কবিতায় শরতের কথকতা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুর পরিবতর্ন হয়। পরিবতর্ন হয় ঋতুর বৈচিত্র্যও। এর প্রভাব পড়ে সাহিত্যেও। নাগরিক জীবনের শরৎ উদ্যাপন ও গ্রামীণ জীবনে শরৎ উদ্যাপন এক নয়। সে যাই হোক, শরৎ প্রতি বছর বাঙালির জীবনে আসে নতুন আবেদন ও আবহ নিয়ে। শরতে মুগ্ধ হয়ে কবিরা সাদা সাদা পৃষ্ঠায় অক্ষরের মালা গেঁথে লেখেন কবিতা। এভাবেই চলে এসেছে হাজার বছর এবং আগামীতেও যে তা চলবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আবদুর রাজ্জাক
ঋতু-রঙ্গমঞ্চে যখন অগ্নিখরা গ্রীষ্মের আতঙ্ক, যখন বষার্র বিষণœ-বিধুর নিঃসঙ্গতা আর নেইÑ তখনই নিঃশব্দে চরণ ফেলে চলে আসে শরৎ। ঝিমানো প্রকৃতি হঠাৎই প্রাণ পেয়ে ফুরফুরে হয়ে ওঠে। সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতে আসে শরতের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। কবির মন তখন পুলকিত হয়ে যেন গায় : ‘আলোর কমল বনে/বাহির হয়ে বিহার করে যে দিল মনে মনে/আজি সোনার কঁাকন বাজে/আজি প্রভাত কিরণ মাঝে/হাওয়ায় কঁাপে অঁাচলখানি ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে।’ এমন আবেশ নিয়েই কবি শরৎ-আলোর কমল বনে সোনার কঁাকন বাজতে দেখেন প্রতি ভোরে। সবুজ-শ্যামল আর পাখির গুঞ্জনে মুখরিত আমাদের প্রিয় স্বদেশ। অপূবর্ রূপ এবং অফুরান সম্ভার নিয়ে প্রতি বছর আবতির্ত হয় ছয়টি ঋতু। চিকচিক রোদের ভেতর ফসলের মাঠে বাতাসের দোল জীবনে এনে দেয় অমলিন হাসি। বষার্র বিদায়ক্ষণে শরতের আগমনে প্রকৃতি রঙ ছড়ায়। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এমনই সাজে সাজে প্রকৃতি, তাতে মন উড়ে যায় শুভ্র মেঘের নীল আকাশে। বিকেলের সোনাঝরা রোদের ঝলমলে হাসি আর সন্ধ্যার শান্ত আবছা শিশিরে মন উড়ে যায় অজানায়। নদীর ধারে মৃদুমন্দ বাতাস, কাশফুলের শুভ্রতা, হঁাসনাহেনার আকুল করা ঘ্রাণ, চঁাদনী রাতÑ এ সবকিছু শরতের আবেদনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। শরতে মানুষ ভুলে যায় ক্লান্তি ও যাপিতজীবনের নানান অসঙ্গতি। ঘাতপ্রতিঘাত ভুলে জীবন নদীতে সুখের নৌকা ভাসায় আপামর মানুষ। শরৎ তারুণ্যের হৃদয়কে নবযৌবন রাগে রাঙিয়ে দেয়। কাশফুল, শিউলি, কামিনী, দোলনচঁাপা, মল্লিকা, নয়নতারা, ছাতিম, সন্ধ্যামনি, শাপলা, মাধবীর আগমনে শরৎকাল হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত। এমন শরতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো আমরাও যেন বলে উঠি : ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/আমরা গেঁথেছি শেফালীমালা/নতুন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি বরণডালা।’ শরৎ-সন্ধ্যায় গ্রামের মেঠোপথে যেতে যেতে পথিকের মনে নতুন ভাবনার উদ্রেক হয়। শরৎ যেন প্রতিটি সাধারণ মানুষের মধ্যে কবি-ভাবকে জাগ্রত করে দেয়। শরৎ নিয়ে মানুষের এমন মুগ্ধতা কয়েকশ’ বছরের নয়, এ মুগ্ধতা হাজার-হাজার বছরের। শরতের স্নিগ্ধতা চোখে জড়িয়ে তাই মহাকবি কালিদাস বলে ওঠেন : ‘প্রিয়তম আমার ঐ চেয়ে দেখ নব বধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ কালিদাসের দৃষ্টিতে শরৎকাল নববধূর মতো, এ যেন কবির আরেক প্রিয়া। অন্যদিকে মধ্যযুগের কবি আলাওল শরৎকালে দেখেছেন দম্পতিদের সুখের প্লাবন। ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে তিনি লিখেছেন : আইল শরৎ ঋতু নিমর্ল আকাশ দোলায় চামর কাশকুসুম বিকাশ। নবীন খঞ্জন দেখি বড়ই কৌতুক উপজিত থামিনী দম্পতি মনে সুখ\ প্রিয়া কাছে থাকলে শরৎকাল হয়ে ওঠে আরও মাধুযর্ময়। প্রিয়াবিহীন শরৎকাল ভীষণ বেদনার। কবি চÐীদাসের ভাষায় : ‘ভাদর মাসে আহনিশি অন্ধকারে শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহলে তাওনা দেখিব যবে কাহ্নাঞ্চির মুখ চিন্তিতে চিন্তিতে মোর ফুটি ফুটি জায়ির বুক আসিন মাসের শেষে নিবিড়ে বাবিধী মেঘ বাহিঅঁা শেলেঁ ফুটেবেক কাশী।’ মধ্য যুগের কবিরা তো বটেই, আধুনিক যুগে এসেও শরৎ নিয়ে কবিতা চচার্ ফুরায়নি। বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ কবিই শরৎ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরতের বন্দনা করছেন এভাবে : ‘আজি কী তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারত প্রভাতে হে মাতা বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোড়াতে।’ রবীন্দ্রনাথ শরৎ নিয়ে একাধিক কবিতা ও গান লিখেছেন। তিনি তার ‘শরৎ অরুণ আলোর অঞ্জলি’তে লিখেছেন : ‘শরৎ তোমার অরুণ আলো অঞ্জলি/ছড়িয়ে গেল দাপিয়ে মোহন ধোয়া ধোওয়া কুÐলে/শরৎ তোমার শিশির ধোয়া কুন্তলে/বনের পথে লুটিয়ে পড়ে অঞ্জলি/আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’ শরতের শিশির ভেজা সবুজ পথে নানা ফুল ঝরে পড়ে। যা কবি-মনে অনাবিল আনন্দের সঞ্চার করে। সেজন্য ভোরের আলোতে কবির হৃদয় হয়ে ওঠে সতেজ ও প্রাণবন্ত। কবি নজরুল ইসলাম তাই পথিককে শরতের শিউলি বিছানো পথে হঁাটতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তার আমন্ত্রণ : ‘এসো শরত প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে এসো বুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ কিরণ রথে দলি শাপলা শালুক শতদলে এসো রাঙায়ে তোমার পদতলে।’ প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিকতায় ঋতু অনেকগুলো সহজাত বৈশিষ্ট্য বহন করে। এসব বৈশিষ্ট্য কবির কবিতায় বাদ পড়েনি। নজরুল তার অন্য এক কবিতায় প্রেয়সীর কাছে শরৎ উপস্থাপনা করেছে এভাবে : ‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী/ নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী/অলকার পানে বলকা দুটিছে মেঘদূত মনমোহিয়া/ চষ্ণু রাঙা কলমীর কুড়ি মরতের ভেট বহিয়া/সখীর গঁায়ে সেউতি বোটার ফিরোজায় রেঙে পেশোয়াজ/আসমানি আর মৃন্ময়ী সুখি মিশিয়াছে মেঠোপথ মাজ।’ শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ শরৎকে অনুভব করেছেন খুব নিবিষ্টভাবে। সে জন্য শরতের রূপ-রঙ তার চোখে ধরা পড়েছে অন্যভাবে। তার ‘এখানে নীল আকাশ’ কবিতা থেকে : ‘এখানে আকাশ নীল নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে হিম শাদা রং তার আশ্বিনের আলোর মতো আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এখানে করে গুঞ্জরণ রৌদের দুপুর ভরে বারবার রোদ তার সুচিক্কণ চুন কঁাঠাল জামের বুকে নিংড়ায় দহে বিলে চঞ্চল অঙ্গুল।’ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কাছে শরৎ বিরহের কাল। এ ঋতুতে প্রিয় কাছে না থাকায় প্রেয়সীর যে বিরহরূপ তা তিনি কাছ থেকে অবলোকন করেছেন যেন। সে জন্যে তিনি বলতে পারেন : ‘গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল আসিল ভাদ্রমাস বিরহী নারীর নয়নের জল ভিজিল বুকের বাস।’ শরৎ এমনই। এ ঋতুতে কারও মুখে ফোটে হাসি, আবার শরৎ কারও চোখে নিয়ে আসে বিরহীর অশ্রæ। সেজন্য শরৎ কারো কারো কাছে রুক্ষ, কারো কারো কাছে শুভ্রতার। কবি আহসান হাবিবকে বলতে শুনি : ‘এবার শরৎ রাত্রি স্বপন নয় এসেছে সঙ্গিন/লুণ্ঠিত স্বগের্র শীষে সে স্বপন রঙ্গিন/কেঁদে মরে মৃত্তিকায় মিশে যায় ধীরে/এবার শরৎ রাত্রি উদযাপিত হবে অঁাখি নীড়ে।’ নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় শরৎ এসেছে জ্যোতি ছড়িয়ে। তার কবিতা : ‘জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে/নিমিষে শরতের শিশির জ্যোতিকতা।’ শরতে প্রিয়ার রূপ-বন্দনায় ব্রতী হয়েছেন কবি নিমের্লন্দু গুণ। তার ছান্দিক অনুভব : সবে তো এই বষার্ গেল/শরৎ এলো মাত্র/ এরই মধ্যে শুভ্রকাশে/ভরলো তোমার গাত্র।/শেষের আলে মুখ নামিয়ে/পুকুরের এ পাড়টায়/ হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে/বঁাশবনের ওই ধারটায়।’ একেকজন কবি শরৎকে একেকভাবে দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই কবি বন্দনায় বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতিতে শরতের রূপের খেঁাজ মিলে ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপনায়। শরৎ সকালে সবুজ ধানের কচি পাতার ওপর জমানো শিশিরবিন্দু যেন মুক্তোর মতো দ্যুতি ছড়ায়। আমাদের দেশের কৃষক তখন নবান্ন উৎসবের দিনগুনতে থাকে। বিশ্বসাহিত্যেও শরৎ-বন্দনার অসংখ্য কবিতা পাওয়া যায়। কবি ফ্রানারজ তার ‘মাই ওটাম গালর্’ কবিতায় লিখেন, ‘তোমার শরৎ ঠেঁাট/শরৎ চুল/শরৎ চোখ/শরৎ হাসি/শরৎ গ্রীবা/আমি শরতকালে স্রষ্টাকে চুম্বন করি।’ ‘ঐড়সব’ কবিতায় কবি ইৎঁপব ডবরমষ লিখেছেনÑ ‘ও ফরফ হড়ঃ শহড়ি ও ধিং মৎধঃবভঁষ ভড়ৎ ংঁপয ষধঃব ধঁঃঁসহ নবহঃ ঁঢ় পড়ৎহ ঃরবষফং’. কানাডার সাহিত্যপ্রেমীরা শরৎকে মনে করেন খানিকটা বিরতির সময়। তার মানে একটু জিরিয়ে নেয়া আরকি! আমেরিকানরা মনে করে শরৎ কিছুটা নরম ও আরামদায়ক সময়। চাইনিজরা শরতের তৃতীয় মাসের শেষ রাতে বৃষ্টির শব্দ শুনে ঘুমাতে পছন্দ করত। শরতের নিয়ে এমন অনুভব তাদের সাহিত্য চেতনাকে সমৃদ্ধ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুর পরিবতর্ন হয়। পরিবতর্ন হয় ঋতুর বৈচিত্র্যও। এর প্রভাব পড়ে সাহিত্যেও। নাগরিক জীবনের শরৎ উদ্যাপন ও গ্রামীণ জীবনে শরৎ উদ্যাপন এক নয়। সে যাই হোক, শরৎ প্রতি বছর বাঙালির জীবনে আসে নতুন আবেদন ও আবহ নিয়ে। শরতে মুগ্ধ হয়ে কবিরা সাদা সাদা পৃষ্ঠায় অক্ষরের মালা গেঁথে লেখেন কবিতা। এভাবেই চলে এসেছে হাজার বছর এবং আগামীতেও যে তা চলবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।