শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার জন্য

আবু সাইদ কামাল
  ০৫ মার্চ ২০২১, ০০:০০

জুলাই মাসে সীমান্ত পার হয়ে মেঘালয়ের ডালু ইয়ুথ ক্যাম্পে যাই আমি। তখন ক্যাম্পের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নান্দিনা কলেজের অধ্যাপক মতিউর রহমান (প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান, পরে ধর্মমন্ত্রী)। সেখান থেকে বাছাই হয়ে গেরিলা ট্রেনিং নিতে যাই তুরায়। সর্দার সিং নামে এক রাজপুত লেন্স নায়েক আমাদের ট্রেনিং দিতেন। একদিন আমাদের কয়েকজনকে ছদ্মনাম ঠিক করে দিলেন। আমার নাম দিলেন লালচান। কাকতালীয়ভাবে ডাক নামের সঙ্গে মিলে গেল। এ ঘটনায় খুব খুশি হলাম। ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা আমি।

একাত্তরের ডিসেম্বরে পাক-ভারতযুদ্ধ শুরু হয়। ভারতীয় এফ জে সেক্টরের সঙ্গে ময়মনিসিংহে ঢুকলাম। কমান্ডার বাবাজি শান্ত সিং। ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে পিছু হঠার সময় টাঙ্গাইল এলাকায় ধরা পড়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদের খান। তাকে নিয়ে আসা হয় ময়মনসিংহে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল, সেখানে তখন আমাদের অবস্থান। এখানে তিনতলা একটি সুসজ্জিত বাঙ্কার দেখেছি। চুড়ির টুকরা পেয়েছি বাঙ্কারে। বিকালে হেঁটে যাচ্ছিলাম টেনিস মাঠের পাশ দিয়ে। সামনে পড়লেন বাবাজি। সঙ্গে কাদের খান। টেনিস খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেখে আমি অবাক। ইশারায় ডাকেন। বলেন, ইউ বয়, কাম হিয়ার। ইউ উইল হেলপ আস টু পেস্ন। ইউ উইল পিক দি বল। উড ইউ ফিল কম্ফোর্ট টু ডু দিস?

হাউ ইজ ইট পসিবল?

মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মনে মনে বলি, কী অবাক কান্ড! একজন বন্দির সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে টেনিস খেলা? আর একজন মুক্তিযোদ্ধা কুড়াবে সেই বল!

এমন সময় কোত্থেকে ছুটে এলেন সর্দার সিং। উলেস্নখ্য, ৩ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্দার সিং, আমি আর নুরুল ইসলাম এইচএক্স সিগন্যাল সেট নিয়ে বাবাজির সঙ্গী ছিলাম। সর্দার সিং আমার সবচেয়ে আপনজন, আমার ওস্তাদ। যেন চোখে চোখে রাখছিলেন আমাকে। তিনি চিৎকার করে বলেন, হাউ ডেয়ার ইউ, লালচান?

এ কথা শুনে খুব ভয় পেলাম। ভাবী, কাকে কী বললাম, এত সাহসই বা পেলাম কোথায়? এর পরিণাম কী...?

ইউ বয়। দিস ইস ওয়ার।

ভরাট গলায় বললেন বাবাজি।

কাম টু মি।

আই উইল স্পেন্ড জাস্ট ওয়ান মিনিট ফর ইউ।

আমি খুব ভয়ে ভয়ে বাবাজির কাছে যাই। বাবাজি বললেন, এটি যুদ্ধ। ভারত চায় জয়, পাকিস্তান নিজেদের রক্ষা করতে মরিয়া। আর তোমরা যুদ্ধ করছ স্বাধীনতার জন্য। তোমাদের সঙ্গে আমাদের দু'পক্ষের সৈনিক চরিত্রের মিল নেই। কারণ, বিষয় মেলে না। পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাদের খান এখন আমার কব্জায়। তার মর্যাদা ব্রিগেডিয়ার। আমরা সমান। বন্ধু।

খেলায় বল কুড়িয়ে দিলাম আমি ও আরেকজন। কিন্তু বাবাজি শান্ত সিংয়ের কথার মানে বুঝিনি তখন। খেলতে গিয়ে প্রচন্ড খিস্তি খেউর করেছে কাদের খান। একটি পচা কথাও শুনিনি বাবাজির মুখ থেকে। হেসেছেন কেবল। বাবাজির চেহারা ঋষি-দরবেশের মতো দেখতে, সৈন্যাধ্যক্ষের মতো নয়। খেলা শেষে বাবাজি জিজ্ঞেস করেন, ডু ইউ ফিল কম্ফোর্ট নাও?

