তরুণদের তারুণ্য যে কোনো দেশের প্রধান সম্পদ হতে পারে। আজকের তরুণরাই আগামী বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। যত যোগ্য ও দক্ষ তরুণ তৈরি হবে ততই আগামীর বাংলাদেশ তথা বিশ্ব সুন্দর হয়ে গড়ে উঠবে। কিন্তু স্বদেশের দিকে তাকালে আমরা অনেক সময় হতাশ হই, নানা কারণে দক্ষতা ও যোগ্যতার বদলে তরুণরা ডুবছে নেশায় আর একাডেমিক শিক্ষিত বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে তারা।
১৪ থেকে ৩০ বয়সটা তারুণ্যের, এই সময়টা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ সময়েই ব্যক্তি জীবনের সবচেয়ে উর্বর ভাবনাগুলো আসে। আর তার উপর ভর করে দেশের নানা সমস্যা-সম্ভাবনার কথা লেখে তারা। লেখালেখি করে জেমস পিটারসন, জন গ্রিনের বা জেফ কিনের মতো লেখকরা নিজের দেশের সুনাম সুখ্যাতি বাড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে লেখা পেশা হিসেবে নেওয়াটা যেন একটা দুঃসাহসিক কাজ। কারণ একটাই তাদের পরিশ্রম অনুযায়ী তেমন কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয় না যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। বিশেষত তরুণ লেখকদের প্রতি যথেষ্ট যত্ন ও উৎসাহের অভাবে বহু তরুণ লেখক অকালে ঝরে যাচ্ছে।
তরুণদের মধ্যে এখন অনেকেই খুব ভালো লিখছেন। তাদের লেখাতে বৈচিত্র্য পাওয়া যাচ্ছে। আসারই কথা কেননা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন আসে। তারা তাদের লেখাকে শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদের অনুসরণ করছে না। নিজস্ব ভঙ্গিতে লিখছে তারা। আমরা দেখি, রবীন্দ্র-নজরুল যেমন দুজনে দুই রকমের কবিতা লিখেছেন। বুদ্ধদেব বসু, অমীয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে- তারাও তাদের মতো করে আলাদা আলাদা কবিতা লিখেছেন। যে লেখাটি আগে কেউ লেখেনি সেরকম লেখাতেই আসবে সৃজনশীলতা। একজন লেখকের লেখার নিজস্ব স্বকীয়তা থাকবে এটাই হওয়ার কথা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি আমরা। এই স্বাধীনতার বীজ নিহিত আছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। আর এই আন্দোলনের মূলে ছিল একদল লেখক গোষ্ঠী। যারা তাদের জীবন বাজি রেখে লিখে গিয়েছিল স্বদেশের পক্ষে। যাদের কারণে দেশ পেয়েছি, স্বাধীনতা পেয়েছি, পর্দার আড়ালে থাকা সেই জহির রায়হান, শহীদুলস্নাহ কায়সারদের আমরা শুধু জন্ম আর মৃতু্যর দিনই স্মরণ করছি। আর তাতেই বোঝা যায় আমাদের চেয়ে অকৃতজ্ঞ জাতি আর কেউ নেই। আমাদের তাদের রেখে যাওয়া জীবন-দর্শন তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। আর যারা চর্চা করছে তাদেরও যত্ন নিতে হবে। কারণ তরুণরাই পারবে সমকালীন মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের নির্ভুল চিত্রায়ন করতে। বর্তমানে তরুণ লেখকদের মধ্যে সাদাত হোসাইন আর কিঙ্কররা পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছে যা আশার আলো দেখায়। কিন্তু বড় বিষয় হলো- তাদের পরিচর্যা করার মানসিকতা দেশের মানুষের থাকতে হবে। নয়তো জহির-কায়সার- হুমায়ুন আহমেদহীন এ দেশের লেখক শূন্যতা আজীবন পূরণ হবে না।
একটা জরিপে উঠে এসেছে বাংলাদেশে সারা বছর যেসব বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ ভাগই তরুণ এবং নবীন লেখকদের?বিশেষ করে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তরুণ লেখকদের বই প্রকাশের আগ্রহই বেশি- শুধু প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা ছাপলে তো তা বিক্রি এমনিতেই হবে, তাহলে প্রকাশকের কৃতিত্ব কোথায়? মোটকথা তরুণদের লেখার জায়গাটা করে দিতে হবে। তাদের নিজস্বতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাতে ভিন্ন স্বাদ পাবে পাঠকরা। চিন্তায় আসবে নতুনত্ব, বর্তমান তরুণ লেখকদের প্রচলিত গল্প-উপন্যাস আর কবিতার যে ঐতিহ্যগত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নন-ফিকশন ধারার দিকে ঝুঁকছে এটা আসলেই ইতিবাচক।
২০০৮ সাল থেকে তরুণ কবি ও লেখকদের জন্য কালি ও কলম পুরস্কারটি প্রদান করা হচ্ছে যা। শিল্প ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা কালি ও কলমের মতো আরও পুরস্কার চালু করা সময়ের দাবি। বইমেলাতেও নিয়মিত গুরুত্ব পাক তরুণ লেখকরা।
লেখালেখির জন্য যে বিস্তর জ্ঞানের দরকার হয় তার জন্য চাই মুক্ত মন ও জ্ঞানচর্চার সুযোগ। তবে আমরা দেখতে পাই খোদ রাজধানীতেই বড় বড় ২৩টি পাঠাগার থাকলেও তা নেমে এখন ৭টিতে এসেছে, অন্য বিভাগীয় শহরের কি অবস্থা তা অনুমানই করা যায়।
নতুন প্রজন্মের যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করছে তারা অনুবাদের দিকে ঝুঁকলে হয়তো আমাদের দেশের সাহিত্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেতে পারে। আমাদের অনেক বড় বড় লেখক আছেন। বিশ্বমানের অনেক লেখাও হয়েছে। কিছু বই অনুবাদও হয়েছে। শুধু অনুবাদের ভাষার দুর্বলতার কারণে সেটা দেশের বাইরে সমাদ্রিত হচ্ছে না।
এখনকার মোবাইল-ফোন, ফেসবুক, ইউটিউবে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হওয়ার চেয়ে, দেশমাতৃকার নানা সমস্যা-সমাধান ও সম্ভাবনা নিয়ে লেখা এসব তরুণদের গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। নইলে সময়ের আবর্তনে তারাও নিরুৎসাহিত হয়ে ঝরে পড়বে। তাদের সুপ্ত প্রতিভা যেন দেশমাতৃকার সেবায় কাজে লাগে সে বিষয়েই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হবে।