শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিঃশ্বাসের নিঃশব্দ কোলাহলে সিহাব সাকিব ঈশান

নতুনধারা
  ০৭ মে ২০২১, ০০:০০

চার তালায় বি-বস্নকের ৪২১ নাম্বার রুমটা জিয়াদের। জানালার পাশেই বিছানা, সেখানে শুয়ে শুয়ে মার্শাল ম্যাকলুহানের ্তুঞযব এঁঃবহনবৎম এধষধীু : ঞযব গধশরহম ড়ভ ঞুঢ়ড়মৎধঢ়যরপ গধহ্থ বইটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে আর মনে মনে হিসাব কষছে। '৬০-এর দশকে বিশ্বগ্রাম বা গেস্নাবাল ভিলেজের ধারণাটি আসল আর তারপর থেকেই সম্ভবত মানুষের আর গ্রামের দূরত্বটা সমানুপাতিক হারে বাড়তে শুরু করে। না, এমনটা অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হবে না। আশি-নব্বইয়ের দশকেও এ দেশের মানুষের সঙ্গে গ্রামের একটা মাতৃসুলভ সম্পর্ক ছিল। নিজের চোখেই ছোটবেলায় সে গ্রামের পরিবেশটা দেখেছে। তখন তার বয়স কত আর হবে? ৮ কি ৯ বছর হবে। তখনো তো এতটা কৃত্রিমতা ছিল না। হঁ্যা, তার শহরটাও তখন বেশ নির্মল ছিল, কোলাহলের এত আধিক্য কিংবা মানুষের এত অযাচিত ব্যস্ততাটা ছিল না। বিকালে রাস্তায় হাঁটতে বের হলে চাইলেই ফুসফুস ভরে এক বুক বিশুদ্ধ বাতাস নেয়া যেত। আশপাশে কেমন একটা শান্তির সবুজ ছিল, এখন সেখানে কেবলই কিছু সুবিশাল অট্টালিকা, নিষ্প্রাণ ইমারত। এসব উঁচু উঁচু অট্টালিকার ভিড়ে দাঁড়িয়ে জিয়াদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কেবলই ভাবে, 'গেস্নাবাল ভিলেজ' এ গেস্নাবালাইজেশনটাই কেবল হয়েছে, আর ভিলেজগুলো আস্তাকুঁড়ে কেবল মরেছে।

জীবনটা যখন খুব দুর্বিষহ লাগে, মনে হয় এসব ব্যস্ততা আর রাতের অন্ধকারে গাড়ির হর্নে জীবনের কোনো স্বাদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখনই জীবনের জন্য জীবনের দিকে ফিরে আসতে জিয়াদ গ্রামের দিকে ছুটে। প্রত্যন্ত এলাকা না বলা গেলেও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য একটা জার্নি করে গ্রামে পৌঁছাতে কিছুটা বেগ তো পেতেই হয়। মহাসড়ক থেকে নেমে গেছে আধকাঁচা আধপাকা একটা রাস্তা, মিনিট বিশেক সে রাস্তা ধরে এগোলেই একটা বাঁক। যেখানে বাঁক নিয়ে রাস্তাটা গ্রামের দিকে ঢুকে গেছে সেখানে এখনো অনেকটা জায়গা নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে একটা সুবিশাল বট গাছ। বয়েসের ভারে ক্লান্ত মনে হলেও গাছটি যেন উৎফুলস্ন কণ্ঠে ঘোষণা দিচ্ছে, 'আমার প্রাচীনতাই তোমার জন্য আমার উপহার, এখান থেকে শান্তির শুরু, শ্রান্তির রাজ্যে তোমাকে স্বাগতম'।

এক্কেবারে গ্রাম বলতে যা বোঝায়, জিয়াদের গ্রামটা ঠিক তেমনই। এই যুগে এসেও বিদু্যতের ছোঁয়া লাগেনি। ঘরগুলোও ইমারতের আশীর্বাদসিক্ত হয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে উঠেনি এখনো, বরঞ্চ মাটির দেয়াল আর ছনের চালের ঘরগুলোকেও যেন বেশ জীবন্তই মনে হয়। বৃষ্টি এলে যার চাল বেয়ে পানি ঢুকে জানান দেয়, 'এসো, যুদ্ধ কর বন্ধু, জীবনযুদ্ধ ছাড়া যে জীবন সে তো জীবন্ত নয়'।

এখনো সেখানে বর্ষা এলে কালো মেঘে ছেঁয়ে যাওয়া আকাশের সবটা দেখা যায় বিনা বাধায়, কান পাতলে শোনা যায় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পুকুরের জলে একটা অদ্ভুত ছন্দে মিশে যাচ্ছে। পথগুলো যে কাদায় পিচ্ছিল হয়ে যায়, সে পথেরও একটা নিজস্বতা আছে, নেই সেখানে কোনো কৃত্রিমতা।

জিয়াদের ঘরটা উত্তরমুখী। জানালা খুলে দিলেই কিছুটা মেঠোপথ, তার ধারে গোটা কয়েক আম আর জাম গাছের সারি, এর ঠিক পরেই দিগন্তে যেখানে আকাশ মিশে গেছে সে পর্যন্ত কেবল ফসলি সবুজ আর সবুজ। জানালাটা খোলা মাত্রই স্বাগত জানায় সেই দিগন্ত পাড়ি দেয়া বিশুদ্ধ বাতাস। আহা! এই তো বুঝি জীবন, যেখানে বাতাসে নেই সালফার আর কার্বন কিংবা সিসার নীল বিষ কোথাও। এখানেই বোধহয় কেবল অনুভব করা যায়, 'সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন।

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।'

জিয়াদের কাছে তার গ্রামটা বনলতা সেনের মতোই। চারিদিকে জীবনের সমুদ্র যখন সফেন হয়ে যায়, তাকে দুদন্ড শান্তি কেবল এই গ্রামটাই দিতে পারে।

সময়টা মোটেই ভালো যাচ্ছিল না জিয়াদের। বন্ধুদের সঙ্গে অগত্যা দূরত্বটা বাড়ছিল বেশ আগে থেকেই। এটাই নিয়ম। প্রথম বর্ষের উচ্ছ্বাস আর আবেগ ধীরে ধীরে উবে যাবে, সবাই নিজে নিজে ব্যস্ত হয়ে যে যার পথের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাবে। তার বন্ধবৃত্তের মধ্যে সে একাই সম্ভবত কোনো দিকেই এগোচ্ছে না। চাইলেও আয়োজন করে মন খুলে আড্ডা দেয়া যায় না সবার সঙ্গে, সবাই ব্যস্ত এখন। ভবিষ্যৎ নিয়ে জিয়াদের পরিকল্পনা গুছানো ছিল খুব এমন না, তবে সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল অনার্স জীবনের শেষ পরীক্ষাটা দিয়েই উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরের দেশে যাবে। তার জন্যই পাঠ্যসূচির বাইরে বই পত্র পড়ছিল মাস চারেক ধরেই। সেই স্বপ্নে হঠাৎ ছেঁদ পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সেমিস্টারে এসে আগের সেমিস্টার ফাইনালের ফলাফল হাতে পেয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো অকৃতকার্য হওয়ার স্বাদ পেল জিয়াদ, প্রথমবারের সবকিছুর স্বাদ যে খুব সুখকর হয় না তখনই বুঝতে পেরেছিল সে। বন্ধুরা সবাই পাস করে বের হয়ে যাবে, দেশ-বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ছোটাছুটি করবে আর তাকে একলা ঘরে মুখ গুঁজে বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে। এর চেয়ে বোধহয় মরে যাওয়ায় ভালো ছিল। বাসায়ই বা কী বলবে কোনো উত্তর আসে না ভেতর থেকে। কেবল একরাশ হতাশা ঝেঁকে বসে চারদিক অন্ধকার করে। মানসিকভাবে প্রচন্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জিয়াদ। কোনো সমীকরণ যখন মিলছে না আর, তখন মনে মনে সে ঠিক করল আশপাশের বাকি ১০ জনের মতোই রাতভর সিগারেটের প্যাকেট শেষ করে করে গস্নানিটা ভুলে নেবে সে। সিগারেটের সাদা ধোঁয়ায় সব মিশে যাবে বাতাসে। বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেট নিয়ে যখন তর্ক হতো তখন বন্ধুরা প্রায়ই বলতো সিগারেট খেলে নাকি ' স্ট্রেস রিলিফ পাওয়া যায়। ওদের কথা মতে, 'নিকোটিন ওয়ার্কস লাইক এ ম্যাজিক'। জিয়াদ এবার সিদ্ধান্ত নিল আর কোনো তর্ক নয়, যথেষ্ট হয়েছে জীবনে। আজ সেও ম্যাজিক স্টিক দিয়ে তার বিরক্তি, ক্লান্তি, অবসাদ আর উদ্বিগ্নতা সব্বাইকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেবে। যেই ভাবনা সেই কাজ।

হলের নিচতলায় ছোট্ট একটা দোকান ঘরের মতো ছিল, সেখান থেকে এক প্যাকেট সিগারেটও কিনে নিল সে। জিয়াদ সিগারেট কিনতে এসেছে দেখে দোকানিও অবাক। কিছুক্ষণ পরাজিত সৈনিকের মতো চুপসে যাওয়া জিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন তিনি। আটসাঁট মুখভঙ্গিতে দিয়াশলাই আর সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়েই কোনো দিকে না তাকিয়ে রুমের দিকে হন হন করে ছুটে যায়। কোরিডোর থেকে বাঁক নিয়েই সোজা নিজের কক্ষে। পেছনের বারান্দাটায় একটা চেয়ার পাতা আছে, সেখানে বসে উদাস হয়ে হাতে প্যাকেটটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আনমনে। ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ ছাড়া আশপাশে কোনো শব্দ নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা ৬টা বেজে ১৩ মিনিট। খানিক পর একটা শলাকা বের করে নিল হাতে। মুখে নিয়ে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে মুখের কাছে নিতেই কি যেন হলো জিয়াদের। মুখ থেকে নামিয়ে হাতে নিল সিগারেটটা, তারপর মেঝেতে ফেলেই পা দিয়ে পিষে ফেলল। ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠলো, 'এভাবে সিগারেটের নিকোটিনে মুক্তির স্বাদ মেলে না- যা মেলে তা কেবলই মরীচিকা'। জিয়াদ চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলো চেয়ারে। বলা নেই, কওয়া নেই, ব্যাকপ্যাকটা গুছিয়ে কাঁধে নিয়েই ছুটে গেল বাসস্ট্যান্ডে। এক মুহূর্তের জন্য সে ভুলে যেতে চাইল সে কী ঘটছে জীবনে বা কী ঘটবে আগামী দিনগুলোতে। আপাতত সে নিজেকে মুক্তি দিতে যাচ্ছে সবকিছু থেকে। কাউন্টার থেকে টিকেট নিয়ে বাসে উঠে বসলো সে, কিছুক্ষণ পরেই চলতে শুরু করল বাস। হেডফোনটা কানে গুঁজে দিতেই জন ডেনভরের কণ্ঠে ভেসে এলো, ্তুঈড়ঁহঃৎু ৎড়ধফং, :ধশব সব যড়সব, :ড় :যব ঢ়ষধপব ও নবষড়হম.্থ গ্রামে যাচ্ছে জিয়াদ। যেখানে এক বুক সবুজ ধোঁয়া নিঃশ্বাস নিলে একজীবনের সমস্ত হতাশা কার্বন ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া যায় নীরবে। যেখানে অন্ধকার জীবন্ত হয়ে উঠে সিগারেটের ধোঁয়ায় নয়, একান্তই ব্যক্তিগত না পাওয়া কিছু ভারি নিঃশ্বাসের নিঃশব্দ কোলাহলে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে