গল্প

ঘুমঘোর রাতের শরীর

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

তছলিম হোসেন হাওলাদার
আমি যাকে স্বপ্না ভাবি নামে অভিহিত করেছি তিনি অসম্ভব ধবধবে সাদা আর দুধে-আলতা মেশানো শরীরের অধিকারিণী। লম্বা একহারা গড়নের স্বপ্না ভাবি হঁাটতেন ছন্দময় ভঙ্গিতে। হাসতেন গভীর উচ্ছ¡লতায়। তার চলা এবং হাসিতে এক ধরনের মাদকতা থাকত যা তাকে অনুসরণ করা লোকজন বুঝতে পারতেন, কিন্তু তিনি বুঝতেন না। আমি ছিলাম স্বপ্না ভাবির মদ-মাদকতার ফঁাদে আটকেপড়া এক অসহায় পতঙ্গ। স্বপ্না ভাবির বাচ্চাদের পড়াতাম আমি। এ পড়ানোর সূত্র ধরেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি আমার কাছে আসতেন, আমার কাছে বসতেন। বাচ্চাদের পড়াশোনা দেখতেন। কিন্তু একটা পযাের্য় এসে আমি বুঝে যাই যে স্বপ্না ভাবির সঙ্গে আমার সম্পকর্টা একজন শিক্ষকের মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি, আরও বেশি কিছুতে এসে ঠেকেছে। এই কিছুটা যে কী সেটাই বুঝতে পারতাম না। কখনো মনে হতো তিনি স্রেফ আমার ছাত্রছাত্রীর মা, কখনো মনে হতো তিনি আমার বোন, কখনো বা মনে হতো প্রিয় সখা অথবা পাগল পরা প্রেমিকা। স্বপ্না ভাবির স্বামী একটি কোম্পানির বড় অফিসার। কোম্পানির দেয়া তাদের বাসার পরিবেশটি ছিল নিরিবিলি। বেশ বড় বাসা, বড় বড় রুম। আমি ড্রইং রুমে বসে বাচ্চাদের পড়াতাম। বাচ্চাদের পড়ানোর অল্প কদিনের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম যে, স্বপ্না ভাবি বাচ্চাদের পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গও কামনা করছেন। বাচ্চাদের পড়ানোর ফঁাকেই তিনি আমাকে তার রান্না ঘরে নিয়ে যেতেন। মোড়া পেতে দিয়ে আমাকে পাশে বসিয়ে গল্প করতেন। গল্পের ফঁাকে ফঁাকে এটা-সেটা খেতে দিতেন। তার চায়ের আপ্যায়নটা ছিল অসাধারণ। বড় কাপে করে ঘন দুধের চা দিতেন তিনি। চায়ের কাপ হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, খান। আমি চায়ে চুমুক না দিতেই ভাবি বলতেন, চা কেমন হয়েছে? আমি বলতাম, খুব ভালো হয়েছে। তিনি বলতেন, চায়ের কারিগরকে দেখতে হবে না? কারিগর যে এই আমি। তিনি বুকে হাত রেখে তার অস্তিত্ব শনাক্ত করতেন। চা পানের ফঁাকে ফঁাকে আমি স্বপ্না ভাবিকে দেখতাম। তিনি কোটাকাটা অথবা এটাসেটা বাটাবাটি করতেন। তার শরীর খলবলাতো। তার বুকের কাপড় সরে যেত, বেরিয়ে পড়ত ধবধবে দুই স্তনের অংশবিশেষ। আমার অস্বস্তি বেড়ে যেত। আমি বলতাম, আমি উঠি। বাচ্চাদের পড়াতে হবে। স্বপ্না ভাবি উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠতেন। আমার চোখে চোখ রেখে সোজাসাপ্টা বলতেন, শোনেন, বাচ্চাদের পড়ানোই আপনার একমাত্র কাজ নয়। বাচ্চার মাকেও পড়াতে হবে আপনার। আমি বলতাম, তা-ই নাকি! তিনি বলতেন, জি। আমি বলতাম, কী পড়াবো? ভাবি আমার উরুতে খেঁাচা দিয়ে বলতেন, এই যে আমার সঙ্গে এখন কথা বলছেন এটিই হচ্ছে আপনার পড়ানো, বুঝছেন? কথা বলতে বলতেই কোনো কোনো দিন দুপুরের খাবারের সময় হয়ে যেত। ভাবি বলতেন, আপনি যাবেন না। আজ আমাদের সঙ্গেই খাবার খাবেন। এ খাবার নিয়েও ছিল ভাবির বিশেষ আনাড়িপনা। কোনো কোনো দিন ভাবি আমাকে নিয়ে একা একা খেতে বসতেন। ডাইনিং টেবিলে মাংসের পাতিল রেখে বলতেন, পুরো পাতিলের ভাত ও তরকারি শেষ করতে হবে। শেষ না করে উঠতে পারবেন না। আমি ভাতের পাতিল দেখতাম। টুবটুবে উপর হয়ে আছে ভাতের পাতিল। তিনি খেতে শুরু করতেন, আর চামচ দিয়ে আমার পাতে ভাত-তরকারি দিতে থাকতেন। আমি বলতাম, স্যার এবং বাচ্চারা খাবে না? তিনি বলতেন, আপনাকে বলেছি খেতে। কেবল আমাদের দুজনকেই এই ভাত তরকারি শেষ করতে হবে। অন্যের খাওয়া নিয়ে আপনার ভাবনার দরকার নেই। খেতে খেতে একসময় ভাত-তরকারির পাতিল শেষ করে ফেলতাম আমরা। খাওয়া শেষে আমি স্বপ্না ভাবিকে বলতাম, ভাবি এটি আপনার কী ধরনের পাগলামি। জবাবে তিনি সমস্ত শরীর দুলিয়ে শুধু হাসতেন। আমাকে নিয়ে স্বপ্না ভাবি আরও বহুবিধ পাগলামি করতে পছন্দ করতেন। দেখা গেল, দুপুরে ভাত খেয়ে তিনি তার নিজস্ব রুমে শুয়ে আছেন। বাচ্চারা কেউ ঘরে নেই। ভাবি আমাকে ডাকতেন। তার পাশের চেয়ারে বসাতেন। তারপর শুরু করতে নানাবিদ উত্তেজক কথাবাতার্। ভাবি বলতেন, সাগর তুমি কি মেয়ে মানুষের ভেতরে ঢুকেছো কখনো? কেমন ভেতরে-আমি জানতে চাইতাম। ধরো, এই আমি এখন যেমন শুয়ে আছি। এ অবস্থায় তুমি আমার ভেতরে ঢুকলে। আমি বলতাম, আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আপনার মাথা ঠিক আছে। আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি কী বলছেন? ভাবি বলতেন, সাগর তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়ছো কেন? তোমার শরীর কি গরম হয়ে যাচ্ছে? আমি চোখ নামিয়ে নিতাম। শুয়ে থেকেই এ সময় ভাবি তার দু পা দুলাতে থাকতেন। তার বুক ও পেট থেকে কাপড় সরে যেত। বড় হতে থাকতো দুই স্তনের মধ্যকার ফঁাক। নাচের ভঙ্গিতে দু পা দুলাতে দুলাতে ভাবি এ সময় গেয়ে উঠতেন ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা, আরতো প্রাণে সহে না যখন-তখন তুই করিস্ জ্বালাতন ভা-লো লা-গে না... একসময় আমি লক্ষ্য করতাম যে, আমার ভেতরে দুদার্ন্ত সব পরিবতর্ন ঘটে যাচ্ছে। আমি ভাবির কাছ ঘেঁষে বসি, তার হাত ধরি। হঠাৎই ভাবি স্তব্ধ হয়ে যেতেন। তার শরীর হিমশীতল হয়ে পড়ত। তার রক্ত হিম ফ্যাকাশে কপাল বেয়ে নেমে আসত জল। মাঝেমধ্যে আমি চিন্তা করতাম, ভাবির জীবন কি তবে অপূণর্তায় ভরা? তিনি কি অসুখী? কিন্তু তেমনটিও মনে হত আমার। তিনি উদ্দাম হাসি-খুশিতে চলতেন। ভেজা চুলে উঁচু খেঁাপা বঁাধতেন। কখনো কখনো দেখতাম ভাবির দুই গালে দঁাতের অঁাচড়। সাদা-গালে ঠকটকে লাল ক্ষত। আমার মাথা গুলিয়ে যেত। কোনো কিছুই বুঝে ওঠা সম্ভব হতো না আর। স্বপ্না ভাবির সঙ্গে মাঝেমধ্যে আমার মান-অভিমানের খেলাও হতো। কেন এবং কী কারণে এ মান-অভিমান, তাও বুঝে উঠতে পারতাম না। ভাবির এক বিশ্বস্ত দূত ছিল, বাড়ির কেয়ারটেকার। তার মাধ্যমেই ভাবি আমাকে খবর দিতেন। কখনো কখনো পাঠাতেন চিঠি। চিঠিতে শুধু দুটি শব্দ থাকত, সাগর আসো। মাঝেমধ্যে এই দুটি শব্দ দিয়েই পুরো পাতা ভরিয়ে দিতেন ভাবি। আমি আসলে তিনি বলতেন, চিঠিটা এনেছো? আমি বলতাম, কেন? ভাবি বলতেন, কতবার ‘সাগর আসো’ লিখেছি গুনে দেখতাম। তখন তো মাথা ঠিক ছিল না! আমি বলতাম, পাগল! মান-অভিমানের এই সময়ে আমি যখন বাসা থেকে চলে আসতাম, ভাবি ছাদে দঁাড়িয়ে দঁাড়িয়ে আমার চলে যাওয়া দেখতেন। আমি পেছন ফিরে তাকালে ভাবি হাত নাড়াতেন। হঁাটতে হঁাটতেই আমি আমাদের সম্পকের্র ব্যাখ্যাটা বুঝতে চাইতাম। কিন্তু সেই ব্যাখ্যাটি কখনই আর জানা হয়ে উঠত না। একদিনের কথা আমি জীবনেও ভুলব না। তিনদিন ধরে আমি বাসায় আসি না। বাচ্চাদের পড়াই না। সেদিন ছিল আধা চঁাদনীর রাত। সন্ধ্যার কিছু পরেই ভাবি আমার ম্যাচে এসে হাজির। আমরা কজন তখন বসে তাস খেলছিলাম। ভাবি সোজা এসে আমার হাত ধরলেন। হাতে ধরা তাসগুলো হাত থেকে ফেলে দিলেন। সবার সামনে থেকে আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন। আমি পথে কথা বলতে চাইলে তিনি আমাকে কথা বলতে নিষেধ করলেন। বাসায় এনে সোফায় বসিয়ে ধমকের সুরে প্রশ্ন করলেন, তুমি কদিন আসোনি কেন? আমি বললাম, বাচ্চাদের পড়ার ক্ষতি হওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। ভাবি বললেন, আমি যা জানতে চেয়েছি তার জবাব দাও সাগর। তুমি এ ক’দিন আসোনি কেন? আমি নিরুত্তর থাকলাম। স্বপ্না ভাবি আমাকে বারান্দায় টেনে নিয়ে গেলেন। বাচ্চারা ড্রইংরুমে পড়ায় ব্যস্ত। বারান্দায় নিয়ে ভাবি আমাকে তার মুখোমুখি দঁাড় করালেন। বললেন, সাগর তুমি কি আমার কাছে কিছু চাও? আমি জবাব দিলাম, না। ভাবি রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, তুমি কি আমার দেহটা চাও। বলো সাগর, তুমি কি আমার দেহ চাও। আমি দুই হাত দিয়ে ভাবির মুখ চেপে তার চিৎকার বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। তিনি বিকট শব্দে কেঁদে উঠলেন। তার কান্নার শব্দ দূরদিগন্তে ছড়িয়ে যেতে থাকল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, ভাবি আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও। ভাবি কান্না থামালেন। অঁাচল দিয়ে মুখ মুছলেন। বললেন, ঠিক আছে মাফ করে দিলাম। এখন তুমি ড্রইংরুমে যাও, বাচ্চাদের পড়া দেখ। আর একটা কথা, আমি না বলা পযর্ন্ত তুমি ঘর ছেড়ে যাবে না। আমি বললাম, ভাবি, স্যার কোথায়? ঢাকায়। কোম্পানির জরুরি মিটিংয়ে গেছে। আমি অনেকক্ষণ ড্রইংরুমে বসে থাকলাম। একসময় বাচ্চারা পড়া শেষ করে চলে গেছে। কিন্তু আমি উঠতে পারছিলাম না। রাত বাড়ছে দেখে একসময় আমি উঠে দঁাড়ালাম। এ সময়ই ভাবির গলার শব্দ শোনা গেল। সাগর ভেতরে আসো। ডাইনিং টেবিলে অনেক আয়োজন। আমি বললাম, ভাবি এত সব আয়োজন! স্যার আসবে নাকি? ভাবি বললেন, না। তোমার জন্য রেঁধেছি। তোমার প্রিয় খাবার ভুনা খিচুড়ি আর পশু হাইল চালের ফিন্নি। বাকিগুলো আগেই রঁাধা ছিল-চিংড়ি ভাজি আর ডাল। আমি বললাম, বাচ্চাদের ডাকুন। ভাবি বললেন, তোমার মাথা ঠিক আছে। রাত এখন কটা বাজে তুমি জানো? আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত ১২টা বাজে। ভাবি বলল, বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে। তুমি খাও সাগর। আমি বললাম, আপনি খাবেন না? ভাবি মুচকি হাসলেন। বললেন, আমি খেয়েছি। তারপরও তুমি বললে, তোমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য খাবো। আমি বললাম, তাহলে আসুন। ভাবি আমার সঙ্গে সমান সময় নিয়ে ভাত খেলেন। খাওয়া শেষে ভাবি আমাকে ছাদে নিয়ে গেলেন। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। এখানে-সেখানে ইতস্তত ফুটে থাকা কিছু তারা উঁকি-ঝঁুকি দিয়ে কি যেন দেখতে চাইছে, হয়তো বা আমাকে আর ভাবিকেই। অধর্নগ্ন চঁাদ সন্তরণশীল মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি ডুবসঁাতার খেলে খেলে তখন অনেকটাই ক্লান্ত। একসময় আমি গভীর দৃষ্টিতে ভাবির দিকে তাকালাম। তার পরনে নীল শাড়ি, সঙ্গে মেস করা বøাউজ। তার দিঘল কালো চুল মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে। হঠাৎই আমার মনে হলো ভাবি যেন ভাবি নয়, আকাশ থেকে নেমে আসা এক পরী। নীল ডানা মেলে আমার সামনে দঁাড়িয়ে আছে। আমার ধ্যান ভাঙল ভাবির কথায়। সাগর, তুমি কিছু বলছ না কেন? কী বলব? ভাবি বললেন, নিজর্ন রাত। আকাশ আর পৃথিবীর মাঝখানে তুমি আমি একা দঁাড়িয়ে। এ সময়ে তুমি কিছু বলবে না তা কেন হবে? ভাবির অপরূপ রূপ আর রাতের নিজর্নতার মাদকতায় আমি তখন আচ্ছন্ন। বললাম, ভাবি আমি কি তোমাকে একটা চুমো খেতে পারি? পারো, তবে গালে নয়, চুমো খেতে হবে আমার হাতে। ভাবি তার ধবধবে সাদা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি ধ্যানমগ্ন হয়ে তার হাতে চুমো খেলাম। চুমো খেতে খেতেই মনে হলো পরী হয়ে ভাবি যেন তার হাত ধরে আমাকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে চলেছেন। আমরা যাচ্ছি শারদ মেঘের দেশে। আমার স্বপ্ন ভাঙল ভাবির খিল খিল হাসির শব্দে। স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে আমি ভাবির দিকে তাকালাম। বললাম, সত্যি করে বলো তো, তুমি কে? তুমি কি পরী? জবাবে ভাবি আবার হাসলেন। খিল খিল করে নয়, এবার অট্টহাসিতে নাড়িয়ে দিলেন ঘুমঘোর রাতের শরীর। আমি বললাম, কথা বলো ভাবি। বলো, তোমার আমার মধ্যে সম্পকর্ কী। নিস্পৃহ কণ্ঠে ভাবি জবাব দিলেন, জানি না। আমি চিৎকার করে বললাম। তাহলে অন্তত এটুকু বলো যে, কেন আমরা রাত জেগে আছি। ভাবি সেই একই জবাব দিলেন, জানি না।