মালদ্বীপে রাঙানো গোধূলি

প্রকাশ | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

তপন কুমার দাশ
সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে দেখেছি পথে যেতে তুলনা হীনারে। \হ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মালদ্বীপ এসেছি শিক্ষা সফরে। সকাল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মিটিং করলাম। বিকেল চারটার দিকে একটি টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মালদ্বীপ দেখব বলে। হোটেলের সামনের রাস্তাটি পিচঢালা নয়। মনে হয় যেন পোড়া মাটির টাইলস বসানো। এই রাস্তা ধরে পঞ্চাশ গজ বাম দিকে গিয়ে সাগরকে ডানদিকে রেখে সাগরের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক কিলোমিটারের মতো সামনে আসলাম। এখানে পৌঁছেই দেখি মালদ্বীপ যেন থমকে গিয়েছে। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে এখানে, অধিকাংশই বিদেশি। চমৎকার সুন্দর করে এখানে সাগরের পাড় বেঁধে দেওয়া হয়েছে উঁচু করে। সেই পাড়ের উপর আছড়ে পড়ছে নীল সাগরের সবুজ ঢেউ। পাশেই দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়, এমন একটি উঁচু স্থান। সেখানে অনেক পর্যটক ভিড় করেছে। সেখান থেকেই কেউ কেউ বড়শিতে টোপ গেঁথে বোট নিয়ে ছুটে চলেছে গভীর সাগরে। মাঝেমধ্যেই তারা ঢেউয়ের তালে যেন লাফিয়ে উঠছে দু'তিন ফুট উপরের দিকে। বোটের আশপাশেই মাঝেমধ্যে লাফিয়ে উঠছে মাঝারি সাইজের রুপালি মাছ, আমাদের দেশের পাঙ্গাশ মাছের মতো। \হচীনাদের একটি দলকেও দেখলাম। অস্তাচলগামী সূর্যের বিদায়ী দৃশ্য ধারণ করার জন্য তারা বেইজিং থেকে এসেছে। বিকাল তিনটা থেকে ক্যামেরা সেট করে তারা ঘোরাফেরা করছে এদিক-সেদিক। চীনা ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত একেবারেই স্স্নিম নায়িকারাও রয়েছে এ দলে। তাদের কাছেই জানলাম, সূর্যাস্ত ধারণ করার জন্য পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট রোমাঞ্চকর স্থান এটি। সে রোমাঞ্চের ভাগীদার হওয়ার জন্যই হংকং হয়ে তারা গতকালকেই মালদ্বীপসে এসেছে। থাকবে সাত দিন। তারপর দুবাই হয়ে চলে যাবে গ্রিসের সমুদ্রতটে। অত্যন্ত পাতলা ঝলমলে প্রিন্টের খোলামেলা গাউন পরা চীনা নায়িকাদের সঙ্গে যখন ছবি তুলছিলাম তখন দেখি পশ্চিম আকাশে যেন আগুন লেগেছে, লালে লাল হয়ে গিয়েছে সমগ্র আকাশ আর নীলিমা। তার নিচে ভারত মহাসাগরের জল ধারণ করেছে নানা রঙ। আমাদের সামনের জল একেবারেই সবুজ। এ সবুজ জলের মধ্যে ছোট মাছ বড়শিতে গেঁথে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে ছুড়ে মারছে বিদেশি তরুণ-তরুণীরা। আর মাঝেমধ্যেই টেনে তুলছে বড়শিতে গাঁথা দু'তিন কেজি ওজনের সামুদ্রিক মাছ। ওগুলো হাতে ঝুলিয়ে দৌড়া-দৌড়িও করছে কেউ কেউ। আমাদের দৃষ্টির সামনে প্রায় একশ গজ দূরের জলরাশিকে মনে হচ্ছে ঘন নীল। এক কিলোমিটার দূরের জলে যেন গোলাপি আভা। আরও কয়েক কিলোমিটার দূরে আকাশ আর সাগর যেখানে একাকার হয়ে গেছে সেখানে মনে হলো যেন জলন্ত আগুনের শিখা। এমন লাল রঙ যেন আর এ জীবনে দেখিনি। আমার পাশেই ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সেরূপই দেখছিলেন চীনা ছায়াছবির পরিচালক ও ক্যামেরাম্যান