শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মনীষী আহমদ শরীফ বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব

সাইফুজ্জামান
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

আহমদ শরীফ বিরলপ্রজ লেখক। তার সাহিত্যে পান্ডিত্য, মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তা এবং অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের প্রতিফলন ঘটেছে। যুক্তিবাদী দর্শন, রাজনীতি ও গভীর জীবনবোধ আশ্রিত তার রচনায় মুক্তপথের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগ গবেষণায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। মধ্যযুগ সাহিত্যের বিশাল ভুবনে যে বিচিত্রতা ও গভীরতা রয়েছে তা ড. আহমদ শরীফ উনিশ শতকের বাঙালি শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টিগোচর করেন। প্রাচীন পুঁথিসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ থেকে তিনি তার গবেষণার রসদ সংগ্রহ করেছেন।

বাংলাসাহিত্যে ও আহমদ শরীফের স্থান কাল থেকে মহাকালে পরিব্যাপ্ত। উপমহাদেশের সাহিত্যে ও প্রধান ব্যক্তিত্বরূপে তার আবির্ভাব ও পরিচিতি। আহমদ শরীফ রচিত উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থ বিচিত্র চিন্তা (১৯৬৮), চট্টগ্রামের ইতিহাস স্বদেশ অন্বেষা (১৯৭০), জীবনে সমাজে সাহিত্যে (১৯৭০), সৈয়দ সুলতান তার গ্রন্থাবলি ও তার যুগ (১৯৭২), যুগযন্ত্রণা (১৯৭৪), মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙ্গালী সাহিত্য (১৯৭৮), কালের দর্পণে স্বদেশ (১৯৮৫), বাংলা ভাষা সংস্কার আন্দোলন (১৯৮৬), কালিক ভাবনা (১৯৭৪), বাঙ্গালীর চিন্তাচেতনার বিবর্তনধারা (১৯৮৭), বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চালচিত্র (১৯৯০), মানবতা ও গণমুক্তি (১৯৯০), বাংলা, বাঙ্গালী ও বাঙ্গালিত্ব (১৯৯২), সংস্কৃতি (১৯৯২), প্রগতির বাধা ও পন্থা (১৯৯৪), সময় সমাজ মানুষ (১৯৯৫), বিশ শতকে বাঙ্গালী (১৯৯৮)।

ড. আহমদ শরীফ ছিলেন যুক্তিবাদী। যুক্তির মাধ্যমে বুদ্ধি ও মুক্তির প্রণোদনা তার রচনায় বিস্তৃত। তার পিতৃব্য আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ উপহৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০০ পুঁথির মধ্য থেকে তিনি তার গবেষণার রসদ সংগ্রহ করেছেন। তিনি পুঁথির শব্দ শনাক্ত করেও সঠিক অর্থ খুঁজে পুঁথির ব্যাখ্যা, টিকা, ভাষ্য নির্ণয় করেছেন। আহমদ শরীফ সম্পাদিত প্রথম পুঁথিগ্রন্থ বাহরাম খানের লায়লী মজনু কাব্য (১৯৫৭) বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত। আহমদ শরীফ সম্পাদিত পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে স্মরণযোগ্য আলাউলের তোহফা (১৯৫৮), সিকান্দারনামা (১৯৭৭), মুহম্মদ খানের সত্যকলি বিবাদ সংবাদ (১৯৫৯), মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী (১৯৫৮), জয়েন উদ্দীনের রসুল বিজয় (১৯৬৪), মুজাম্মিলের নীতিশাস্ত্র বার্তা (১৯৬৫), শারারিদ খানের গ্রন্থাবলি (১৯৬৬), আফজল আলীর নসিহতনামা (১৯৬৯), দোনা গাজীর সয়ফুল মূলক বদিউজ্জামাল (১৯৭৫), সৈয়দ সুলতানের নবী বংশ (১৯৭৮), রসুল চরিত (১৯৭৮), শেখ মুতালিবের বিফায়তুল মুসলিস্নন (১৯৭৮)। ড. আহমদ শরীফ মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের সীমানা চিহ্নিত করেছেন। তার রচিত গ্রন্থ বিচিত্র চিন্তায় অন্তর্ভুক্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খসড়াচিত্র মধ্যযুগের ইতিহাস চিত্র প্রবন্ধে মধ্যযুগের বাংলা ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে (১৯৮৫) সাহিত্যের বিপুল ঐশ্বর্য উন্মোচিত হয়েছে। বাঙ্গালী ও বাঙ্গলা সাহিত্য (১৯৭৮, ১৯৮৩)-তে হিন্দু-মুসলমান সাহিত্যিকদের মিলিত প্রয়াস কীভাবে আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তার যথাযথ মূল্যায়ন ও গভীর অনুসন্ধান করেছেন আহমদ শরীফ। নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বৈশিষ্ট্য অনুদ্ঘাটন করার দুরূহ কর্ম ড. শরীফ সম্পাদনা করেছেন।

মধ্যযুগে বাংলাসাহিত্যে যে বিবর্তন সূচিত হয় তা ড. আহমদ শরীফ চিত্রিত করেছেন। মধ্যযুগে বাংলাসাহিত্যে চিন্তা-চেতনার ধারা অংশে তিনি দরিদ্র মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই দেখা যায় দেশে বা সমাজে নিঃস্ব, মজুর, প্রান্তিকচাষি, চিরদরিদ্র, বৃত্তিজীবী ছিল হাজারে ৯৯৯ জন। শাহসাম আর ছিল বেনেমুৎসুদ্দী গোষ্ঠীপতি গ্রাম্যসর্দার, টাউট এবং শিক। পুরোহিত ও সার কিছু ধূর্ত শ্রেণির লোক ছিল যারা এ যুগের সংজ্ঞায় মধ্য শ্রেণি। কাজেই প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে ঐশ্বর্যমান মানুষ ছিল, ছিলেন রাজা, অমাত্য ও উচ্চ পদের রাজকর্মচারীরাই। এরাই ছিলেন মানুষের জানমাল গর্দানের মালিকদন্ডমুন্ডের অধিকারী (বাঙ্গালীর চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা পৃ-১১)

মানুষের অন্ধবিশ্বাস, ভাগ্যনির্ভরতা ও নিয়তিবিদ্ধতা আহমদ শরীফ প্রত্যক্ষ করেছেন। মানুষের কর্মেই যে মুক্তির পথ খোলা আছে, মতামত প্রকাশ করতে তিনি তার রচনায় সাধারণ মানুষকে প্রণোদনা জুগিয়েছেন। সত্যকে আবিষ্কার ও কর্মে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াসী ছিলেন ড. আহমদ শরীফ। কর্মের মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকে, বাঁচার শক্তি ও উপাদান আহরণ করে। এ বিষয়টি তিনি সঞ্চারিত করেছেন পাঠকের মধ্যে। বাঁচার লড়াই ও মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষকে তিনি গ্রথিত করেছেন। তদবিরে তকদির বদলানো যায়- এ বিশ্বাস মানুষ কখনো হারায়নি। তাই ভাগ্যপরিবর্তনের জন্য মানুষ জ্ঞান, বিশ্বাস ও শক্তি অনুসারে চিরকাল প্রয়াস চালিয়েছে এবং তা করেছে অদৃষ্ট বিধিলিপি বা কপালের লিখন অমোঘ, অখন্ডনীয় বিশ্বাস করে। মানুষ যে কেবল প্রকৃতিরও প্রাকৃত শক্তির কাছে অসহায় তা নয়, প্রবল দুর্জন মানুষের পীড়ন পাত্র সে। (মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের বিবর্তন ধারা পৃ: ১১১)।

তার রচনার সিহংভাগ দেশ চিন্তা জাতিসত্তার স্বকীয় সীমানা চিহ্নিত। উনিশ ও বিশ শতকের সাহিত্যিকদের সাহিত্য ভাবনা, দর্শন ও ইতিহাস কেন্দ্র করেও বাংলাসাহিত্যের অর্জন ও উপলব্ধি ধারণ করেও আহমদ শরীফ অগ্রসর হয়েছেন। বঙ্কিম ভাবনার মূল জায়গা থেকে আহরিত জ্ঞান ও বিষয়কে ধারণ করেও আহমদ শরীফ রচনা করেছেন বঙ্কিম মানস ও বঙ্কিম বীক্ষা অন্য নিরিখে। বঙ্কিমের বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একাত্ম হতে পারেননি। হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমের ভাবনা নিয়ে ড. আহমদ শরীফ দ্বিমত পোষণ করেছেন। উদ্ধৃতি : ১. বঙ্কিমচন্দ্র যা লিখেছেন তা কেবল হিন্দু ও হিন্দুয়ানির উন্নতির জন্যই (বিচিত্র চিন্তা পৃ. ৩১২)। অন্যপ্রবন্ধে বঙ্কিম সাহিত্যের যথাযথ মূল্যায়ন উঠে এসেছে। বঙ্কিম মানস (১৯৬০) ও বঙ্কিম বীক্ষা অন্য নিরিখে (১৮৭৫) প্রবন্ধে তিনি বঙ্কিম সাহিত্যের মৌল প্রতিপাদ্য বিশ্লেষণ করেছেন। বঙ্কিম মানসে বঙ্কিমের নেতিবাচক ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য বঙ্কিমকে কীভাবে সাম্প্রদায়িক লেখক হিসেবে চিহ্নিত করে তা প্রবন্ধে বিশ্লেষায়িত হয়েছে। ড. আহমদ শরীফ উদার ভাবনা ও মানব কল্যাণ থেকে বিচ্ছিন্ন বঙ্কিমকে মূল্যায়ন করতে লিখেছেন : 'বঙ্কিম ছিলেন য়ুরোপীয় জীবন মহিমায় মুগ্ধ'। কিন্তু তিনি সম্বিৎ হারাননি। তাই তিনি জীবনের সাধনাও আবাহন করেছেন জীবনব্যাপী নিজের জন্য নয়, বাঙালি হিন্দুর জন্য... তাই তিনি খিড়কি পথেই য়ুরোপের অবদান, অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করলেন... তাই শাড়ি সিঁদুর পরা মেম সাহেবই তার আদর্শনারী। তেমনি মর্যাদায়, সাহসেও পৌরুষেদৃপ্ত ইংরেজ সিভিলিয়ানই তার আদর্শ (বিচিত্র চিন্তা পৃ. ৩১১)।

তিনি বঙ্কিম সাহিত্যের সামগ্রিকতা অস্বীকার করেননি। বঙ্কিম প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেও ড. শরীফ প্রতিভা অন্বেষা, বঙ্কিম সাহিত্য ভাবনা, একীভূত হয়েছেন। তিনি বঙ্কিম বীক্ষা অন্য নিরিখেতে বঙ্কিমকে ইতিবাচক ভাবনায় উপস্থাপন করেন। বিধাব বিবাহ ও হিন্দুত্ববাদ এড়িয়ে বঙ্কিম যেখানে অগ্রসর হয়েছেন সে স্থানটুকু এড়িয়ে য়ুরোপীয় সাহিত্যের প্রভাবে তার সমৃদ্ধি লাভকে অস্বীকার করেননি ড. শরীফ। উদ্ধৃত করা যেতে পারে :

স্বদেশের ও স্বজাতির প্রেমিক ও সেবক বঙ্কিম প্রতীচ্য আমলে জাতি গঠনের দায়িত্ব স্বেচ্ছায়, সানন্দে ও সাগ্রহে নিজের হাতে গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্কিমের লেখনী তাই স্বজাতির চিত্তবোধন, হিতসাধন, ও গৌরবকথন কর্মে উৎসর্গিত হয়েছিল। (প্রত্যয়ও প্রত্যাশা পৃ. ১৭৪)। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও পর্যটকের চোখে বাঙালি চরিত্রের নেতিবাচক ধারণার প্রতিভাস লক্ষ্য করা যায়। চোর, মিথ্যেবাদী, ভীরু, পরশ্রীকাতর ও ঈর্ষাপরায়নই বাঙালিকে আহমদ শরীফ সমতায় ধারণ করেছেন। বাঙালি চরিত্রের বহুমাত্রিকতা আহমদ শরীফ তার রচিত গ্রন্থ বাঙালি ও বাংলাসাহিত্য (১ম ও ২য় খন্ড), বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব, সংস্কৃতি ও নির্বাচিত প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। এদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত সব আন্দোলনে বাঙালির অভূতপূর্ব সংগ্রাম ইতিহাসে অনন্য মহিমায় উৎকীর্ণ। তাই বাঙালির আবেগ ও চরিত্রের দৃঢ়তা সব ছাপিয়ে বাঙালিকে দ্রোহী হিসেবে শুধু চিহ্নিত করেছে তাই নয়- সত্য ও ন্যায়ের পথে তার অগ্রসরমানতার দীর্ঘযাত্রা ইতিহাসে গৌরবের আসনে সমাসীন করেছে। বাঙালি চরিত্রের বৈপরীত্যে, দ্বান্দ্বিকতায় ও বৈচিত্র্যে আহমদ শরীফ এমন একমত বাঙালিকে খুঁজে পান যে বাঙালি আমাদেরও চেনা।

বাঙালি ভাবপ্রবণ ও কল্পনাপ্রিয়। উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনাতেই এর প্রকাশ। তাই বাঙালি যখন কাঁদে তখন কেঁদে ভাসায়। আর যখন হাসে তখন সে দাঁত বের করেই হাসে। যখন উত্তেজিত হয়, তখন আগুন জ্বালায়। তার সবকিছুই মাত্রাতিরিক্ত। তার অনুভূতি ফলে অভিভূতি গভীর। কেঁদে ভাসানো, হেসে লুটানো আর আগুন জ্বালানো আছে বটে, কিন্তু কোনোটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। সেহেতু উচ্ছ্বাস উত্তেজনা মাত্রেই তাৎক্ষণিক গুণজীবী তাই বাঙালির গীতিপ্রবণ তার উৎস এখানেই (নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃ. ৪১-৪২)।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে আহমদ শরীফ দাঁড়িয়েছেন। ধর্মবুদ্ধির গোড়ার কথা সমাজে দর্শন শাস্ত্রের প্রভাব ও স্বরূপ প্রবন্ধে অন্ধধর্ম বিশ্বাস উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে উলেস্নখ করেছেন। আহমদ শরীফ সাহসী ও দৃঢ়চেতা। সঙ্গত কারণে তিনি উচ্চারণ করেন। 'সহনশীলতা হচ্ছে সংস্কৃতির একটি মৌল শর্ত। আমি যা জানি, যা বুঝি, যা ভাবী, তা সাধারণে জানে না, বোঝে না, ভাবে না, আমার জ্ঞান-বুদ্ধি-রুচি-বিচার-বিবেক অন্যদের চেয়ে উন্নত এমনকি এক উত্তম্মন্যতা এবং অন্যকে অযাচিত উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার ধৃষ্টতা যে অপরিশীলিত বর্বর রুচি-বুদ্ধিরই পরিচায়ক, তা তথাকথিত শিক্ষিত সংস্কৃতিমানেরাও উপলব্ধি করেন না। যে কোনো মানুষের যে কোনো বিষয়ে স্বমত ও মন্তব্য প্রকাশের এবং অন্যের বিবেচনার জন্য নিবেদন করার অধিকার নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট মত-মন্তব্য বলে আস্ফালন বা দাবি করা যে অন্যের জ্ঞান-বুদ্ধি-রুচি-বিবেককে তাচ্ছিল্য কিংবা অস্বীকার করার ঔদ্ধত্যের নামান্তর, তা বোঝার মতো সংস্কৃতিমান মানুষ কোটিতেও গুটিকয়েক মেলে না।

আহমদ শরীফ উদারমানবতাবাদ, বিশ্বাস ও কর্মে মুক্তির পথকে মানবমুক্তির অবলম্বন হিসেবে প্রচার করেন। আহমদ শরীফের গবেষণাপত্রে বিস্তৃত। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যও অমূল্য সম্পদকে বিদ্বৎ সমাজে পরিচিত করার প্রচেষ্টার তিনি পথিকৃৎ। মানুষের বিশ্বাস, জীবনযাপন ও করণীয় তিনি নিরন্তর ভেবেছেন। বাঙালি শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু অর্থের প্রয়োজনে বিদেশ ছুটছে- তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। আহমদ শরীফ তার দিনলিপি ভাবের বুদ্বুদে অকপটে তার বিশ্বাস, সমাজ অভ্যন্তরের রণ মুখ ও মুখোশের দ্বন্দ্ব ও আড়ালচিত্র বন্দি করেছেন। ড. আহমদ শরীফ ছিলেন বাংলাসাহিত্যের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক। মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী হিসেবেও তার পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। তিনি সরকারিী দলের লেজুড়বৃত্তি করেননি। সমাজের ডামা-ডোলের মধ্যে বাস করেও তিনি উদার, নির্লোভ ও অধ্যবসায়ী বিবেকী কণ্ঠস্বর হিসেবে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন। আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। ঊনসত্তর ও সত্তরের বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনা সংগঠনের তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত এক সভায় ড. আহমদ শরীফ ভবিষ্যতের বাঙালি শীর্ষক এক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আহমদ শরীফ দ্রোহ ও প্রতিবাদকে জীবন-চেতনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগরের উত্তরাধিকারের অহঙ্কার তার চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত করে তাকে প্রতিবাদী দরিদ্র নিঃস্ব মানুষের পক্ষে কাজ করার শক্তি জুগিয়েছিল নিঃসন্দেহে। আশির দশকে 'উত্তরাধিকার' পত্রিকায় 'রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র-মূল্যায়ন' রচনায় নতুন ভাবনার উৎস সঞ্চার করেন। আশি ও নব্বই দশকে মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ভাবনা দৈনিক ও সাময়িকপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আহমদ শরীফের গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃৃত। সমাজ ও সমকালের বহুমুখী সঙ্কট, সম্ভাবনা ও মুক্তির বিচিত্র উপাদান তার গবেষণায় আত্মীকৃত হয়েছে। সাধারণ মানুষ, সংগ্রামী উপাখ্যান ও বাসতবতার নিরিখে মানুষের কর্মমুখর সৃজনী অংশগ্রহণকে তিনি উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন। তিনি ছিলেন অটল, হিমালয়ের মতো। আহমদ শরীফ তাই আজও নতুন প্রজন্মের কাছে এক প্রেরণার উৎস। বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব তার ভাবনার প্রধান অংশ ছিল। বক্তব্যের দৃঢ়তা তাকে যুক্তিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার ভেতরকার সম্পর্কে তিনি উপস্থাপন করেছেন। তিনি প্রগতির সারথি ছিলেন। অবস্থান, বক্তব্য ও জীবনযাপনে দ্বৈততা তার ছিল না। দেশাত্মবোধ, ঐতিহ্যপ্রীতি আর সত্য উচ্চারণে আহমদ শরীফ ছিলেন অদ্বিতীয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে