূপান্তর ঘটাবার উৎসমুখ উন্মুক্ত আমার \হশিথিল বন্ধনীসূত্র, কটিবন্ধ কাঁচুলি কুন্তল। [জুলেখার আহ্বান/আল মাহমুদ] কিংবা- সুনীল চাঁর এসো দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি। ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়, চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়, ঠোঁটের এ লাক্ষ্যরসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ দ্রম্নত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধাঁয় [সোনালি কাবিন/৩নং সনেট/আল মাহমুদ] কামরসে জর্জরিত কবি অষ্টাদশীকে এভাবেই শয্যাসঙ্গী হিসেবে পেতে চান। সময়বিশেষে রমণীর কাদাজলে না হয় উগোল মাছ তার স্বাদটুকু বুঝে নেবে। প্রতীকাশ্রয়ী বাক্যবিন্যাস নিমিশেই পাঠককে পৌঁছে দেয় একটা নির্দিষ্ট স্থানে। মিলনের মাঝে কবি অমৃতস্বাদ খুঁজে। উপরে উলিস্নখিত কবিতাগুলোর উদ্ধৃাতাংশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নারীর শরীরী বাস্তবতার কষাঘাতে কবি পর্যুদস্ত হলেও সরাসরি কিছুই না বললেও বুঝে নেওয়া যায় মিলনের আতিশয্য প্রত্যেকের কবিতার অন্তরালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সত্তর দশকের কবিদের কবিতায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ, হতাশা, প্রাপ্তি ও পাওয়া না পাওয়ার বেদনা কবিতার শরীর নির্মাণে মূল উপাদান হিসেবে উঠে এসেছে। তবে নারীর শরীরী বাস্তবতার চিত্র যেসব কবিতায় দৃশ্যমান তা অনেটাই প্রতীকাশ্রয়ী। আলো আঁধারির মতো। ষাটের দশকের কবিদের মতো এতটা খোলামেলা নয়। বাংলা কবিতায় নারী ও নারীর শরীরী বাস্তবতা প্রসঙ্গে আমরা বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকে সত্তর দশকের কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরেছি। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে কবির কাব্যভাষা ও বিষয়বস্তু কখনো কখনো অশ্লীলতা, যৌনতা ও নগ্নতার দোষে দুষ্ট বলে মনে হয়েছে, তবে তাতে তার সাহিত্যমূল্য ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করার কিছু নেই। যুগে যুগে কবির কলমে বিভিন্নরূপে নারীর শরীরী বাস্তবতা উঠে এসেছে কখনো সরাসরি কখনোবা প্রতীকাশ্রয়ী হয়ে। আবার কখনোবা চিত্রকল্প কিংবা দৃশ্যকল্প কাব্যভাষায় জুগিয়েছে প্রাণপ্রচুর্য। কবিতা আমাদের উজ্জীবিত করে, প্রাণবন্ত করে, করে আবেগাপস্নুত কবি কবিতার বর্ণনায়, তার প্রবহমাণ স্রোতধারায় আর তার বিষয়বস্তুতে আকৃষ্ট করে পাঠকহৃদয়। কবিতা হয়ে ওঠে জীবনের কাছাকাছি।