টোয়ান জ্বিংয়া। তিনি আমায় ইশারায় ডেকে লেন্সে চোখ রাখতে বললেন। আমি তাই করলাম, আর পলকে আমার সারা দেহ মনে যেন বয়ে গেল এক অজানা শিহরণ। বিস্মিত হলাম জুম করা লেন্সে আলোর এ রকমারি রূপ দেখে। বিস্মিত হলাম জিংয়ারে ফ্রেমিং-এর মাহাত্ম্য বুঝতে পেরে। আমি লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে এনে নিজের ক্যামেরাটা অন করে সেই আলোক রশ্মিকে পিছনে রেখে চীনা সুন্দরী যুগলের ছবি উঠাতে গেলাম। তৎক্ষণাৎ তারা পোজ দিতে উদ্যত হলো। ছিপছিপে পাতলা লম্বা এ দুই নায়িকা তক্ষনি একে অন্যকে কোমরের দিকে জড়িয়ে ধরে কোমর থেকে শরীরের উপরিভাগ পিছনের দিকে এলিয়ে দিল সম্পূর্ণভাবে। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার এ দুই নায়িকার শরীরই যেন বেঁকে গেল ধনুকের মতো, যা একেবারেই অকল্পনীয়। তাদের একজনের পরনে গোলাপি আর অন্যজনের পরনে হাঁটু পর্যন্ত হলুদ প্রিন্টের গাউন। দু'পাশে হেলেপড়া দেহবলস্নভীর মাঝাখানে থাকল ভারত মহাসাগরের সুনীল জলরাশির মধ্যে ডুবতে থাকা জলন্ত কিংবা নিভন্ত এক অগ্নিপিন্ড। তারই সম্মুখে চীনা নায়িকাদের আগুন ঝরানো রূপ মালদ্বীপের এ গোধূলি বেলায় সেদিন রচনা করল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এ দৃশ্য ধারণ করে ধন্য হলাম। হাত মেলালাম নায়িকাদের সঙ্গে, পরিচালকের সঙ্গেও। আমার সঙ্গে ছিল খাগড়াছড়ির মথুরা ত্রিপুরা। চীনা নায়িকাদের সঙ্গে এ টিপরাকে একেবারে চীনা নায়ক বলেই মনে হচ্ছিল। জন্মগতভাবেই অপরাপর আদিবাসীদের মতো কিছুটা লাজুক স্বভাবের মথুরাকে টেনে এনে চীনা নায়িকাদের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে কয়েকটা ছবি উঠালাম। মজা করেই ওদের বললাম, হি ইজ এ এথনিক হিরো অব বাংলাদেশ। হাই বলে নায়িকারা তাদের মতো করে মথুরা বাবুকেও উইস করল। একরকম হঠাৎ করেই দেখি আমাদের দলে থাকা ড. জ্ঞানেন্দ্র আর ড. সৌরভ সিকদার সমুদ্রের পাড়ঘেঁষা পথ ধরে দ্রম্নত হাঁটা দিয়েছে সামনের দিকে। মুহূর্তেই তারা চলে গেল প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে। ফোন করে জানতে চাইলাম, কি হলো কোথায় যাচ্ছেন। পেছন ফিরে পশ্চিম দিকে সাগরের বুকে আবছা আবছা দেখা যাওয়া দ্বীপটির দিকে আঙুল উঁচিয়ে চিৎকার করে সৌরভ বলল, হিলিগিলি, গিলি গিলি। তার মানে ওই যে ডানদিকে যে দ্বীপটি দেখা যাচ্ছে, সেটার নাম হিলিং গিলি। মাইলখানেক সামনেই রয়েছে পোর্ট। সেখান থেকে পনেরো মিনিট পর পর বোট ছাড়ে আর হিলিং গিলি পৌঁছে বিশ-ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই। ভাড়া প্রতিজন পাঁচ রুপিয়া। তারা দু'জন এখন সেদিকেই রওনা হয়েছে। মথুরা দাকে টেনে এনে আমরা দুজনও হিলিং গিলির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। একটু সামনে আগাতেই হাতের বাম দিকে ইন্দিরা গান্ধী হাসপাতাল। এটাই এ দেশের সর্বাধুনিক হাসপাতাল। এখানেই দেখা পেলাম বেশ কজন বাংলাদেশি যুবকের। তারা এখানে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুুরেন্টে কাজ করে। এখন ছুটি পেয়েছে, তাই একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। বলা দরকার মালদ্বীপের জনসংখ্যা চার লাখের মতো। তবে, ইতিমধ্যেই প্রায় একলাখ বাঙালি যুবক পৌঁছে গেছে বৈধ বা অবৈধভাবে মালদ্বীপে জীবিকার সন্ধানে। সর্বত্রই দেখা যায় এ বাঙালিদের। সে যাক, কয়েক মিনিট হেঁটেই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। সেখান থেকেই দেখলাম অনেক বোট আসা-যাওয়া করছে এদিক-সেদিক, হিলিং গিলির দিকেও। কিন্তু ততক্ষণে ভারত মহাসাগরের সব রঙ মন্দা হতে শুরু করেছে। সূর্যদেবের বিদায়ের বিষাদ যেন সবকিছুকে কালিকাময় করতে শুরু করে দিয়েছে। মনে পড়ছে কবি সুফিয়া কামালের লেখা 'সাঁঝের মায়া' কবিতার কটি লাইন, অনন্ত সূর্যাস্ত অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত ভালে দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার বুঝি আজ দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড় দানের অনন্দ গেল শেষ করি, মহাসমারোহে। আবার ফোন করে ড. সৌরভের সঙ্গে কথা বললাম। আজ আর এ অন্ধকারে হিলিং গিলি যেতে বারণ করলাম। তাতে কাজও হলো। ওরা ওখানেই থামল, একসঙ্গেই রওনা হলাম হোটেলের উদ্দেশে। এ হোটেলেই গার্ড হিসেবে কাজ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সোবহান। হোটেলে আসতেই সে জানতে চাইল, \হআজ কিতা দেখলা? চীনা নায়িকাদের কথা বলতেই সে বলল, মালে দ্বীপের বাইরে অনেক রিসোর্ট আছে, যেগুলো এক একটি দ্বীপ, সেগুলোতে গেলেই দেখা যাবে বিদেশিদের। সে আমাদের একদিন সেদিকে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। আসলে সেদিন এয়ারপোর্টে থাকা কালিনই দূতাবাসের কর্মকর্তা প্রতীক রশিদ জানিয়েছিলেন মালে শহরে কোনোরূপ মদ, জুয়া, নেশা কিংবা অনৈসলামিক কার্যকলাপের কোনো সুযোগ নেই। তবে বিদেশিদের জন্য আলাদা আলাদা দ্বীপে যেসব রিসোর্ট আছে সেখানে পানাহার চলে। বিদেশিরা সেসব সঙ্গে করেই নিয়ে আসে। এখানে শুধু এয়ারপোর্টে একটি বৈধ মদের দোকান আছে। এখান থেকে ইচ্ছা করলে শুধু বিদেশিরাই মদ কিনতে পারে বলে এ কর্মকর্তা আমাদের জানিয়েছিলেন। আমরা এসব কিছু আগে থেকেই জানতাম। ড. সৌরভ ইউরোপে থেকেছে দীর্ঘদিন। লিডসে, লন্ডন, টোকিও কিংবা ওয়াশিংটনের অলিগলি দু'চারটে আমারও চেনা। আর মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা তো ঐতিহ্যগতভাবেই এসব কিছুর সঙ্গে পরিচিত। তাই আসার সময় মথুরা দা একটি বড়োসড়ো রেড লেভেল নিয়ে এসেছে। তার কক্ষে বসে যখন চুমুক দিচ্ছিলাম তাতে, কড়া মিউজিক ভেসে আসছিল পাশের সিনেমা হল থেকে। 'হাবিবি হাবিবি' করে আরবীয় সুরের এ হিন্দি গানটি তখন মালদ্বীপে খুবই জনপ্রিয়। তার সুরের সঙ্গে আমরাও যেন একটু দুলে উঠলাম। পেছনের জানালায় পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। সিনেমা হলের পাশ ধরে দু-এক জোড়া কাপলকে মটরবাইকে চড়ে এদিক-সেদিক যাওয়া-আসা করতে দেখলাম। নিকট দূরে সাগরে দাঁড়িয়ে থাকা মাছধরার বোটগুলো দেখতে পেলাম। আর দেখতে পেলাম সাগরের জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে আছড়ে পড়া অজম্র তারার আলোর সঙ্গে শত শত লাল-নীল বাতির আলোর খেলা। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম এ দৃশ্য। \হকিন্তু, সকালেই ঘুম থেকে উঠে হুলেহ্‌ মালেহ্‌ দ্বীপে যেতে হবে যে! তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুমাতে গেলাম।