কর্ণপুরাণ ও গোমতীর উপাখ্যান

প্রকাশ | ০৭ মে ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ড. মুকিদ চৌধুরীর কর্ণপুরাণ ও গোমতীর উপাখ্যান। মহাভারতের মূল কাহিনির বীজ সৃষ্টির প্রধান স্থান ছিল আর্যাবর্ত এবং সুবিশাল প্রাচ্য দেশ (অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-মগধ-পুন্ড্র-সুহ্ম-সমতট ইত্যাদি নিয়ে গঠিত বঙ্গমগধ রাষ্ট্রপুঞ্জ)। বঙ্গমগধ রাষ্ট্রপুঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা অনার্য জনগোষ্ঠীর অসংখ্যক অবৈদিক জনপ্রিয় কাহিনি-গাথা-কাব্য-সাহিত্য আর্য-ঋষিরা, আর্য সমাজ ও রাজনীতির প্রয়োজনে সংস্কার বা পরিবর্তন করে মহাভারতে স্থান করে নেন। তবে কর্ণ মহাভারতের ক্ষুদ্র অংশ নন, বিশাল অংশ নিয়েই তার বিচরণ। কর্ণপুরাণের অন্তর্গত যে সত্য ও শক্তি তা মহাভারতের ব্যাপকতাকে ছাড়িয়ে যায়। এই নাট্যোপন্যাসে কর্ণকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে আমাদের মানুষ হিসেবে। তাকে দেখনো হয়েছে অন্যভাবে- কৌরব ও পান্ডব রাজপুত্রের চেয়েও কুশলী বীর বাঙালি হিসেবে। ফলে কুরুক্ষেত্রে সমবেত যোদ্ধাদের মধ্যে বাঙালি উপস্থিত; বাঙালি ঐতিহ্যধারায় সতত প্রবহমান। তবে কর্ণের অগাধ বীরত্ব বাসুদেবের কাছে ঈর্ষণীয়। এই নাট্যোপন্যাসে বাসুদেব একজন রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মানুষ। বৈদিক আর্য সাহিত্যে তিনি প্রথমে দেবতা তারপর দেবতারূপী মানব হলেও অনার্য সাহিত্যে তিনি শুধুমাত্র মানুষ। কর্ণ মোটেও দমবার পাত্র নন। অক্লান্ত রণবিদ্যা অর্জন তার ভরসা; বরং উদ্যম ও শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। জীবনে তিনি কখনো আপস করেননি। তার বক্তব্যে রাখঢাক না থাকার কারণে ভীষ্মের কাছে ছিলেন অপ্রিয়। তিনি প্রতিস্পর্ধী ও অহঙ্কারীই বটে। বাংলাসাহিত্যে এমন আশ্চর্য আনন্দ ও বেদনার বহুমুখী আকর্ষণবিজড়িত চরিত্র নিঃসন্দেহে বিরল। ফলে কর্ণের যথার্থ জীবনচিত্র গ্রন্থনা করা সত্যিই কঠিন কাজ। তবুও শৈলী আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত- একদিকে মহাভারত অনুযায়ী কর্ণজীবনের কালানুক্রম কঠোরভাবে রক্ষা করা, আর অন্যদিকে, কর্ণপুরাণের সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন না করে নতুন শিল্পরূপে অন্বেষণ করা। চেনা পথের সীমানা পেরিয়ে নতুন কর্ণের নিরন্তর অন্বেষণের চেষ্টা শিল্পসম্মত, শিল্পসৃজনে কর্ণের নবাত্মপরিচয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কর্ণের চলার পথ আপন স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত। আর তাই কর্ণ ও বসুদেব পৃথক ব্যক্তিসত্তায় নির্মিত। বসুষেণ-চরিত্রের বিবর্তনশীলতা ও অস্তিত্বসংগ্রামের বহুমাত্রিক জিজ্ঞাসা এই নাট্যোপন্যাসকে করেছে নবতাৎপর্যে অভিষিক্ত। কর্ণপুরাণের কাহিনি পুরাণপ্রতীকী। পুরোপুরি মহাভরতভিত্তিক নয়, রয়েছে কল্পনাও। রয়েছে মানবিক দ্বন্দ্বও। এই দ্বন্দ্বের বীজ রাজতন্ত্রের সংঘাত থেকে উদ্গত। তাই আর্য ও অনার্যের দ্বন্দ্ব দিয়ে এই নাট্যোপন্যাসের শুরু। শেষও এই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে। কর্ণপুরাণ বাঙালির আত্মসন্ধান ও জীবনসন্ধানের দর্পণ। জটিল ও ক্ষতবিক্ষত জীবনের অভিজ্ঞতাপুঞ্জ। ঔপন্যাসিকের শিল্পরীতি, সর্বজ্ঞ দৃষ্টি, অবলোকন ও উপলব্ধি কর্ণপুরাণকে করেছে অভিনব ও স্বতন্ত্র। চরিত্রগুলো ঘটনানিয়ন্ত্রিত, সময়শাসিত। বিষয়কল্পনার মতো প্রকরণবিচারেও কর্ণপুরাণ অভিনব ও স্বতন্ত্র শিল্পসৃষ্টি। অধিকাংশ সময়ে সংলাপের মাধ্যমে চরিত্রক্রিয়ার বহুমুখী প্রান্ত উন্মোচন করেছেন ঔপন্যাসিক। চরিত্র নির্বাচন ও রূপায়ণের অনন্যতা এক দুর্লভ বাঙালির ঐক্যচেতনা শিল্পরূপের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। বিষয়বস্তুর ধ্রম্নপদি আবহরক্ষার প্রয়োজনে ভাষারীতিও ধ্রম্নপদি। উপমার সারল্য ও প্রসারতা ধ্রম্নপদি ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য। প্রচুর উপমার সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে; যেমন- "মরুহৃদয়ে শ্যামলকাননের সৃষ্টি"; "গিরিনির্ঝর মহাবেগবতী নদীর মতো"; "সকল দুরূপ ও জটিল চিন্তা হামানদিস্তায় ফেলে" ইত্যাদি। কর্ণপুরাণ বাঙালি কথাসাহিত্যের ধারায় স্বতন্ত্র, অনতিক্রান্ত। অপরদিকে উপাখ্যানের কাহিনি গড়ে উঠেছে দুটি শ্রেণিকে কেন্দ্র করে। একদিকে রাজপরিবার, অন্যদিকে প্রজাপরিবার। উভয়ই সমান্তরালভাবে উপস্থাপিত। প্রকাশিত হয়েছে নিকৃষ্ট রাজপ্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও পরিবারকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের বিষাক্ত পরিবেশের পরিণামে যেমনি রাজপরিবারের সদস্যরা নিমজ্জিত, তেমনি সাধারণ মানুষের এক রকম অস্তিত্ব সংকটও প্রকাশিত। অন্ধকার ও ধূসরতা কোনো কোনো চরিত্রের জীবনসমগ্রের প্রতিভাস সৃষ্টি করেছে। এ যেন ব্যক্তি মানুষের মনোদৈহিক জটিলতার বিন্যাস। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনের বিচ্ছন্নতা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বতা, আত্মদহন ও ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতার সর্বগ্রাসী আকর্ষণে কেউ কেউ হয়ে উঠেছে শূন্য, রিক্ত ও যন্ত্রণাদগ্ধ। গোমতী উপাখ্যান মনোসংকট ও মনোবিশ্লেষণের নৈপুণ্যে আঙ্গিকগত অভিনবত্ব অর্জন করেছে। ঔপন্যাসিকের আগ্রহ ঘটনা অপেক্ষা মানুষের অস্তিত্বলোকে এবং বহির্জাগতিক ক্রিয়ার পরিবর্তে ব্যক্তিসত্তার বহুমাত্রিক সংকটের ওপর। সৃজনশীল সাহিত্যের শিল্পমাধ্যমে ঔপন্যাসিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ঘটনাপুঞ্জ ও চরিত্র-অবয়বকে তিনি রূপায়িত করেছেন ক্যামেরার লেন্স দিয়ে। বর্ণনা ভঙ্গির অন্তরালে চিত্র নির্মাণ ও নাট্যরীতির অন্তর্বয়ন এক নতুন শিল্পমাত্রা সৃষ্টি করেছে। সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণে সুনিয়ন্ত্রিত শিল্পরীতির সুগঠিত নাট্যোপনাস, স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। কর্ণপুরাণ (নাট্যোপনাস), ড. মুকিদ চৌধুরী, মূল্য : ৩০০ টাকা, অনিন্দ্য প্রকাশ গোমতীর উপাখ্যান (নাট্যোপনাস), ড. মুকিদ চৌধুরী, মূল্য : ৩০০ টাকা, অঙ্কুর প্রকাশনী অপূর্ব কুমার কুন্ডু। বাপ্পি সাহার একশো প্রেম কবি সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক বাপ্পি সাহা। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলাসদরের বিটঘর গ্রামে। তিনি ছাত্রজীবন থেকে কবিতা লেখেন। তাছাড়া সাংস্কৃতিক চর্চা, বই পড়া এবং ফটোগ্রাফির প্রতি দারুণ আগ্রহ তার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কবিতা পাঠ ও সাহিত্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ায় উদ্যোগী হন। তিনি কবিয়াল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং কবি সংসদ বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক। সংগঠনের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করছেন। লিখছেন-গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ। তার বেশ ক'টি বই প্রকাশিত হয়েছে। উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থ- রাঙা প্রজাপতির ডানা (কবিতা, ২০১৪) ছায়াদ্বীপ (গল্প ২০১৫), স্মৃতির ক্যানভাসে (কবিতা ২০১৬), বিষাদের খেয়া (কবিতা ২০১৭), বাপ্পি সাহার শত কবিতা (২০১৮), সৃষ্টি তার উষ্ণ চুম্বন (উপন্যাস ২০১৯), মুখোশের অন্তরালে (উপন্যাস ২০২০), সকলের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (২০২১)। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতাগ্রন্থ- বাপ্পি সাহার একশো প্রেম। এই কাব্যগ্রন্থের উলেস্নখযোগ্য কবিতা হচ্ছে- চাইতে যদি মন থেকে, সুন্দর সকালের স্বপ্ন এক তর্জনীর বিজয়, সত্যের পদতলে, শব্দের মিছিল তোমার ধূলিতে মিশে থাকা আজব শহর পুরনো খামে ভালোবাসা, ভালোবাসার লোহিত কণা, শুধু মানুষ হতে পারিনি, আকাশ যেন নীল। তার কবিতায় আকর্ষণ করার মতো কয়েকটি চরণ- স্নিগ্ধতা উঁকি দিচ্ছে এপাশ ওপাশ, তোমার কলধ্বনি পরপর আসবে ফিরে মুক্তির গানে, কত দৃশ্য আর ভুল জীবনের কাছে রেখে এলাম অনেকটা পথ, ভেজা ভেজা চোখ দুটো যেন প্রেমের চিহ্ন এঁকে চলে মনের গহীনে, কাঙাল হৃদয়ে কিছু স্বপ্ন থেকে যায়, বিজয় তুমি জয় বাংলার স্বর্ণধামে, প্রতিটি শব্দের ভাঁজে ভাঁজে নাড়া দেয় তোমার সাজানো চাঁদমুখ, তুমি ভোরের শিশির হবে- ঘুম থেকে ওঠা শিউলি ফুল। প্রেমাষ্পদের উদ্দেশে নিবেদিত এমন অনেক শিহরিত আকর্ষিত পঙ্‌ক্তি রয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। বাপ্পি সাহার একশো প্রেম, প্রথম প্রকাশ একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ প্রকাশনা সংস্থা- উচ্ছ্বাস প্রকাশনী প্রচ্ছদ-আর করিম মূল্য-২০০ টাকা আশরাফ আহম্মেদ