বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের গৌড়জন

ড. হারুন রশীদ
  ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) বাংলা নাট্যের এক অবিস্মরণীয় নাম। তার জীবন ঘনিষ্ঠ সৃষ্টি সম্ভার জীবিতকালেই তাকে পৌঁছে দেয় অনন্য এক উচ্চতায়। হাজার বছরের বাংলা নাট্যরীতি ও অভিনয়রীতি তার একক প্রচেষ্টায় আজ বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ। বিশ্ব সাহিত্যের অন্য অনেক সৃষ্টি ব্যতিরেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নাট্যকারদের রচনার সারণিতে সেলিম আল দীনের রচনা সম্ভার স্থান করে নিয়েছে। শেক্সপীয়র, গ্যয়থে, ইবসেন, বার্নাড'শ, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য প্রতিভার মিছিলে সেলিম আল দীন এক অভিযাত্রিক। ভিন্ন আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে সাজান তার এক একটি শেকড় সন্ধানী উপাখ্যান। সৃষ্টির ঈর্ষণীয় সাফল্যের শিখরস্পর্শী সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের দর্শক পাঠককে দাঁড় করিয়েছেন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সামনে।

বস্তুত তার নাটকই বাংলা থিয়েটারের বহুযুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। বাংলার মাটিতে, বাংলার জলহাওয়ায় বাংলার প্রাণের ভাষাতেই জন্ম নেয়া তার নাটকগুলো বাংলা নাটকের সব উপাদানকে ছুয়ে যায় আধুনিকের মন নিয়ে। এ কারণেই বাঙালির কাছে সেলিম আল দীন এক অবিস্মৃত নাম। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনী জেলার অন্তর্গত সমুদ্রবর্তী সোনাগাজী উপজেলার সেনের খিলে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রোত্তরকালের বাংলা নাটকের প্রধান পুরুষ সেলিম আল দীন। তার সৃষ্টিশীলতার কিরণচ্ছটা ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রম্নপদী ধারায় শ্রমজীবী মানুষ এবং বাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতিকে এক মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি দানে সার্থক হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি নেওয়ার পর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন অধ্যাপনাকে। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকেই তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃততর হতে থাকে। একদিকে সৃজনশীলতার ভুবন আলোকিত করে রাখেন তার নতুন নতুন ভিন্নমাত্রিক রচনা সম্ভার দিয়ে। অন্যদিকে শিল্পের একাডেমিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির জন্য কাজ করে যান সমান্তরালে। ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উদ্যোগেই খোলা হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এই বিভাগকে তিনি অধিষ্ঠিত করেন মর্যাদার আসনে। অধ্যাপনার পাশাপাশি এ দেশের নাট্যশিল্পকে বিশ্ব নাট্যধারার সঙ্গে সমপঙ্‌ক্তিতে সমাসীন করার লক্ষ্যে ১৯৮১-৮২ সালে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। এর আগেই অবশ্য তার আজীবনের শিল্পসঙ্গী নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।

ছোটবেলা থেকেই তার লেখক জীবন শুরু হলেও ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত 'দৈনিক পাকিস্তান' (অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা) পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে কালো মানুষদের নিয়ে প্রথম বাংলা প্রবন্ধ 'নিগ্রো সাহিত্য' প্রকাশিত হয়। তার প্রথম রেডিও নাটক 'বিপরীত তমসায়' ১৯৬৯ সালে এবং প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় 'লিব্রিয়াম' প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। 'বহুবচন' কর্তৃক প্রযোজিত হয় তার প্রথম মঞ্চনাটক 'সর্পবিষয়ক গল্প' ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে একের পর এক নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকে সৃষ্ট তার নাটক উচ্চারিত হয় বাংলা মঞ্চে, টেলিভিশনে।

শুরু করেছিলেন বিদেশ অনুপ্রাণিত নিরীক্ষাকে ভর করে, কিন্তু খুব শিগগিরই তা বর্জন করে বাংলার মধ্যযুগীয় নাট্যরীতির সম্ভারে গড়ে তুললেন নিজের জগৎ। ভাঙা মানুষ, তারুণ্যের বিলীয়মান উপজাতি, লাঞ্ছিত নারী এবং নিচুতলার মানুষেরই ভিড় লভ্য তার নাটকে-উপাখ্যানে। পাশ্চাত্য শিল্পের সব বিভাজনকে বাঙালির সহস্র বছরের নন্দনতত্ত্বের আলোকে অস্বীকার করে এক নবতর শিল্পরীতি প্রবর্তন করেন তিনি। যার নাম দেন 'দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব'। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী রীতিতে লেখা তার নাটকগুলোতে নিচুতলার মানুষের সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পটে তাদের বহুস্তরিক বাস্তবতাই উঠে আসে।

যে শিল্পীর অভিযাত্রা মানব জীবনাভিসারী তিনি স্বীয় অভিজ্ঞতাকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না করে কখনো শিল্প রচনায় অবতীর্ণ হবেন- এটি অলীক কল্পনা। সেলিম আল দীনের রচনা সম্ভারে সেই জীবনবাদিতার পরিচয় স্পষ্ট। জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মুনতাসির, শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, হাতহদাই, যৈবতী কন্যার মন, চাকা, হরগজ, বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জন, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল ইত্যাদি মঞ্চসফল ও পাঠকনন্দিত নাটক রচনার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তিনি নিজেকে অতিক্রম করে যেতে থাকেন। তিনি অবশ্য তার সৃষ্ট শিল্পের কোনো নাম দিতে চাননি। তার ভাষায়- 'আমি চাই আমার শিল্পকর্মগুলো নাটকের অভিধা ভেঙে অন্যসব শিল্পতীর্থগামী হয়ে উঠুক'। এভাবেই তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী।

আখ্যান বা বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা উপাখ্যানগুলোতে তিনি কাব্য, উপন্যাস, চিত্রকর্ম প্রভৃতি শিল্পধারাকে এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেন। মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশে একমাত্র বাংলা নাট্যকোষেরও তিনি প্রণেতা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ কেন্দ্রিক এথনিক থিয়েটারেরও তিনি উদ্ভাবনকারী। 'বনপাংশুল' উপাখ্যানে তিনি তুলে আনেন 'মান্দাই' নামে ক্ষয়িষ্ণু এক নৃ-গোষ্ঠীকে। পাঠককে অনেকটা হাত ধরে নিয়ে যান তিনি সেই নাটকের চরিত্রগুলোর কাছে- 'গড়াই গাঙের ওপারেই হাঁটুভাঙা হাট। তৎপর পথের দুধারে কত না গ্রামের নাম বৃক্ষচিত্রময়। বহেড়াতৈল, নলুয়া, কালিদাস, ঘোনারচালা, বড়চওনা। মর্মরিত অরণ্যের রক্ত সিন্দুরের সিঁথি পথ বেয়ে নাককিনী দেবীর নাগের পিঠে একেবেঁকে চলে যাওয়া যায় সখীপুর পেরিয়ে গারোবাজার পর্যন্ত

যেতে পার রিকশা ভ্যানে গরুর গাড়িতে। শুধু পায়ে হেঁটে। ক্বচিৎ টেম্পুতে। অতদূর কাঁচাপথে যেতে যদি রাজি হয় চালক। যেভাবেই যাওনা কেন ভোর বেলায় সূর্য রাঙিয়ে নলুয়া পর্যন্ত গেলেই অপরিচিত অরণ্যের শীর্ষে শীর্ষে আগন্তুকের চোখে সন্ধ্যার অন্ধকার জমতে দেখবে। সেখানে বাদুড় ও জোনাকিরা সচল হলেই তবে মিলবে নলুয়ার বন

অনন্তরে আশ্বিনের রাঙা একটি ভোর পথে পথে বৃক্ষপত্রালীর ফাঁকে ফাঁকে তির্যক রৌদ্র তিতির ময়ূরের হাজার পালক বিছিয়ে মিলিয়ে যাবে। হাঁটুভাঙা থেকে নলুয়া। মাইলের গণনায় এভাবে বাদুড়ে-জোনাকিতে গিয়ে মিলে যাবে ঠিক ঠিক

তবে তার আগে গড়াইয়ের এপারে দাঁড়াতে হবে খেয়ার নিমিত্ত। এপার থেকেই দূরে বিশাল অরণ্য বেষ্টনীর আভাস মিলবে। একহারা গজারির আকাশস্পর্শী শাখা। গাঙের ভাঙা তটে হলুদাভ বালির স্তরে সর্পকুন্ডলী শিকড় বাকড়

গাঙ পেরিয়ে হাঁটুভাঙা নাম হাঁটে পৌঁছাবে যখন দেখা যাবে কাঠের গুঁড়ির অজস্ত্র সম্ভার। দড়ি কিম্বা বুনোলতায় বাঁধা আখায় জ্বালাবার খড়ি আঁটি আঁটি। কাঠের কষের গন্ধের পাশাপাশি ক্বচিৎ এক আধজন কালো কিংবা তামাটে বর্ণের মানুষ। চোখেমুখে মানব বিভাজনের নৃতাত্ত্বিক চিহ্নসমেত বসে আছে। তবু সেই চেহারায় দারিদ্র্য ও উপবাসের ধূমশিখা সব গোত্রগত চিহ্ন মুছে ফেলে তাদেরও অন্যসব নিরন্নের সমান করে দেয়। এরা বনপাংশুল মান্দাই।

বিচিত্র বর্ণগত পদবি থাকে এদের নামের অন্তে। কখনো সরকার কখনো বা বর্মণ কিংবা কোচ। আজ ইতিহাসের এই ত্রিসন্ধ্যার পার ঘাটে না কবি না ইতিহাসকার কারো সঙ্গে দেখা হয় না। অথবা দুজনেই মান্দাই অরণ্যের উপর বিছানো নিঃসীম রাত্রিময় আকাশের মুখে এ নিশ্চিহ্নপ্রায় নিত্যউপবাসী অভিবাসনোন্মুখ নৃগোষ্ঠীর দূর অতীতকাল মৃত ইতিহাস কবি ও প্রত্নবিদের বুকের কাছে শীতল দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিনা কে জানে (বনপাংশুল পৃষ্ঠা-১৫)

তার নাটক চাকা'র চলচ্চিত্ররূপ আন্তর্জাতিকভাবে একাধিক পুরস্কার পেয়েছে। তার রচিত কথানাট্য 'হরগজ' সুইডিশ ভাষায় অনূদিত এবং ভারতের নাট্যদল রঙ্গকর্মী কর্র্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বাংলাদেশের ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য। রক্তের আঙুরলতা, অশ্রম্নত গান্ধার, গ্রন্থিকরা কহে, ভাঙনের শব্দ শুনি, অনৃত রাত্রি, ছায়াশিকারী, রঙের মানুষ, নকশীপাড়ের মানুষেরা, প্রত্মনারী, হীরাফুল প্রভৃতি অসংখ্য জনপ্রিয় টিভি নাটকের রচয়িতা সেলিম আল দীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে পান জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার। ২০০৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন তিনি। বর্ণময় কর্ম জীবনে দেশে-বিদেশে বহুবার সংবর্ধিত হয়েছেন তিনি।

২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি পাড়ি জমান অনন্তলোকে। যে জীবন তিনি ধারণ করেছিলেন তা যুগস্রষ্টা শিল্পীর জন্য স্বল্পায়ুর- কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন করেন এবং ছুঁয়েছিলেন তার ব্যাপ্তি সীমাতীত। মর্তের তৃণবলি থেকে আকাশমন্ডলের নক্ষত্ররাজির মধ্যবর্তী সব বস্তু ও প্রাণীর সঙ্গে মানবের সম্পর্ক নিরূপণে তিনি আমৃতু্য অনুসন্ধিৎসু স্রষ্টা। সেলিম আল দীনের রচনার নিত্য পাঠ নবতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করায় তার পাঠকদের। আত্মাবিষ্কারের এক বিশাল সুযোগ রয়েছে সেখানে। গবেষকদের বিবেচনায়, মহান স্বাধীনতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির মহার্ঘতা সেলিম আল দীনের রচনায় নতুন মাত্রা লাভের ফলে আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

'গুরুত্বপূর্ণ অথচ কমপঠিত' লেখক হিসেবে এ নিয়ে একটি দুঃখবোধ ছিল অনন্য নাট্যপ্রতিভা সেলিম আল দীনের। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- 'আমাকে পাঠকরা দুর্বোধ্য লেখক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। আমার লেখা পড়ার জন্য একটা ভিন্ন রুচি থাকা দরকার। বাংলাদেশের অধিকাংশ পাঠকই বালসুলভ কৌতুহল থেকে সাহিত্য পড়ে থাকেন। তাদের আরও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া উচিত।'

জাতীয় সাহিত্যের ভিত তিনি রচনা করে দিয়েছেন- আমাদের দায়িত্ব আচার্য সেলিম আল দীনের শিল্পাদর্শকে সমুন্নত রেখে ঔপনিবেশিকতার অবলেশমুক্ত স্বাধীন দেশের স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতির অধিকারী বাঙালির সাহিত্যকে তার জাতিগত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বসাহিত্য সভায় উপস্থাপন করা। এজন্য তার রচনা থেকে গভীরতর পাঠ গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়। বাংলাসাহিত্যের পাঠকেরা সেই দায়িত্ব পালন করবেন আশা করি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে