বাংলা ভাষার আধুনিক কবি শামসুর রাহমান

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

সাইফুদ্দিন সাইফুল
আধুনিক বাংলা ভাষার বাংলা শব্দের বাংলা কাব্যের শক্তিমান প্রতিভাবান কবি হয়ে দীঘর্কাল বাংলা কবিতাকে যিনি একহাতে বিনিমার্ণ করেছেন এবং বাংলা কবিতাকে মূতর্-বিমূতর্ করে সম্পূণর্রূপে নিজ ঢঙে, রঙে, ভাবে, শিল্পে প্রকাশ করেছেন তিনি আমাদের কবি বাংলা ভাষার কবি বাংলা শব্দের কবি বাংলা কাব্যের কবি মানুষের কবি এবং কবিদের কবি শামসুর রাহমান। মাইকেল রবীন্দ্রনাথ নজরুল আর জীবনানন্দের পরে যদি বাংলা ভাষার কোনো কবি বাংলা কবিতাকে সত্যিকাথের্ কবিতা করে তুলে থাকে তবে কবি শামসুর রাহমান তাদের ভেতরে একজন এবং অবশ্যই অন্যতম এতে দ্বিমত নিশ্চয়ই কেউ করবে না। কেননা, বাংলা ভাষায় হাতে গোনা কজন বড় মাপের কবির নাম বলতেই শামসুর রাহমানের নাম উঠে আসে। মূলত ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কবিতার প্রথম বই প্রকাশের মধ্য দিয়েই কবি শামসুর রাহমান তার সমকালীনদের মধ্যে একদিকে যেমন কবি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তেমনি আবার নিজস্ব আলাদা ভাষা, ভাব, ছন্দ, রূপ, রস চেতনাবোধ বিশ্বাস ও শিল্পবোধ সৃষ্টি করে অন্যদের চেয়ে একটু অতিমাত্রাই আপন কাব্যশক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা নলিনীকিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশ হয়। তারপর একে একে তার কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে। ফলে কবিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন থেকেই তার শুধু সামনে বাংলার কাব্যজগৎকে জয় করা। আর এভাবেই কবির সামনে চলার পথ তৈরি হয়। মাত্র ১৯ বছর বয়সে কাব্য জগতে প্রবেশ করে কাব্যের রঙে রাঙিয়ে শিল্পের শিল্পতাকে একান্তে মনে-প্রাণে ধারণ করে একজন সত্যিকারের শব্দশ্রমিক হিসেবে নিজেকে বাংলা কাব্যভুবনে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। পরে কবির কাব্যজীবনে তারই প্রভাব ফেলেছে। তিনি সাহিত্যচচার্র পাশাপাশি নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে সাংবাদিকতার কাজও করেছেন। ১৯৫৭ সালে ‘মনির্ং নিউজ’ এ চাকরিজীবন শুরু করেন এবং ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কবিতা যদি চিত্রকল্প হয়ে থাকে তবে বলব যে, কবি শামসুর রাহমান চিত্রকল্পের নৌকায় চড়ে শব্দ, ছন্দ, ভাষার মাঝি হয়ে কবিতাকে চিত্রকল্পের একদম নান্দনিক রূপ চিত্রায়িত করেছেন। এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে শামসুর রাহমান যদি একটু বেশি এগিয়ে থাকেন তবে তাতে তেমন দোষের কিছু নেই বলেই মনে হয়। যেহেতু তার সমকালীন কবিদের অনেককে পেছনে ফেলে আপন কবিসত্তা নিয়ে শব্দকে হাতিয়ার বানিয়ে ছন্দ, ভাব, ভাষা, উপমা, কল্পনাশক্তিকে তিনি কাজে লাগিয়ে একজন বোদ্ধা লেখকরূপে প্রকাশ হয়েছেন। আর তাই কবিতা যদি হয় চিত্রকল্পের একান্তে শিল্পময় প্রকাশ তবে সে ক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমানের কবিতাদ্বয়ে চিত্রকল্পের রঙে রাঙানো চরম স্বাথর্কতার প্রকাশ ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে কাব্যে তিনি নববিন্যাস অবকাঠামো তৈরি করেছেন। কবিতাকে তিনি শুধু শব্দে শব্দে গেঁথে ছন্দে, ভাবে, রসে, ভাষায়, বোধে নিমার্ণই করেননি কবিতাকে সচেতনভাবে শিল্পের চিত্রকল্পের রূপদান করেছেন। এখানেই কবির কবিসত্তা আপন মহিমায় সুকুমার হয়ে আকাশের মতো উদার হয়ে সাগরের মতো উত্তাল ঢেউ হয়ে পাখির ডানার মতো চিত্রময়, শিল্পময়, ছন্দময়, রসময়, ভাবময় একদম নিরেট নান্দনিক হয়ে উঠেছে। আমরা তাই কবি শামসুর রাহমানকে সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান শক্তিমান শব্দশ্রমিক উপাধি দিতে পারি। যেমন, একজন কৃষক কিংবা শ্রমিক অনেক কষ্টে রোদ-বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে লাঙল কঁাধে নিয়ে হাতুড়ি পিটিয়ে নিরলস গায়ের রক্তঘাম মাটিতে ফেলে জমিতে সোনার ফসল ফলায় কারখানায় উৎপাদনে সহায়তা করে; তেমনি কবি শামসুর রাহমানও একজন দক্ষ কৃষকের মতো সাহিত্যের জমিতে শব্দচাষ করে এবং কাব্যের কারখানায় শব্দকে আগুনে পুড়িয়ে হাতকে লোহা করে একেবারে শব্দশ্রমিক রূপে গড়ে তুলেছেন। বাংলা কাব্যে তিনি এক অনন্য ও অসাধারণ শব্দচাষি এবং শব্দশ্রমিক হয়ে আছে। আধুনিক নগরজীবনের কারিগর কবি শামসুর রাহমান যেমন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান বহুমাত্রিক কবি ও লেখকÑ তেমনি তিনি আবার শিল্পের বিপ্লবী এবং ভীষণ প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে তার লেখা কবিতায় অন্যায়-অত্যাচার, দুঃশাসন, মৌলবাদিতা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদের ভাষা হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তিনি ‘হাতির শুঁড়’ নামে একটি প্রতিবাদী কবিতা স্বৈরাশাসক আইয়ুব খানকে বিকট বিদ্রƒপ করে লিখেছিলেন। এই কবিতাটি ১৯৫৮ সালে কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর এমনি করেই কবি শামসুর রাহমান ভীষণ প্রতিবাদী মন নিয়ে কলমের কালিকে শানিত করে নিভীর্কচিত্তে সব ভয়কে উপেক্ষা করে একে একে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ ‘প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদিতার বিরুদ্ধে কবিতা’ লিখেছেন। শুধু তাই নয়Ñ ১৯৯১ সালে স্বৈরাশাসনের পতনের পর তিনি ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’ও লেখেন। আসলে কবি হিসেবে তিনি প্রতিবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিকমূল্যোবোধে সাম্য শান্তিতে বিশ্বাসী একজন নিরেট পরিচ্ছন্ন মানুষ ছিলেন। একজন কবির সব কবিতায় সফলতার মুখ দেখে না, সব কবিতা মানুষের মুখে মুখে প্রচারও হয় না। কিছু কিছু কবিতা আছে যা মানুষকে, সমাজকে, কালকে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে রাখে, হৃদয় গভীরে তোলপাড় সৃষ্টি করে; মনন চেতনাকে জাগ্রত করে আন্দোলিত করে। তখন সেই কবিতা বা সেসব কবিতা চির অমরতার রূপলাভ করে থাকে। আর তাই যুগ যুগ ধরে কাল থেকে কালান্তরে যুগ থেকে যুগান্তরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে অমর কবিতাগুলো পাঠককে, মানুষকে প্রেরণা দেয়। কবি শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ বিখ্যাত কবিতাখানি ঠিক তেমনই একটি জ্যোতিমর্য় নান্দনিক অমর কবিতা। অমর কবিতা এই জন্যই বললাম যে, এই কবিতাটি কবিকে বতর্মানকালের সীমানা ছাড়িয়ে আগামী দিনে শতাব্দীতে সহস্রাব্দে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বাংলা সাহিত্যাকাশে জ্বলজ্বল করছে ও করবে এবং কবিকে বঁাচিয়ে রাখবে। কারণ, এই কবিতায় কবি স্বাধীনতা পাওয়ার জয়গান গেয়েছেন, স্বাধীনতা পেতে কতটা কষ্ট, যাতনা, ত্যাগ, বিসজর্ন দিতে হয়েছে এ দেশের সাধারণ মানুষের, কত মা তার সন্তানকে, কত বোন তার ভাইকে আর কত স্ত্রী তার প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়েছে; তারই জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন এবং সাবলীল শব্দে, ভাবে, ভাষায় কবিতার মূল বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন। কবি তাই বলেছেনÑ ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন? তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর গেলো হরিদাসীর। স্বাধীনতা, তোমার জন্যে / মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দঁাড়িয়ে আছে নড়বড়ে খঁুটি ধরে দগ্ধ ঘরের। নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা’ শামসুর রাহমানের অসংখ্য চমৎকার সুন্দর সুন্দর মধুময় নান্দনিকময় আর চেতনাময় কবিতার মধ্যে ‘আসাদের শাটর্’ কবিতাটি তার অনেক ভালো কবিতার মতো অনেক বেশি চেতনাধমীর্ এবং আবেগময়। কবি এই কবিতায় একজন দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাপ্রিয় প্রতিবাদী তরুণ বিপ্লবীর রক্তাক্ত শাটের্র বণর্না দিয়েছেন। এখানে আসাদের দেশপ্রেমের আত্মত্যাগের চেতনা ও মহিমা অন্ধকার রাতে পূণির্মার আলোর মতোন ফুটে উঠেছে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে আসাদের মৃত্যু হয়। লেখক আসাদের শাটের্ক মানবিকতার রূপে করে তুলেছেন অনেক রক্তের বিনিময়ে অজির্ত আমাদের প্রাণের পতাকা। আসাদের শাটর্ই যেন আজ আমাদের একটুকরো লাল-সবুজের পতাকা হয়ে উঠেছে। কবি তাই বলেছেনÑ ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিম্বা সূযাের্স্তর জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শাটর্/ উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায় বষির্য়সী জননী সে-শাটর্ উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে আমাদের দুবর্লতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখÐ বস্ত্র মানবিক; আসাদের শাটর্ আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’ কবি শামসুর রাহমান নিজে যেন কবি সত্তার স্বপ্নকে, চাওয়াকে, কল্পনাকে, তার চলার পথকে বিনিমার্ণ করেছেন ‘আলাদা এক রাজ্য’ নামের কবিতার পঙ্ক্তিতে। এই সমাজে শহরে একজন কবি একা, একাই তার দীঘর্ পথ পাড়ি দিতে হয়, কবির কল্পনা হাজার বাতির চাইতে জ্বলজ্বল। তবু কবি উশকোখুশকো লম্বা চুল নিয়ে কবিকে চলতে হয়, কবির ঠিকানা নেই আবার ঠিকানা আছে, কবিকে তাই পথ হারালে চলবে না, কবির হাত ধরে কেউ নিয়ে যাবে না; কবিকেই শান্তিময়ীর পরম ছেঁায়ায় সব ক্লান্তি থেকে মুক্তির পথ বের করতে হবে। এবং কবিকে কলমের কালিতে গড়ে তুলতে হবে এক রাজ্য। এই রাজ্যে কবিই রাজাধিরাজ। এখানে একজন কবির আকাশছেঁায়া কল্পনাশক্তিই মূলত প্রকাশ পেয়েছে। কবি শব্দে শব্দে বলছেনÑ ‘এই যে কবি ভর দুপুরে/ হন্তদন্ত হয়ে এখন যাচ্ছো কোথায় কোন ঠিকানা লক্ষ্য ক’রে? পথ হারালে যাবে কোথায় এ শহরে/ আলোবিহীন কোন অজানা আস্তানাতে? কেউ কি তোমার হাতটি ধ’রে নিয়ে যাবে/ শান্তিময়ী তারও কাছে, এখন তুমি এই শহরে রাজা বটে। হাতে একটি কলম পেলে আলাদা এক রাজ্য জানি উঠবে গড়ে’ ভাষার জন্য আত্মাহুতি পৃথিবীর ইতিহাসে একেবারে বিরল যে, বাঙালি জাতি নিজেদের জীবন দিয়েছিল। ভাষার জন্য ভালোবাসা শ্রদ্ধা এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা জাতি তার কথা বলার স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। রক্তের বিনিময়ে কেনা মায়ের ভাষা বিশ্বসভায় আজ স্থান করে নিয়েছে। আর আমাদের এই প্রিয় বাংলা ভাষার লাল টকটকে থোকা থোকা বণর্মালাকে অনেক হীন রাজনীতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে হয়েছে। এমনকি ভাষার বিরুদ্ধে বণর্মালার বিরুদ্ধে এবং বানান সংস্কারের অহেতুক অজুহাতে বাংলা ভাষার উপরে বণর্মালার উপরে চরম আঘাত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তৎকালীন ববর্র পাক-শাসকেরা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মযার্দায় আসীন করার লক্ষ্যে, এই ভাষাতে কথা বলার অধিকারে ৫২-এর ভাষা-আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের ওপর নিমর্ম আঘাত রাজপথে রক্ত ঝরানো সবকিছু দেখে জেনে আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখলেন তার অন্যতম কবিতা ‘বণর্মালা, আমার দুঃখিনী বণর্মালা’ কবিতাখানি। এই কবিতায় কবি ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ভাষার জন্য আন্দোলনকারীদের ওপর আঘাত, বাংলা বণর্মালার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চিত্রকে তুলে ধরেছেন। যে ভাষার বিরুদ্ধে এত ষড়যন্ত্র, এত ত্যাগ এবং আত্মাহুতি সে ভাষা যেন বড়ই দুঃখিনী। বাংলা দুঃখিনী মায়ের মতো বণর্মালাও বড় দুঃখিনী। কবি তাই বলছেন... ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায় মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সবর্দাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন তকার্লস্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি, অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন, ঘুরেছি কাননে তা নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে। তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার? উনিশ শো’ বাহান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি / বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,/ এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস! তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,/ বণর্মালা, আমার দুঃখিনী বণর্মালা। পৃথিবীর মানচিত্রে যত দেশ আছে এবং জাতি বসবাস করে সব দেশই স্বাধীনতার জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছে দেশ স্বাধীন করেছে এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দঁাড়ানোর শক্তি অজর্ন করেছে। স্বাধীনতা পরম পাওয়া, এই স্বাধীনতা এমনি এমনি আসে না, বুকের রক্ত ঢেলে জীবন দিয়ে লড়াই সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বপ্নের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। কবি শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার মধ্যে স্বাধীনতা মানে যে মুক্ত পরাধীনতার শিকল থেকে বেরিয়ে আসা এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা আমাদের প্রিয় সাধের স্বাধীনতা দেখতে কেমন, কেমন তার রূপ, রস, গন্ধ-ছন্দ এবং প্রেরণাদায়ক ও আবেগময় তার প্রতিচিত্র এই কবিতার মধ্যে কবি এঁকেছেন। এই কবিতায় কবি মহান স্বাধীনতাকে রবিঠাকুরের অজর কবিতা কবি নজরুলের ঝঁাকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ পাখিদের গান আর পিতার জায়নামাজ মায়ের শাড়ির কঁাপন বোনের মেহেদির রং বলে সম্বোধন করেছেন। স্বাধীনতাকে তিনি ইচ্ছেমতো কবিতা লেখার কবিতার খাতাও বলেছেন। মূলত, ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা পাঠ করলে কবিতাটির পরতে পরতে সৌন্দযর্ মুগ্ধকর ও নান্দনিকতার রূপ দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া স্বাধীনতা যে কতটা একান্তে আপন তাও এখানে তুলে ধরা হয়েছে। কবি কবিতায় বলেছেনÑ ‘স্বাধীনতা তুমি/ রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুলের ঝঁাকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কঁাপা- স্বাধীনতা তুমি/ পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন স্বাধীনতা তুমি/ উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কঁাপন স্বাধীনতা তুমি/ বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ স্বাধীনতা তুমি / বাগানের ঘর, কোকিলের গান বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা/ যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’ শামসুর রাহমানের কবিতায় বিশেষ করে গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নগরজীবনের নাগরিক সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না আন্দোলন-সংগ্রাম জয়-পরাজয়ের বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া তার কবিতা ও গানে স্বাধীনতা দেশপ্রেম মানবতা এবং মানবিক মূল্যবোধের চেতনা দারুণভাবে উঠে এসেছে। এর হেতু হিসেবে বলা যেতে পারে যে, শামসুর রাহমান তার ব্যক্তি জীবনে মানবতা রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বপূণর্ ভ‚মিকা পালন করেছেন। তিনি একজন সত্যিকারের সমাজ সচেতন মানবিক কবি। তার আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’ বইটি পাঠ করলে সেখানে দেখতে পাই যে, শুধু জীবনের ঘটনায় মুখ্য হয়ে ওঠেনি; এখানে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি দেশ, যুদ্ধ, রাজনীতি, অথর্নীতি, ইতিহাস এবং যাপিতজীবন চলার পথে সব দেখাকে জানাকে সত্যের আলোয় উপস্থাপন করেছেন। আর এসব তার কাব্যে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে তার কবিতা কালকে অতিক্রম করে বতর্মানকে পেরিয়ে আগামী সুন্দর সবুজ ভবিষ্যতের গতিময়তাকে নিবিড় করে ছুঁয়েছে। তার কবিতাপাঠে নতুন করে বঁাচতে শেখায়, বিশ্বাসের জায়গাকে বদ্ধমূল করে তোলে আর বিবেক চেতনাকে শানিত করে। তার কবিতার বইগুলো পাঠে, পাঠককে একেবারে নতুন এক ভুবনে ভাবনার জগতে অন্য রূপ-রসের স্রোতে টেনে নিয়ে যায় বহমান নদীর মতো। কবি তার কাব্যগ্রন্থে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শিল্পের বিচারে অনেক বেশি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। পদক (পুরস্কার) : আধুনিক বাংলা ভাষার এই মহান কবি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা কাব্যে তার বৈচিত্র্যময় অনবদ্য সৃজনশীল অবদান রাখার জন্য তিনি সম্মানসূচক হিসেবে জাতীয় ও আন্তজাির্তক পযাের্য় বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরস্কার, যেমনÑ ‘স্বাধীনতা পদক’ ‘আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), ‘কবি জীবনানন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), ‘একুশে পদক (১৯৭৭), ‘মিৎসুবিশি পদক (জাপান কতৃর্ক-১৯৯২), ‘আনন্দ পুরস্কার (ভারত কতৃর্ক-১৯৯৪) ইত্যাদিসহ অনেক পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি ভারতের যাদবপুর ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অতীব সম্মানিত ডি লিট উপাধিও অজর্ন করেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ : কবি শামসুর রাহমানের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ প্রায় একশত। তিনি কবিতা-৬৬, ছড়া-১, উপন্যাস-৪, প্রবন্ধ-১, এলাটিং বেলাটিং-৮, আত্মজীবনী-১ আর অনুবাদ-৬টির মতো বই রচনা করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ- ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (কবিতা), ‘কৃষ্ণপক্ষে পূণির্মার দিকে (কবিতা/২০০৪), ‘ভাঙাচোরা চঁাদ মুখ কালো করে ধুকছে’ ‘কালের ধুলোয় লেখা (আত্মজীবনী/২০০৪), ‘ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো’ ‘গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহŸান (কবিতা/২০০৫), ‘নিজবাসভ‚মে (কবিতা/১৯৭০), ‘মাতাল ঋত্বিক (কবিতা/১৯৮৭), ‘বিধ্বস্ত নিলীমা’ ‘টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে (কবিতা/১৯৮৮), ‘অক্টোপাস (উপন্যাস/২০০৬), ‘অদ্ভুত অঁাধার এক’ ‘হ্যামলেট’ ‘বন্দি শিবির থেকে (কবিতা), ‘প্রথম গান থেকে বন্দি শিবির’ ‘হরিণের হাড়’ ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’ ‘মঞ্চের মাঝখানে’ ‘স্মৃতির শহরে’ ‘কবিতা এক ধরনের আশ্রয়’ ‘মেঘলোকে মনোজ নিবাস’ ‘ইকারুসের আকাশ’ ‘গোলাপ ফোটে খুকির হাতে’ ‘হো চি মিনের কবিতা (অনুবাদ), ‘একান্ত ভাবনা’ ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ ‘শুনি হৃদয়ের ধ্বনি’ ‘রৌদ্র করোটিতে’ ‘এলাটিং বেলাটিং’ ‘হৃদপদ্মে জ্যোৎ¯œা দোলে’ ‘বস্মস্তপে গোলাপের হাসি’ ‘ছড়াসমগ্র’ ‘হীরার পাখির গান’ ‘প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা’ ‘নিবাির্চত সেরা সাত’ ‘রাজনৈতিক কবিতা’...ইত্যাদি। উল্লিখিত এসব বইয়ের ভেতরে বিশেষ করে কবিতার বইগুলো অত্যন্ত সুখপাঠ্য। জন্ম ও মৃত্যু : বিগত ব্রিটিশ শাসনামলে শেষের দিকে ১৯২৯ সালে ২৩ অক্টোবর বুধবার সকাল ১০ ঘটিকার সময়ে পুরনো ঢাকার ৪৬ নাম্বার মাহুতটুলির বাড়িতে পিতা: মোখলেসুর রহমান চৌধুরী আর মাতা আমেনা খাতুনের কোল আলোকিত করে বাংলা কাব্যের অন্যতম কবিতার জাদুকর কবি শামসুর রাহমান জন্মগ্রহণ করেন। যদিও কবির পৈতৃক নিবাস ছিল নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার মেঘনাপাড়ের পাড়াতলী গ্রাম। সংসারে ১০ ভাই-বোনের মধ্যে শামসুর রাহমান জ্যেষ্ঠ ছিলেন। কবি শামসুর রাহমান গত ১৭ আগস্ট ২০০৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ফলে আমাদের এই প্রিয় কবি তার প্রিয় কবিতার খাতা পড়ার টেবিল বই ফেলে কবিতা ফেলে না ফেরার দেশে চলে যান। কবির ১২তম প্রয়াণ দিবসে কবিকে হৃদয়ের গভীরে স্মরণ করছি। হে বাংলা ভাষার শব্দশ্রমিক, হে কবি তোমার জয় হোক, তোমার কবিতার জয় হোক...