নো স্যার।

ইউ লালচান, বস্নাডি ফুউল।

জবাবে আমি কোনো কথা বলিনি। মনে মনে বলি, পাক ব্রিগেডিয়ার কাদের খানের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই আমার এমন প্রতিক্রিয়া। যদিও কাদের খানকে ঘিরে কিছু কাহিনী সম্পর্কে আমি আগেই অবগত হয়েছি। তবু তার প্রতি আমার অদম্য ঘৃণা দমাতে পারিনি।

দুই

গ্রামের নাম কাজলা। একাত্তরে কাজলা গ্রামের একটি বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ বাড়ির সব সন্তান তখন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে। সন্ধ্যার পর বাড়ির উঠানে গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনতো। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও রংপুরের রৌমারী-চিলমারী অঞ্চল এবং শেরপুর সীমান্ত সংলগ্ন কামালপুর রণাঙ্গনে যুদ্ধের খবর শুনলে সবাই বুঝে নিত এ বাড়ির ছেলের নেতৃত্বে এসব যুদ্ধ হচ্ছে। এই বাড়ির সেই ছেলেটির নেতৃত্বে এ এলাকার যুবকরা ভারতে যেত মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। শ্যামগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে কাজলায় যাতায়াত ছিল সেকেলে। রিকশা-গাড়ি চলাচলের কোনো উপায় ছিল না। তখন এলাকায় জনশ্রম্নতি ছিল, বাড়িটি অস্ত্রের ডিপো। বর্ষায় কর্দমাক্ত পথ ও খাল পার হয়ে দুর্গম এ গ্রামে হানা দিতে পাকবাহিনী ভয় পেত। যদিও 'মেলিটারি আইয়া পড়ছে' এমন চিৎকার কয়েকদিন শোনা গেছে। তবুও ছিলিমপুর ও কান্দুলিয়া গ্রামের সীমানায় মগরা খাল পার হয়ে হানাদার বাহিনী কাজলায় যায়নি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে দুই পস্নাটুন সৈন্য ও রাজাকার দল কাজলা গ্রামটি ঘিরে ফেলে।

মাত্র আগের রাতে এ বাড়ির ছেলে আরিফ তার স্ত্রী এবং শিশুপুত্রকে নিয়ে ভারতের বাগমারা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে বাড়ি ফিরেছে। বাগমারা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া লোকেরা তখন কলেরার কবলে পড়েছে। নদী দিয়ে ভেসে আসছে কলেরামারিতে মৃত অগণিত লাশ। এ অবস্থায় নিরুপায় হয়ে আরিফ শিশুপুত্র বাপী ও স্ত্রীকে নিয়ে কাজলার বাড়িতে ফিরে আসে। তার পরদিনই পাকবাহিনীর হামলায় পড়ে ওরা।

রাজাকাররা বাড়ির জিনিসপত্র উঠানে ফেলছিল। আরিফের আম্মা উর্দুতে কথা বলতে পারতেন। কাছে দাঁড়ানো পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ্য করে ধমকের সুরে বললেন, এসব লুটপাট বন্ধ করো। কেন এসেছো তোমরা?

অবাক কান্ড। তার কথা গুরুত্ব পায়। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে রাজাকাররা নিভৃত হয়। গ্রামে ছড়িয়ে পড়া সৈন্য ও রাজাকার সদস্যরা অল্প বয়সি নারী ও গরু-ছাগল ধরে এনে ওই বাড়ির বাইরের রাস্তায় জড়ো করেছে। পাক-হানারদের ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। আরিফের আম্মা বললেন, আমাদের নিতে এসেছো- নিয়ে যাও! গ্রামের এসব মেয়েদের নিলে তোমাদের বিপদ হবে। আমি তোমার বড় অফিসারকে সব বলব।

তাতে কাজ হলো। শেষপর্যন্ত আরিফের স্ত্রী-সন্তান ও আম্মা-আব্বাকে নিয়ে হানাদার বাহিনী ফিরে গেল। প্রথমে তাদের নেত্রকোনায় নেওয়া হয়। একদিন পর ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউসে পাকবাহিনীর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যায়। পাঠান ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদের খান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় হানাদার বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল। একই অঞ্চলে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মেজর তাহের। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কাদের খান ছিল তাহেরের প্রশিক্ষক। জীবন-মরণ মুক্তিযুদ্ধে তখন তারা প্রবল প্রতিপক্ষ। মেজর আবু তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হয়েছেন।

ব্রিগেডিয়ার কাদির খান তার অফিসে নিজেই কথা বলল মেজর তাহেরের আব্বা-আম্মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে। অদম্য সাহস ও দৃঢ়তায় তার আম্মা কথা বলেছিলেন পাকিস্তানি অধিনায়কের সঙ্গে। বলেছিলেন, আমার ছেলেরা তোমাদের বাহিনীতে ছিল। তারা কোথায় জানি না। হয়তো মেরে ফেলেছ। তোমরা এই দেশকে ছারখার করে দিচ্ছ। তোমরাও রক্ষা পাবে না।

জবাবে কাদির খান বলল, তাহের ও আপনার অন্য ছেলেরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তাদের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো তাই করতাম। তাহের খুবই সাহসী কমান্ডো। আমার প্রিয় অফিসার ছিল সে। তাকে খবর পাঠাবেন, সে যেন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। আপনাদের দেশ স্বাধীন হবে। তখন তাহেরের বড় প্রয়োজন হবে।

এই বলে কাদির খান সবাইকে সসম্মানে কাজলায় ফেরত পাঠালো। গ্রামে যেখানে কাফনের কাপড় কিনে সবার অপেক্ষা, সেখানে অবাক বিস্ময়ে এলাকার মানুষ দেখতে পেল, হাসিমুখে তাহেরের আব্বা-আম্মার ঘরে ফেরার দৃশ্য। মাথার উপর ছাতি ধরে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিল রাজাকার সদস্যরা!

কাদের খানের নির্দেশমতো আরিফকে অবশ্য ফিরে যেতে হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় এক বছর পর আরিফ আফগানিস্তান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত হয়ে দেশে ফিরে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধে কত বিস্ময়কর ও নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। ব্রিগেডিয়ার কাদির খানকে নিয়ে তেমন একটি ঘটনা রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তে কামালপুরে পাক-হানাদারদের সুরক্ষিত শত্রম্ন ঘাঁটি। সেই সূত্রে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারেরও কথা আসে। কামালপুরের পতন হলে দ্রম্নততম সময়ে ঢাকায় প্রবেশ সম্ভব হবে- গেরিলা বিশেষজ্ঞ মেজর তাহের তা বুঝেছিলেন বলে কামালপুরের শত্রম্ন ঘাঁটি থেকে মাত্র ৮০০ গজ দূরে মহেন্দ্রগঞ্জে ১১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। ছোটভাই মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনকে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার নিয়োগ করেন। সেই সুবাদে তাহেরের যুদ্ধ পরিকল্পনার কথা আনোয়ার জানতে পারত। কামালপুর-শেরপুর-জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে সবচেয়ে দ্রম্নত ঢাকা পৌঁছানো ছিল মেজর তাহেরের লক্ষ্য। কামালপুর দুর্গের দখল নিতে একের পর এক আক্রমণ চালাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত রণাঙ্গনের সংবাদের উলেস্নখযোগ্য অংশজুড়ে থাকে কামালপুরের কথা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও কামালপুরের যুদ্ধ আলোচনায় আসে। একাত্তরে মার্কিন যুদ্ধ সংবাদদাতা জ্যাক এন্ডারসন কামালপুরকে অভিহিত করেছিলেন 'ঢাকার প্রবেশদ্বার' হিসেবে।

তাহেরের বাবা রেলওয়েতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে পিতার কর্মস্থল কুমিলস্না থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেন। ১৯৫৯ সালে কুমিলস্নার এমসি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর ও পরে শিয়ালকোট যুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরত্বের খেতাব অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে আমেরিকার ফোর্ট ব্রাগ ও ফোর্ট ব্রেনিং থেকে প্রশিক্ষণে অংশ নেন এবং উচ্চতর সমরবিদ্যায় অনার্স গ্র্যাজুয়েশন করেন। ১৯৭০ সালে কোয়েটা স্টাফ কলেজে টেকনিক্যাল কোর্সে অংশ গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালালে তার প্রতিবাদে গ্রেপ্তার বরণ করেন। একাত্তরের ২৫ জুলাই অ্যাবোটাবাদে আটকা অবস্থা থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

