আফ্রিকার ছোটগল্প সরকার মাসুদ

প্রকাশ | ১৬ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
গল্প মানুষকে চিরকাল আনন্দ দিয়েছে। আর কেবল আনন্দ নয়, দিয়েছে ভাবমগ্নতাও। গল্পের এমন ক্ষমতার কথাও আমরা জানি- যা মানুষের প্রাণরক্ষা করতে পেরেছিল। 'আরব্য রজনী'র শেহেরজাদী ও বাদশা শাহরিয়ার গল্প কে না জানেন? শেহেরজাদী- যে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিল শেষ পর্যন্ত সেতো ওই গল্পের জাদুর কারণেই। মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্তা সেই নারী এমন সব চাঞ্চল্যকর কাহিনি রাজাকে শোনাতেন এবং এমন জায়গায় এসে থামতেন যে, শাহরিয়ারকে পরবর্তী অংশ শুনবার জন্য আগামী রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হতো। রাতের পর রাত কেটেছে এভাবেই। শেহেরজাদীর গল্প বলার কায়দায় বাদশা এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন যে একপর্যায়ে মেয়েটির প্রতি তিনি মমত্ব অনুভব করেন। বেঁচে যায় একটি নারীর প্রাণ। তাহলে কি এটাই প্রমাণিত হলো না যে, গল্পের জাদু একটা বিরাট ব্যাপার! বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক গ্রামীণসমাজে এক সময় পুঁথিপাঠের প্রচলন ছিল। মানুষ রাত জেগে পুঁথি পাঠ শুনতো কেন? কারণ পুঁথির ভেতর গল্প থাকতো। আর ওই পাঠের ছিল দৃষ্টিহৃদয়নন্দন ভঙ্গি। গল্প লিখিতরূপ পাওয়ারও বহুকাল পরে এর শিল্প-অশিল্প নিয়ে ভেবেছেন লেখকরা। আদিকালের গল্পে কী শিল্প ছিল না? অবশ্যই ছিল। সেই শিল্প লেখকের বলবার ওস্তাদির গুণে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছিল। সেজন্য ওইসব গল্প-কাহিনী সহজবোধ্যও ছিল। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ছোটগল্প আর অত সহজবোধ্য থাকলো না। কেননা, ওই যে বললাম, আধুনিককালে সাহিত্যের নন্দন নিয়ে লেখকরা আলাদাভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন। শিল্পবিপস্নবের সঙ্গে উপন্যাসের বিকাশের সম্পর্ক নিবিড়। উপন্যাসের শাখা হিসেবে ছোটগল্পের বেলাতেও এ কথা প্রযোজ্য। কথাসাহিত্য বিকশিত হতে হতে আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, আধুনিক উপন্যাসের একটা বড় অংশই হয়ে উঠেছে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, প্রেম-অপ্রেম, নিস্পৃহতা, পলায়নপরতা ইত্যাদির আধার। এটা মুখ্যত ঘটেছে ইউরোপ-আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়। জাপান, চীন, কোরিয়ার মতো উন্নত এশীয় দেশগুলোতেও তা-ই হয়েছে। সেদিক থেকে আফ্রিকার গল্প-উপন্যাস সম্পূর্ণ আলাদা। এই সাহিত্য উপজীব্য করেছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সংগ্রামশীলতা। সব ধরনের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। নামমাত্র স্বাধীন দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী চক্র নেতার নামে যেসব গুন্ডা-পান্ডা পুষছে তাদের অকথ্য নিপীড়নের চিত্র ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সিংহভাগ জায়গা জুড়ে আছে আফ্রিকার কথাসাহিত্যে। সুতরাং মোটা দাগে ইউরোপ-আমেরিকার কথাসাহিত্য যদি হয় ব্যক্তিবিপর্যয়ের গল্প- তাহলে আফ্রিকার কথাসাহিত্য হচ্ছে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে রচিত সাহিত্য। সাদা চামড়ার অধিকারী কোনো লেখক, যতই শক্তিমান হোন, কালো মানুষদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন ও অবমাননার সঠিক, পূর্ণাঙ্গ চিত্র কখনোই তুলে ধরতে পারবেন না। নাডিন গার্ডিমার বা জি.এম. কোয়েৎজি-রা কিছুটা ব্যতিক্রম। গার্ডিমার গবহ ড়ভ ঔঁষু উপন্যাসে 'কালো'দের বিদ্রোহের পর একটি সুশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ পরিবারের মানুষের যে অশুভ পরিণতি দেখিয়েছেন বা উরংমৎধপব উপন্যাসে কোয়েৎজি কালো মানুষের দ্বারা ধর্ষিতা এক শ্বেতাঙ্গ নারী ও তার অধ্যাপক পিতার মানসিক অবস্থার যে ছবি এঁকেছেন তা আমাদের ভালো লাগতে পারে। একজন দীক্ষিত আধুনিক পাঠক, যদি আফ্রিকান হন, ওইসব গ্রন্থে প্রযুক্ত শিল্পিতা স্বীকার করে নিয়েও মনে-মনে হাসবেন। কেননা তার মনে হবে, এ ধরনের সাহিত্য নকর্মগুলো গরু মেরে জুতা দানের সমতুল। অতএব, আমাদের যন্ত্রণা-বেদনা-বঞ্চনার গল্প অন্যরা ভালো করে লিখতেই পারবে না, তা লিখতে হবে আমাদেরকেই- এমন দায়িত্ববোধ থেকেই আফ্রিকার স্থানীয় লেখকরা কলম হাতে নিয়েছিলেন। আর সেই পালে জোর হাওয়া লাগিয়েছেন চিনুয়া আচেবে, বেন ওকরি, ওলে সোয়েঙকা, নগুগি ওয়া থিয়োঙ, আমোস টুটুওলা, বেসি হেড, নুরুদ্দিন ফারাহ, আমা আতা আইডুর মতো বিশ্ববরেণ্য লেখকবৃন্দ। বিশাল মহাদেশ আফ্রিকা। তার এক একটি দেশও কম বড় নয়। শত শত মাইলব্যাপী বিস্তৃত বন-জঙ্গল, মরুভূমি, সমতল ভূমির চড়াই-উতরাই সেসব দেশের ভূ-দৃশ্যে যেমন অশেষ বৈচিত্র্য এনেছে, তেমনি বিচিত্র সব জনগোষ্ঠী এবং অসংখ্য গোত্র-সম্প্রদায়- তাদের রীতিনীতি, পালা-পার্বণ, এক কথায় জীবনযাপনের ধরন তাদের সম্পূর্ণ পৃথক করেছে বিশ্বের অন্য সমস্ত অঞ্চল থেকে। আফ্রিকার বহু দেশ এখনো ভীষণ গরিব। শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত তারা। ফলে তারা ভাবে তাদের দরিদ্রদশা ঈশ্বরেরই ইচ্ছার প্রতিফলন এবং এটাই তাদের নিয়তি। কিন্তু এ অবস্থা যে সুবিধাবাদী মানুষের সৃষ্ট সেটা বুঝার ক্ষমতাও তাদের ছিল না সুদীর্ঘকাল। অল্প কিছু আলোকপ্রাপ্ত, সাহসী, সহমর্মী মানুষ তাদের দুর্দশারগুলোর কারণ ও তা থেকে পরিত্রাণের পথ বাতলে দিয়েছে। এর পরিমাণ সংঘর্ষ এবং সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট তথা পালিত গুন্ডাদের সঙ্গে বিবাদ বাধে প্রথমে তাদেরই। এসব বিষয়- যে কেবল চিনুয়া বা নগুগির উপন্যাসেই ধরা পড়েছে- তা নয়, তাদের এবং অন্য অনেক আফ্রিকার লেখকের ছোটগল্পেও উঠে এসেছে। আফ্রিকার এগারোটি দেশের বারোজন লেখকের মোট ছাব্বিশটি গল্প পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, প্রায় সবার লেখাতেই উপরে উলিস্নখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান। বুচি এমেশেতা, কিউই আরমাহ বা অ্যালেন মাবানকউয়ের মতো কতিপয় লেখক ব্যক্তির সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়েছেন কখনো কখনো। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ আফ্রিকার ছোটগল্পে উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন আসে। পশ্চিমের কিছু কলাকৌশল প্রযুক্তি হলেও এসব গল্পে স্থানীয় লোককাহিনি ও চিরায়ত অনেক কেচ্ছার পুনর্নির্মাণ লক্ষ্য করা যায়। লোকগল্পে অবশ্য চরিত্রের চেয়ে ঘটনা বেশি গুরুত্ব পায়, অন্যদিকে আধুনিক ছোটগল্পে চরিত্রের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আখ্যানের গাঁথুনিও মজবুত। ছোট গল্পকাররা যেসব থিমকে বারবার লেখায় এনেছেন সেগুলো হচ্ছে ঔপনিবেশিকতা, ছদ্মবেশী নয়া ঔপনিবেশিকতা ও সংশ্লিষ্ট রাজনীতি, অনিশ্চয়তাবোধ ও তা থেকে জাত উদ্বেগ, নারী-পুরুষের আত্মপরিচয়, গ্রাম ও শহরের ভেতরকার দ্বন্দ্ব, প্রাত্যহিক জীবনের চালচিত্র প্রভৃতি। সিয়েরালিয়নের প্রধান এক লেখক আবিওসেহ নিকোলের ঞযব ঋরৎবসধহ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে যে মানসদোদুল্যমানতা আমরা লক্ষ্য করি তা কিন্তু ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্ট। ওই মানসচাঞ্চলের শেষ কোথায় তা আমরা জানি না। জানেন না সম্ভবত লেখকও। প্রচন্ড স্বাতন্ত্রবাদী লেখক নগুগি ওয়াথিয়োঙ যিনি গোড়ার দিকে ইংরেজিতে লিখলেও পরে মাতৃভাষায় লিখতে শুরু করেন। তিনি মনে করেন ইংরেজিতে লিখলে নিজের জাতিসত্তা ও বর্ণাঢ্য সংগ্রামী আফ্রিকার জীবনযাত্রার বিচিত্র বেদনাময় রূপ যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন না। খরা, শস্যহীনতা, অনাহার-অপুষ্টির ভয়াবহ চিত্র এঁকেছেন এই লেখক তার গল্প-উপন্যাসে। খরা আক্রান্ত গ্রামের অনুর্বর জমি নগুগির ভাষায় 'কুমিরের পিঠের মতো'। তার গল্পে জীবিকার খোঁজে মানুষকে শহরের দিকে চলে যেতে দেখি। গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এই যে তারা চলেছে, কোন স্বর্গের দিকে যাচ্ছে তারা? নগুগি প্রশ্ন তুলেছেন, যেদিকে তারা যাচ্ছে সেই শহরগুলোও সমস্যাভারাক্রান্ত। বস্তির অস্বাস্থ্যকর মানবেতর জীবন তাদের কী দেবে? চিনুয়া আচেবের এরৎষং ধঃ ধিৎ ধহফ ড়ঃযবৎ ংঃড়ৎরবং এক অসাধারণ গ্রন্থ। 'ঋণদাত্রীর ক্রোধ' গল্পে লেখক প্রজাপালকের ছদ্মবেশধারী রাষ্ট্রের ভন্ডামির কর্কষ ছবি এঁকেছেন দক্ষ হাতে। জীবিকা সংকটের কারণে তুচ্ছ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ এবং সেজন্য তাদের মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে এসবও বলেছেন তিনি আরেকটি গল্পে; দেখতে পাই নারীদের প্রতিবাদী চেহারা। পুরুষের বিকল্প হিসেবে নয় বরং তাদের কাঁধের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে নারীরা যুদ্ধে অবতীর্ণ। এমনও ঘটেছে যে, লড়াকু পুরুষরা যেখানে আর এগোতে পারছে না নারীরা সেখান থেকেই যাত্রা আরম্ভ করেছে নতুন উদ্যোমে। মনে পড়ছে ঞযব ওাড়ৎু উধহপবৎ নামের একটি ছোটগল্প। সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য তার পূজারী ও চর্চকারী এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে কীভাবে উৎপীড়কে রূপান্তরিত করে সেটাই এই গল্পে দেখিয়েছেন সাইপ্রিয়ান একোয়েনসি। এখানে এক অল্প বয়সি নৃত্যশিল্পী স্থানীয় গোত্রপ্রধানের অন্যায়ের বিরোধিতা করে, ফলে সে হুমকির সম্মুখীন হয়; শত্রম্নপক্ষের রক্তচক্ষু ও হুমকি উপেক্ষা করেও ওই শিল্পী ন্যায় ও প্রগতির পথেই থাকার লড়াই অব্যাহত রাখে। কীভাবে রাখে সেটাই এই গল্পের মূল আকর্ষণ। বিষয়বস্তুর বিচারে আফ্রিকার প্রতিবাদী ঘরানার এসব গল্পে বৈচিত্র্য কম থাকলেও তার উপস্থাপন রীতিতে লেখক ভেদে, অনেক বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়। সেজন্য মিশর বা মরক্কোর ছোটগল্প আর সুদান বা ইথিওপিয়ার ছোটগল্প এক রকম নয়। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও সুস্পষ্ট। ভাষাকৌশল ও শিল্পিতার দিক থেকেও পিছিয়ে নেই আফ্রিকার অগ্রণী কথাকোবিদরা।