একটি অনন্য বিকালের গল্প

প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

ওমর খালেদ রুমি
ও তুই ডুবলে পরে রতন পাবি, ভাসলে পরে পাবি না দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা।। দেহের মাঝে বাড়ি আছে সেই বাড়িতে চোর লেগেছে ছয়জনাতে সিঁধ কেটেছে চুরি করে একজনা।। দেহের মাঝে নদী আছে সেই নদীতে নৌকা চলছে ও তার ছয়জনাতে দাড় টানিছে হাল ধরেছে একজনা।। দেহের ভেতর বাগান আছে সেই বাগানে ফুল ফুটেছে ও তার সৌরভে জগৎ মেতেছে কেবল লালনের মন মাতলোনা।। লালন শাহ রাজশাহীতে এসেছি তা প্রায় বছরখানেক হলো। এখানে আসার পর এখানকার সাংস্কৃতিক জগতে যুক্ত হওয়ার জন্য যে অবকাশটুকু প্রয়োজন ছিল তা করে উঠতে পারিনি। তাই বিচ্ছিন্ন কিছু যোগাযোগ বা খোঁজখবর রাখা হলেও সেভাবে জড়াতে পারিনি নিজেকে। কারণ তেমন কিছু নয়। সামান্য ব্যস্ততা আর কি? ২০২০ সালটা করোনা আক্রান্ত বছর হলেও আমার জন্য একটা অন্যরকম বছরই বলতে হবে। এ বছরেই আমার প্রায় বিশটি বই বাজারে এসেছে যার মধ্যে ১৬টিই প্রকাশ করেছে বিখ্যাত প্রকাশনী রোদেলা প্রকাশনী- যার কর্ণধার হলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং সুহৃদ রিয়াজ খান। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় লেখালেখির ব্যস্ততাতো ছিলই। সব মিলিয়ে নতুন কর্মস্থলে এসে নতুন নতুন ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কখন যে বছরের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি তার হিসেবও মেলাতে পারেনি। রাজশাহীতে বাস করে আর পদ্মার পাড়ে যায় না এমন মানুষ খুব কমই আছে। আমিও কম বেশি যাই। এই কিছুদিন আগেও পদ্মা ছিল জলে ভরা। দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেল। রাজশাহী শহরের তীর ঘেঁষে পদ্মার বুকে আস্তে আস্তে জেগে উঠতে শুরু করল চর। সেই চরের বুকে বিকাল হলেই জমে মানুষের মিলন মেলা। সেখানে পদ্মার তীরে চমৎকার মুক্তমঞ্চ যেখানে রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মূল আয়োজনগুলো অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে মুক্তমঞ্চে তাই জমে ওঠে সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের ভিড়। করোনাকালীন সময়ে সব ধরনের আয়োজনই ছিল সীমিত। বিগত একটা বছর তাই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য মরা সময়ই বলা চলে। এরকম একটা অবস্থার মধ্যেও রাজশাহীর গুণী ব্যক্তিত্ব সাজ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী এবং নন্দন সাহিত্য একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সাইদ ভাই বিজয় দিবসের পড়ন্ত বিকালে একটি চমৎকার আয়োজন করেছিলেন। আয়োজনটিতে গুণীজন কর্তৃক বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি মহান বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। আলোচনা পর্ব শেষ হলে শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক আয়োজন। একে একে দেশের গান পরিবেশন করেন বকুল, রাখি, আনোয়ার প্রমুখ রাজশাহীর স্বণামধন্য শিল্পীরা। কিন্তু আগত দর্শক শ্রোতাদের মনোযোগ আটকে থাকে একটি বিশেষ নামের প্রতি। তিনি আর কেউ নন। ডলার বাউল। রাজশাহীর সংগীত অঙ্গনের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম। ডলার বাউল সম্পর্কে কয়েকটি ছোট তথ্য না দিলেই নয়। এই গুণী শিল্পীর জন্ম রাজশাহীর অভিজাত উপশহর এলাকায়। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্ত করেন। তার পিতার নাম হযরত আলী এবং মাতা মরহুমা রওশন আরা। স্কুল শিক্ষিকা সাংস্কৃতিপ্রেমী মায়ের অনুপ্রেরণায়ই গানের জগতে আসা। তিনি মনে করেন তার মায়ের দোয়াতেই তার এই শিল্পী হয়ে ওঠা। বিশেষ করে তার মায়ের পছন্দের গান ছিল বাউল গান। লালনের গানেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন শিল্পী। তবে ফোক গানেও দারুণ পারদর্শী সে। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখতে চাই ডলার বাউল প্রায় পঁচিশ বছর ধরে বাংলাদেশ রেডিও এবং প্রায় পনেরো বছর ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত গান পরিবেশন করছেন। এছাড়াও প্রায় বেশির ভাগ প্রাইভেট চ্যানেলে তাকে গান পরিবেশন করতে দেখা যায়। রাজধানীসহ দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত স্টেজ পারফর্ম্যান্সে নিয়মিতই দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন তিনি। \হ ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ডলার বাউল দুটি কন্যা সন্তানের পিতা। বড় মেয়ে অরণী নবম শ্রেণির ছাত্রী। আর ছোট মেয়ে নবনী ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। তার সংগীত প্রেমী স্ত্রী আসমাউল হুসনা (ডিনা) একজন গৃহিণী। ছোট বেলা থেকেই তার গানে হাতে খড়ি। প্রথম গুরু ছিলেন ওস্তাদ আব্দুল আজিজ। তারপর গান শেখেন ওস্তাদ রবিউল হাসানের কাছে। সবশেষে তার গানের তালিম নেওয়ার সৌভাগ্য হয় স্বণামধন্য ওস্তাদ জামাল হাসানের কাছে, যিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজল সম্রাট মেহেদী হাসানের একজন প্রত্যক্ষ ছাত্র। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে জামাল হাসানের মতো এত বড় সৌভাগ্যের অধিকারী আর কেউ আছে কি না আমার জানা নেই। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। পদ্মার তীরে তখন ধীরে ধীরে রাত নামছিল। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছিল আয়োজন তত জমে উঠছিল। গুণীজন ও স্বাধীনতার সূর্য সন্তান স্বণামধন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। আয়োজনের চমক হিসেবে সবশেষে ছিল ডলার বাউলের গান। তার দরাজ কণ্ঠে তিনি মাত্র দুটো গান পরিবেশন করে পুরো আয়োজনটিকে মাতিয়ে দিলেন। উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের নিয়ে গেলেন একটা ভিন্ন জগতে। প্রথম গানটি ছিল একটি লালন গীতি- ও তুই ডুবলে পরে রতন পাবি, ভাসলে পরে পাবি না আর পরের গানটি ছিল একটি ফোক গান- দোজাহানের মালিক তুমি তোমার দিল কি দয়া হয় না। মাত্র দুটো গানে দর্শক শ্রোতারা এতটাই বিমোহিত হলেন যে, সেই সুরের মূর্ছনা যে দীর্ঘক্ষণ তাদের কানে বেজেছিল তা কারো বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা গানের একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। আছে একটা দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের একটা বিরাট জায়গা দখল করে আছে লালন গীতি। বাংলার মানুষ বরাবরই ভাবপ্রবণ। আর এই ভাবপ্রবণ মানুষের মুখে মুখে ফেরে লালনের গান। বিশেষ করে এমন কিছু লালন গীতি আছে- যা শিক্ষিত-অশিক্ষিত কিংবা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবারই জানা। এসব গানের মধ্যে, খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়। ধরতে পারলে মন-বেড়ি দিতাম তাহার পায়।। আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা তার উপরে সদর কোঠা আয়না-মহল তায়।। কপালে মোর নইলে কি আর পাখিটির এমন ব্যবহার খাঁচা খুলে পাখি আমার কোন বনে পালায়।। মন তুই রইলি খাঁচার আশে খাঁচা যে তোর তৈরি কাঁচা বাঁশে কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে লালন কেঁদে কয়।। লালন কয় খাঁচা খুলে সে পাখি কোনখানে পালায়।। কিংবা, সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্য জ্ঞানে। পাবিরে অমূল্যনিধি বর্তমানে।। ভজ মানুষের চরণ দুটি নিত্য বস্তু হবে খাঁটি মরিলে সব হবে মাটি তোরা এই ভেদ নাও জেনে।। শুনি মরলে পাব বেহস্তখানা আসলে তো মন মানে না বাকির লোভে নগদ পাওনা কে ছাড়ে এই ভুবনে।। সালাতুল মেরাজুল মুমেনিনা জানতে হয় নামাজের বেনা ওগো বিশ্বাসীদের দেখা শোনা লালন কয় এ ভুবনে।। কিংবা, একবার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চেনা। ও যার আপন খবর আপন আর হয় না।। ও সাঁই নিকট থেকে দূরে দেখায় যেমন কেশের আড়ে পাহাড় লুকায় দেখ না আমি ঘুরে এলাম সারা জগৎ রে তবু মনের গোল তো যায় না।। ও সে অমৃত সাগরের সুধা সে সুধা খাইলে জীবের ক্ষুধা তৃষ্ণা রয় না ফকির লালন মরল জল পিপাসায় রে কাছে থাকতে নদী মেঘনা।। গানগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেমন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে তেমনি সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে মানব মনের যে অনন্ত জিজ্ঞাসা তার জবাব দেওয়ারও কিছুটা হলেও চেষ্টা করেছে। এসব গানগুলোও কালের বিবর্তনে তাই এক কথায় বলতে গেলে আমাদের জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। বাংলা লোক গানের কথা যদি বলি তবে এটুকুই বলতে হবে যে এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে এর বিশাল ভান্ডার নিয়ে কথা বলা এক কথায় অসম্ভব। তবুও শুধু বাস্তব অবস্থাটা বোঝানোর জন্য আবুল হাসান চৌধুরীর লেখা "বাংলাদেশের লোকসংগীত চর্চার বর্তমান অবস্থা" থেকে সামান্য একটু অংশ তুলে ধরতে চাই, "বাঙালির গোলা ভরা ধান আর গলায় গলায় গান- এমন একটা প্রবাদপ্রতিম কথা লোকগীতির আলোচনা প্রসঙ্গে প্রায়শই বলা হয়,? অতিরঞ্জন থাকলেও একথা একেবারে মিথ্যে নয় যে, অতীতে বাংলাদেশে প্রায় হাজার জাতের ধান ফলতো, সেসব ধান এখন আর নেই, ধানের সঙ্গে বাঙালির কত রকম গানও যে হারিয়ে গেছে তার খবর ক'জন রাখে? কোনো কোনো গবেষকের মতে প্রায় দুশো পঞ্চাশ রকম লোকগানের নাম পাওয়া যায়? দুশো তো দূরের কথা, এখন পঞ্চাশটি গানেরও প্রচলন নেই? ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, বাউল-মুর্শিদি, মারফতি, কবিগান, কীর্তন- এরকম প্রধান কয়েকটি লোকসংগীতের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হলেও এর সবকটি ধারা কিন্তু এখন সমানভাবে বহমান নয়। " এর পাশাপাশি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, বর্তমান সময়ে সংস্কৃতির নামে যে অপচর্চা চলছে তার জোয়ারে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লালনগীতি, লোকগীতি, জালালগীতি ইত্যাদি সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী ধারাগুলো একেবারে হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু আশার আলো এইটুকুই যে এখনো এই অঙ্গনে ডলার বাউলের মতো গুণী শিল্পীরা আছেন। কিন্তু উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তারাও আজ সঠিকভাবে তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারছেন না। আমাদের জন্য এখনই শ্রেষ্ঠ সময় যে এদের ধরে রাখা এবং আমাদের সমৃদ্ধ গানের ভান্ডারকে আরও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।