১২ আগস্ট আবু তাহের ১১নং সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর তাহেরের অনুরোধেই কর্নেল ওসমানী ১১ নম্বর সেক্টরকে পৃথক সেক্টর হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এ সেক্টরের অধীন মোট আটটি সাবসেক্টর ছিল। সেসব সাবসেক্টরে ও সাবসেক্টর কমান্ডাররা ছিলেন যথাক্রমে- ১. মাইনকার চর: ফ্লাইট লে. এম হামিদুলস্নাহ খান, ২. মহেন্দ্রগঞ্জ : আব্দুল মান্নান, ৩. পুরাখাসিয়া : শামসুল আলম মাস্টার ৪. ডালু : ডা. আব্দুলস্নাহ আল মাহমুদ, ৫. শিববাড়ি : নাজমুল হক তারা, ৬. বাগমারা : তাফাজ্জল হোসেন চুন্নু ৭. রংরা : শহীদ নাজমুল আহসান ৮. মহিষখোলা : ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান।

১৪ নভেম্বর ছিল তাহেরের জন্মদিন। এই দিনে কামালপুর শত্রম্ন ঘাঁটি দখল করতে গিয়ে গুরুতরভাবে আহত হন। ফলে হাঁটুর উপর থেকে তার বাম পা হারান। তখন স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুলস্নাহকে সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনী নিয়ে এ সেক্টরে ২৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল।

তার পিতা-মাতা সব পুত্র-কন্যাকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠালেও নিজেরা বাড়ি ছেড়ে যাননি তাহেরের মা-বাবা। তবে তারা কাজলা থেকে বহু দূরে গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসারত পুত্র তাহের দেখতে গিয়েছিলেন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। তখন তাহেরের প্রতি কাদের খানের কুশল বার্তাও জানান তার আব্বা-আম্মা। মেজর তাহের আহত হওয়ায় কামালপুর দুর্গের পতন বিলম্বিত হয়েছিল। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের লাগাতার আক্রমণ ও অবরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১-এর ৪ ডিসেম্বর তারিখে কামালপুর দুর্গের পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের ৭০ জন ও প্যারা মিলিটারি বাহিনীর আরও ৭০ জন সৈনিকসহ আত্মসমর্পণ করে। পতন হয় কামালপুর দুর্গের। এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনী কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সঙ্গে তাহেরের অবর্তমানে ছিলেন তাদের মেজো ভাই আবু ইউসুফ। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সৌদি বিমানবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে লন্ডন হয়ে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন সেক্টর কমান্ডার অনুজ মেজর তাহেরের নেতৃত্বে।

কামালপুর দখলের পর যৌথবাহিনী এগিয়ে যায় ঢাকার দিকে। সামনে শেরপুর হয়ে জামালপুর। পথে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা ল্যান্ড মাইনের আঘাতে ভারতীয় মেজর জেনারেল গুরবক্স গিল ও ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আহত হন। তারা দুজন একই জিপে ছিলেন। গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য জেনারেল গিলকে পাঠানো হয়। এই হাসপাতালেই ভিআইপি কেবিনে চিকিৎসারত ছিলেন মেজর তাহের। জেনারেল গিল যাওয়ার পরও তাহের ভিআইপি কেবিন থেকে স্থানান্তরিত করা হয়নি। জেনারেল গিল চিকিৎসা নিয়েছিলেন পাশের আরেকটি ছোট কেবিনে।

আহত ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার চিকিৎসার জন্য ভারতে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ৯ ডিসেম্বর জামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের লে. কর্নেল সুলতানকে আত্মসমর্পণের জন্য পত্র পাঠান। পত্রবাহক ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী জহুরুল হক। তা প্রত্যাখ্যান করে মুন্সীর হাতে একটি বুলেটসহ উত্তর পাঠান কর্নেল সুলতান। তারপর দুদিনের মাঝেই পাকিস্তানি দম্ভ ধূলিসাৎ হয়। জামালপুরের পতন হয় ১১ ডিসেম্বর। টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার পথে অগ্রসর হয় যৌথ বাহিনী। পথে নাটকীয় ঘটনা ঘটে। ১২ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে পলায়নরত পাকবাহিনীর একটি দল ঘেরাও হয়ে আত্মসমর্পণ করে। দেখা গেল ময়মনসিংহ সেক্টরের পাকিস্তানি অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদের খান আছেন এই দলে। ৯৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদের খান তার পুরো স্টাফসহ আত্মসমর্পণ করে। এই প্রথম এমন উচ্চপদের একজন পাকিস্তানি অধিনায়কের আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। ১৬ ডিসেম্বরে রেসকোর্স ময়দানে হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের ৪ দিন আগেই তা ঘটল।

কাদের খান বন্দি। তার দেখা হবে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ঢাকার পথে আগুয়ান ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফের সঙ্গে। ইউসুফ তার মা-বাবার কাছে আগেই জেনেছিলেন কাদির খানের কথা। ভারতীয় অধিনায়ক ক্লেয়ারকে সে কথা জানালেন ইউসুফ। যুদ্ধবন্দি ব্রিগেডিয়ার কাদের খানকে বললেন, তিনি মেজর তাহেরের বড় ভাই। যুদ্ধ চলাকালে বন্দি করার পরও তাদের পিতা-মাতা-ভাইকে সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে তাকে ধন্যবাদ জানালেন। প্রতিক্রিয়ায় ইউসুফকে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে পাঠান সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদের খান। তাহের বেঁচে আছেন জেনে তিনি বারবার 'শুকরিয়া' প্রকাশ করছিলেন। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভারত থেকে ১৯৫ জন শীর্ষ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার কাদের খান পাকিস্তানে ফিরে যায়।

১৬ ডিসেম্বর সকালে নিয়াজির হেডকোয়ার্টারে আত্মসমর্পণ আলোচনাকালে ইউসুফ কর্তৃক নিয়াজির ইম্পালা স্টাফ কারের পতাকা উঠিয়ে নেওয়া এবং পরে তারই পরামর্শে তার দেখানো পথে ধানমন্ডিতে বন্দি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাছে যাওয়া, সেখানে অবস্থানকারী পাকিস্তানি গার্ডদের নিরস্ত্র করে সরিয়ে দেয় এবং বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ও কন্যাদের সঙ্গে চা পান করে। ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় মেজর অশোকতারা সিং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ছবি তুলে বিখ্যাত হলেন, বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা পেলেন, কিন্তু ক্লেয়ারের নেতৃত্বে ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের সর্বপ্রথম ঢাকায় প্রবেশ এবং জেনারেল নাগরাকে সঙ্গে নিয়ে নিয়াজির হেডকোয়ার্টারে আত্মসমর্পণ চুক্তি স্থির করা এবং ১৬ ডিসেম্বরে সর্বপ্রথম পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু পরিবারকে মুক্ত করার বিরল কীর্তির কথা অপ্রকাশিত রয়ে যায়।

যুদ্ধ মানুষের জীবনে কখনো করুণ পরিণতি ডেকে আনে। এ কথা সত্য যে, মূলত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা ও এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এদেশবাসীর উপর। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে সমরনায়ক ইয়াহিয়া ও রাজনীতিবিদ বিশেষ করে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর অশুভ আঁতাতের ফলই হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ। হানাদার পাকবাহিনীর একটি ব্রিগেডের অধিনায়ক কাদের খানের যুদ্ধাপরাধের দায় নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এ প্রশ্ন ওঠে সুদূর পাঠান মুলুক থেকে বহু দূরে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া এক অন্যায় যুদ্ধে হয়তো ইচ্ছা বহির্ভূতভাবে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার কাদের খানকে। কি করে ভোলা যায় যে, প্রতিপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহেরের বন্দি পরিবারকে শুধু সসম্মানে মুক্তিই তিনি দেননি, তাহেরের কুশল কামনা করেছেন আন্তরিকভাবেই। যুদ্ধে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয়, মানুষ পশুর পর্যায়ে চলে যায়-একথা সত্য। তবে মানুষ সে অবস্থা থেকেও ঘুরে দাঁড়াতে চায়। ন্যায়বোধ হয়তো একেবারেই সে হারিয়ে ফেলে না। ব্রিগেডিয়ার কাদের খানের মধ্যেও কি তেমন কোনো মানবিক বোধ সক্রিয় ছিল!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে