শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

নাট্যকলাবিদ ও অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ

শাহরিয়ার মাহমুদ প্রিন্স
  ২২ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

মমতাজউদদীন আহমদ- নাট্যকলাবিদ, সব্যসাচী নাট্যকার, অনবদ্য অভিনেতা, খ্যাতিমান শিক্ষক, ভাষাসৈনিক, স্বাধীনতা-সংগ্রামী এমন সব বিশেষণের বাইরে তার পরিচয় বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে বেড়ে ওঠা এক অতন্দ্র যোদ্ধা হিসেবে। তিনি ছিলেন আমাদের ভরসার বাতিঘর, দ্রোহ ও মননের শক্তিদাতা। পরিণত বয়সেই ২০১৯ সালের ২ জুন এই হৃষিত বাঙালি চির বিদায় নেন। আজ তার ৮৭তম জন্মদিন।

ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ভাবনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অতল আস্থার প্রতিফলনে সমৃদ্ধ মমতাজউদদীন আহমদের বহুমাত্রিক সৃজনশীল সাহিত্যসম্ভার। বাংলা নাটক নিয়ে তার নানাবিধ গবেষণা, পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন আমাদের নাট্য সাহিত্যকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। এক অঙ্কের নাট্য রচনার ক্ষেত্রে তিনিই প্রধানতম নাট্যকার। সমকালীন জীবনযাপন ও প্রতিবাদী নাটকেও তার সংলাপ ছিল অনন্য।

মমতাজউদদীনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে। বাবা কলিমউদদীন আহমদ এবং মা সখিনা খাতুন। শিক্ষাজীবন শুরু আইহো জুনিয়র স্কুলে। এরপর মালদহ জেলা স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯৫০ সালে দেশভাগের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে এসে ভর্তি হন রামেশ্বরী পাইলট ইনস্টিটিউটে। এখান থেকেই পাস করেন মাধ্যমিক। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন রাজশাহী কলেজ থেকে। রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নকালে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন মমতাজউদদীন আহমদ। অগ্রজ গোলাম আরিফ টিপুর অনুপ্রেরণায় মমতাজউদদীন আহমদ বামপন্থি ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর শুরু হয় শিক্ষকতার কর্মজীবন। চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে লেকচারার (০৪ বছর), চট্টগ্রাম কলেজে সহকারী অধ্যাপক (০৬ বছর), চট্টগ্রাম কলেজে সহযোগী অধ্যাপক (০৭ বছর), চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপক (২ বছর) ও জগন্নাথ কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে (১২ বছর) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক (০৪ বছর) হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ যুক্তরাষ্ট্রের পিটস্‌বার্গে কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্ব ও নাট্যকলা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। জাপানে এশিয়ান ড্রামা ও পাপেট থিয়েটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। ক্যানবেরাতে এশিয়ান সংস্কৃতি উৎসবে বাংলাদেশ সংস্কৃতি দলে সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ, সংস্কৃতি ও নৃত্য বিষয়ে অভিজ্ঞতাও তার আছে। ভারতে বাংলাদেশ নাট্যদলের নেতৃত্ব নিয়ে দিলিস্ন, জয়পুর, কলকাতায় মীর মশাররফের জমিদার দর্পণ নাটকের প্রদর্শন করেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি দলের সদস্য হিসেবে দিলিস্ন, বাঙ্গালোর এবং কলকাতা ভ্রমণ এবং ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন একাধিকবার। হজব্রত পালনের জন্য সৌদি আরব ভ্রমণ এবং মুসলিম ঐতিহ্য বিষয়ে উপলব্ধি তার সঙ্গে মক্কা ও মদিনা শরিফ দর্শনের অপরূপ অভিজ্ঞতাও তিনি সঞ্চয় করেছেন।

তার রচিত নাটক "কী চাহ শঙ্খচিল" এবং "বিবাহ" পশ্চিম বাংলার রবীন্দ্রভারতী এবং নেতাজী সুভাষ বোস বিশ্বদ্যিালয়ে এমএ শ্রেণিতে বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে পাঠ্য তালিকাভুক্ত।

মঞ্চ বেতার এবং চলচ্চিত্রের জন্য প্রায় শতাধিক নাট্য রচনা ও অভিনয়, নির্দেশনা দিয়েছেন। টেলিভিশনে শ্রেষ্ঠ নাট্যরচনা, চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্য এবং অভিনয়ের জন্য পুরস্কৃৃত হয়েছেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, বর্ণচোরা, কী চাহ শঙ্খচিল, বিবাহ, এখন মধু মাস, এই সেই কণ্ঠস্বর তার উলেস্নখযোগ্য নাটক।

এছাড়াও দুইবোন, রাক্ষুসী, জমিদার দর্পণ, ক্ষতবিক্ষত, ওহে তঞ্চক, খামকাখামকা, বাদশাহী বণ্টননামা, অর্ণবের মাতাপিতা, লাবণি আর তার ছেলে, বটবৃক্ষের ধরম করম এবং সাতঘাটের কানাকড়ি তার বিশেষ মঞ্চ নাটক।

অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ উচ্চতর বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি ঢাকায় কাজ করেছেন প্রায় ২ বছর। পরিচালক, গবেষণা ও প্রকাশনা হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রায় আড়াই বছর ছিলেন তিনি। এছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে এবং নির্দেশে কারচারাল মিনিস্টার হিসেবে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে ৪ বছর সুচারুভাবে ও প্রশংসার সংগে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে অধ্যাপক মমতাজউদদীন বরাবরই সক্রিয় ছিলেন। রাজশাহী কলেজের ছাত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের জন্য অন্তত পাঁচবার কারাবরণ এবং আত্মগোপনে বাস করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি অংশগ্রহণ এবং দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে সফল্য লাভে তার উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা ছিল। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন, গণআদালতসহ সব অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে মমতাজউদদীন ছিলেন সোচ্চার এবং প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ১৯৯৬ সালের গণতন্ত্র উদ্ধারে অগণতান্ত্রিক শক্তি উচ্ছেদের জন্য সর্বজন পরিচিত "জনতার মঞ্চ" আন্দোলনের সৃজন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন তিনি। কারাবাস এড়িয়ে চলার জন্য আত্মগোপনেও ছিলেন কিছু দিন। ফজলুল হক হলে বার্ষিকী সম্পাদক, ঢাকা হলের (ড. শহীদুলস্নাহ হল), সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৫৮ সালে। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক হিসেবে সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করেন। তাছাড়া ১৫ ও ২৩ মার্চে এবারের সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম দুটি লোকনাট্য (যাত্রাপালা) রচনা ও পরিচালনা করে প্রায় ২ লাখ দর্শকের সামনে উপস্থাপনের কৃতিত্ব তারই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়ও তিনি মুখ্য ভূূমিকায় ছিলেন।

স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্র রচনার জন্য প্রায় ১০ বছর নিয়মিত (জনকণ্ঠ, আজকের কাগজসহ অন্যান্য পত্রিকায়) কলাম ও প্রবন্ধ রচনা করেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, সামরিক শাসনবিরোধী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও সাহিত্য বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন তিনি। নিউইয়র্কের জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থান ও পরিচয় বিষয়েও তার গ্রন্থ রয়েছে। মহান অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে একটি গ্রন্থ এবং বিশ্বসাহিত্যবিষয়ক আলোচনা গ্রন্থ- অমৃত সাহিত্য তার গবেষণামূলক রচনা।

স্বীকৃতি ও পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, দেওয়ান গোলাম মর্তুজা সাহিত্য পুরস্কার, জেবুন্নেসা মাহবুবউলস্নাহ পুরস্কার, শিশু একাডেমি অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, চট্টগ্রাম ত্রিতরঙ্গ সাহিত্য পুরস্কার, ফরিদপুর আলাউল সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা সমলয় সম্মাননা, মার্কেনটাইল ব্যাংক সম্মাননা, শেলটেক সম্মাননা, বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক আজীবন নাট্যকর্মের জন্য সম্মাননা, প্রয়াত আনিসুল হকের উদ্যোগে ৮০তম জন্মদিনে নাগরিক সংবর্ধনা ও সম্মাননা এবং বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক

মমতাজউদদীন আহমদের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ জীবনস্মৃতি : এই তো আমি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে : রক্ত যখন দিয়েছি এবং নাটকের বই আমার প্রিয় শেক্সপিয়র।

মমতাজউদদীন আহমদের একটি বিশেষ আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলার বন্ধু বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও ত্যাগ নিয়ে একটি লোকনাট্য রচনা করা। কিন্তু পুরো কাজটি তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি।

অধ্যাপক মমতাজউদদীন মৃতু্যর পর বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। এজন্য তার পরিবার ২০২০ সালে তার নামে একটি নাট্যজন পুরস্কার প্রবর্তন করে। বাংলা একাডেমি ২০২১ সাল থেকে নিয়মিতভাবে এই নাট্যজন পুরস্কার প্রদান করবে। পুরস্কারের মূল্যমান এক লাখ টাকা।

৮৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই মমতাজউদদীন আহমদের স্মৃতির প্রতি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে