শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মধুসূদনের সনেটে ইতিহাস ঐতিহ্য প্রকৃতিপ্রেম ও মিথ

শাহরিয়ার সোহেল
  ২২ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। সাহিত্য রচনার প্রথম ক্ষেত্রে যদিও তিনি বাংলা ভাষাকে অত্যন্ত ঘৃণা করতেন, তথাপি 'দ্য ক্যাপটিভ লেডি' জনপ্রিয়তা না পাওয়ার পর বাংলা সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। বাংলা সাহিত্যের বহু শাখা-প্রশাখায় তার অবদান রয়েছে। বাংলা কাব্যকে হাজার বছরের বন্দিত্ব থেকে তিনি মুক্ত করেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধ্যমে তিনি কাব্যাঙ্গনের স্বাধীনতার স্বাদ উপহার দেন। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা তার অন্যতম বলিষ্ঠ সংযোজন। এছাড়া মহাকাব্য, নাটক, পত্রকাব্য, গদ্য, প্রহসন ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য।

পৃথিবীর ইতিহাসে ইতালির পেত্রার্ক প্রথম সনেটের আবিষ্কারক। পরে শেক্সপিয়র, মিল্টন, বায়রনসহ বহু কবি সনেট লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে সনেটের জন্মদাতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মধুসূদনের সনেটে পেত্রার্কের রীতি অনুসৃত হলেও মিল্টনের আদর্শ রয়েছে। মাইকেলের সনেটের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অষ্টক ও ষষ্ঠকের ভাষা ও ব্যাকরণের দিক থেকেও একে অন্যের সঙ্গে মিলযুক্ত। বহু ধরনের চতুর্দশপদী কবিতা তিনি লিখেছেন। তার মধ্যে চিত্রকল্প প্রধান, কবি ও কবিখ্যাতি, প্রকৃতি, গুণীজন প্রশস্তি এবং দেশের স্মৃতি ও দেশপ্রীতিমূলক সনেট রয়েছে। তার লিখিত মোট ১০২টি সনেটের ভেতর অধিকাংশই দেশ প্রেমে ভাস্বর। প্রায় প্রতিটি সনেটেই কোনো না কোনোভাবে দেশ প্রেমের উলেস্নখ পাওয়া যায়।

মধুসূদন মনে করেছিলেন ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করে শেক্সপিয়র, মিল্টন হবেন। কিন্তু তার আশা যখন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো, তখন তিনি বাংলা সাহিত্যে নব সৃষ্টির জন্য মনোযোগ দিলেন। অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী মধুসূদন সহজেই সাফল্য পেলেন। অতীতের ভুল বুঝতে পেরে তিনি রচনা করলেন 'বঙ্গভাষা' সনেটটি।

হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;

তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলাকে অবহেলা করে পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়িয়েছেন। বহু দিন বহু কষ্ট করে যা রচনা করলেন, সব ব্যর্থ হলো। পরে ভুল বুঝতে পেরে বাংলা সাহিত্যে পূর্ণরূপে ফিরে এলেন; এবং বাংলা ভাষায় যে অফুরন্ত সম্ভার রয়েছে, তা তিনি বুঝতে পারলেন। এই সনেটটির ভেতর তার দেশপ্রেমের কথা প্রগাঢ়ভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এর পর একের পর এক তিনি দেশপ্রেমে উজ্জ্বল সনেট রচনা করলেন। ফ্রান্সের ভার্সাই থেকে তার মনে পড়ল শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদের কথা। সদা-সর্বদা সেই নদের কথা কবির মনে পড়ত। তিনি যখন ঘুমাতেন, স্বপ্নের ভেতরও তিনি সেই নদীর কল-কল ধ্বনি শুনতে পেতেন। বহু নদ-নদী তিনি জীবনে দেখেছেন, কিন্তু তার দেশের একটি বিশেষ নদের কথা বারবার তার মনে পড়েছে। শৈশবের দিনগুলোতে কপোতাক্ষ নদের দুরন্ত হাওয়ায় নিজেকে সঁপে দিতেন। মায়ের স্তনের দুধ যেমন শিশুর তৃষ্ণা মেটায়, ঠিক তেমনি কপোতাক্ষ নদ, জন্মভূমির স্তনের মতো কবির তৃষ্ণা মেটাত। এজন্য কবি বারবার স্মরণ করেছেন কপোতাক্ষ নদকে।

সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি) তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!

এ চতুর্দশপদী কবিতাটি দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশের প্রতি কবির ভালোবাসা প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে এখানে। মধুসূদন রচিত দেশ প্রেমমূলক আরও বহু সনেট রয়েছে। বউ কথা কও সনেটে লিখেছেন,

\হ

কি দুঃখে, হে পাখি, তুমি শাখার উপরে

বসি, বউ কথা কও, কও এ কাননে?

মানিনী ভামিনী কি হে, ভামের গুমরে,

পাখা-রূপ ঘোমটায় ঢেকেছে বদনে?

দেশীয় ঐতিহ্য ও পাখির মনের বেদনা কবি জানতে চেয়েছেন। নিজের দেশের বউ কথা কও পাখিকে তিনি আপন করে নিয়েছেন তার ব্যক্তি সত্তায়। কবি দেব দোল নিয়ে সনেট রচনা করেছেন;

ওই যে শুনিছ ধ্বনি ও নিকুঞ্জ বনে,

ভেবোনা গুঞ্জরে অলি চুম্বি ফুলা ধরে;

ভেবোনা গাইছে পিক কল কুহরণে,

তুষিতে প্রতু্যষে আজি ঋতু রাজেশ্বরে।

কবির দেশীয় চিন্তা-ভাবনা, আনন্দ-বেদনা সব একাকার হয়ে গেছে সনেটগুলোতে। দেশীয় চিন্তাধারা কবি লিখেছেন, শিব-মন্দির, শ্মশান, বিজয়ী দশমী প্রভৃতি সনেট। লিখেছেন সায়ংকালের তারা, ছায়াপথ, সূর্য; যদিও এগুলো প্রকৃতিভিত্তিক। তারপরও সূর্যের ওম পাওয়ার জন্য দেশীয়ভাবে ভেবেছেন সূর্যকে। সব পৃথিবীতে যে সূর্য আলো ও উত্তাপ দেয়, তা যেন ভারতবর্ষে কবির দৃষ্টিতে একটু অন্যরকম। দেশীয় উত্তাপ পাওয়ার জন্য তিনি দেশীয় সূর্যকে কল্পনার দৃষ্টিতে ভেবেছেন। বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ নিয়ে তিনি সনেট লিখেছেন। বটবৃক্ষ নামক সনেটে বটবৃক্ষকে অতি মহান হিসেবে তিনি ভেবেছেন। বিধির করুণার আরেক রূপ বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষ অতি বিশাল। বহু পাখি সেখানে আশ্রয় নেয়। বহুদূর বিস্তৃত করে সে ছায়া প্রদান করে। বহু পাখি এর ফল খেয়ে জীবনধারণ করে এবং এই সনেটে অবশেষে তিনি বলেছেন, বটবৃক্ষ গুণের দিক থেকে দেবতার মতো;

দেব অবতারে ভাবী বন্দে যে তোমারে,

নাহি চাহে মন : মোর তাহে নিন্দা করি,

তরুরাজ! প্রত্যক্ষত : ভারত-সংসারে,

বিধির করুণা তুমি তরু-রূপ ধরি!

মাইকেল মধুসূদন দত্ত আশ্বিন কালে, বসন্তে একটি পাখির প্রতি, নন্দন কাননসহ বহু দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য-প্রকৃতি-প্রেম-মিথজাতীয় সনেট লিখেছেন। ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার সনেটগুচ্ছ। প্রায় প্রতিটি সনেটেই দেশীয় ভাবধারা ও সংস্কৃতি লালিত হয়েছে। মধুসূদনের সনেট তাই দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে