ছিঁড়ে ফেলা চিঠি

প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

মাহবুবা ফারুক
লহরি, অনেকবার অনেক চিঠি লিখেছি। আর ছিঁড়ে ফেলেছি। কখনো কোনো চিঠি ডাকঘর পযর্ন্ত পৌঁছোয়নি। কেন? ইচ্ছে করেই। মনে হয়েছে আমার সেসব কথা তোমার কাছে পেঁৗছে গেছে। আমার সব কথা তোমার জানা। এটাই আমার শেষ চিঠি। হয়তো এটা ছিঁড়বো না। অথবা ছিঁড়লে ছেঁড়া চিঠিটাই যতœ করে রেখে দেব। কারণ কাগজে চিঠি লেখার যুগ তো ফুরিয়ে এলো বলে। তাই শেষ প্রতিনিধি হিসেবে এই চিঠিটা রেখে দিতে পারি। প্রথম চিঠি লিখে বন্ধুদের কতজন ধরা পড়ে কত শাস্তি পেয়েছে! অথচ আমার আজও একটা প্রথম চিঠি হলো না। মনে হয় তোমার চোখে যখন চোখ রাখতাম ওটাই আমার প্রথম চিঠি ছিল। মায়ের বাগানের দোলনচঁাপা চুরি করে একদিন ধরা পড়েছিলাম শুধু। তোমাদের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে তোমার পড়ার টেবিলে ফুলদানি ভরা দোলনচঁাপা দেখে এসে নিজের বাগান খালি দেখে মা বলেছিলেন, তাইতো বলি আমার এত ফুল যায় কোথায়। তোমার বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ে কত জ্যোৎস্না অমাবশ্যা কাটিয়েছি তোমার বাবার কীতর্ন শুনে। তুমি জানো না। মন্তোষ কাকা এত সুন্দর গাইতেন! তার সুরের কারুকাজে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠত। সেই কঁাপায় শিহরণ ছিল। সুখ ছিল। কিন্তু তারপর একাত্তর এসে ভীষণ কঁাপিয়ে দিল আমার জীবন আমার স্বপ্ন সব ভেঙেচুরে ধুলো করে দিল। এলাকায় যেদিন মিলিটারি এলো আমাদের পরিবার রাতের অন্ধকারে সব ফেলে রওয়ানা হয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। শত শত পরিবার সীমান্তের দিকে যাচ্ছে। আমরাও মা-বাবা ভাইবোন সবাই। কেন যে আমার পা চলে না মন চলে না। খালি পিছুটান। কার অভিমানী চোখ দুটি ভাসে আমার চোখে। কে যেন রয়ে গেছে। মা বাবা ভাইবোন চলে গেল ভারতে। আমি ভিড়ের মধ্যে পালিয়ে গেলাম। কী অদম্য সাহস যুগিয়েছিল তোমার চোখ আজ আমি তা লিখে বোঝাতে পারবো না। সোজা নিজের গ্রামে ফিরে আসি। খালি বাড়ি। ভাঙা মন। অস্থিরতা ভয় চারদিকে। বাবা-মায়ের কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে। তারচেয়েও বড় কষ্ট পেলাম একটা ছোট্ট খবরে। তোমাদের প্রতিবেশীর কাছে জানলাম তোমরাও আর এ গ্রামে নেই। চলে গেছ কোথাও। কে কোথায় যাচ্ছে তা কেউ জানে না। যে যার মতো। সারা গ্রাম খঁা খঁা ভূতের নগর। আমি এক নাটাই ছেঁড়া ঘুড়ি। বয়সটা শত্রæ। যে কোনো সময় ধরা পড়ব। ধরা পড়লেই মৃত্যু। তবে মৃত্যু তো আমার একবার হয়েই গেছে। তবুও একটু আশা তখনও টিমটিম। দেশ স্বাধীন হলে তোমরা আবার ফিরে আসবে। আবার আগের মতো এক কলেজে। আবার স্বপ্ন বোনার দিন। মন্তোষ কাকার কীতের্নর সুর আবার জ্যোৎস্নায় ভাসবে। গ্রাম ছাড়লাম। মুক্তিযুদ্ধই আমার ঠিকানা। স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন। এত মানুষের এত কষ্ট এত মৃত্যু দেখে সিদ্ধান্ত নিলামÑ বঁাচলে দেশ স্বাধীন করে বঁাচব। নইলে বীরের মৃত্যুই আমার প্রথম ও একমাত্র চাওয়া। জলে-জঙ্গলে উপসে রোগে উৎকণ্ঠায় প্রিয় দেশের মুক্তির স্বপ্ন আর সাহস সাথে ছিল। পরাধীন বেঁচে থাকা তুচ্ছ। তখন তুমি আর আমার কাছে নেই। তোমার মুখ দেশের মানচিত্র হয়ে গেছে। তোমার নাম মিশে গেছে ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগানে। তোমাকে দেশ আর দেশকে তুমি ভাবি। আবেগ জমা দিয়েছি কতের্ব্যর কাছে। দেশ স্বাধীন হলে আবার সবাই ফিরবে নিজের ভিটায়। আপন ঠিকানা কেউ ভুলতে পারে না। যদি মারা যাই তুমি ফিরে এলে জানবে আমি কাপুরুষ ছিলাম না। ততদিনে মা বাবা জেনে গেছেন আমি যুদ্ধে গেছি। মা কেঁদেছিলেন। বাবা সান্ত¡না দিয়ে বলেছেন, রঞ্জন ঠিক কাজটাই করেছে। কাপুরুষের মতো মৃত্যু আমার ছেলের হতে পারে না। দেশের এমন বিপদের দিনে যদি ছেলেমেয়ে ঝঁাপিয়ে না পড়ে সেই ননীর পুতুল দিয়ে আমি কি করব? এসব কথা পরে শুনেছি। নিয়মিত গ্রামের খবর রাখি। আমার গ্রামটা এগারো নম্বর সেক্টরের অধীনে। আমি যুদ্ধ করি অন্য সেক্টরে। শুনেছি বীর মুক্তিযোদ্ধারা ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ এবং ঠাকুরাকোণা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জ পযর্ন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ। সড়ক পথ তত ভালো না। শহরের কিছু মানুষ তখনও শহর ছাড়ছে। খুব কষ্ট তবু বিজয়ের আশায় হাসিমুখে কষ্ট করছে সবাই। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে আগেই। যোগান অপ্রতুল। যাতায়াতে ভয়। কথা বলা ভয়। অফিস আদালত স্কুল কলেজ বন্ধ। প্রায়ই কারফিউ। বø্যাক আউট। রাজাকারদের উপদ্রব। লুট তরাজ। রুদ্ধশ্বাস দিন যাপন। সবার এক চাওয়া ধ্যান জ্ঞানÑ স্বাধীনতা। সবাই কানের কাছে নিয়ে আস্তে রেডিও শোনে কোনো ভালো খবর আছে কি-না। মানুষের স্বভাব স্বপ্ন দেখা। আমিও দেখি। স্বাধীনতার স্বপ্ন যতেœ লালন করি বুকে। আশার কাছে প্রাণ বাজি রাখি। তোমরা ফিরে এলে হিন্দু মুসলমানের পরিচয় পেরিয়ে আমরা বাঙালির পরিচয়ে বঁাচব আশা করি। মন্তোষ কাকার মন জয় করা আমার কাছে আর বড় যুদ্ধ নয়। দেশ স্বাধীন হবার পর অনেকেই ফিরে এলো নিজ দেশে। সবার মুখে আনন্দ বেদনা নতুন জীবনের ভাবনা মিলেমিশে একাকার। অথর্কষ্টে ভাঙা মনে ভাঙা স্বাস্থ্যে শুধু ফিরে আসার আনন্দটুকুই বড় সম্বল। সন্তোষ কাকা এলেন অনেকের পরে। সাথে তুমি নেই। যুদ্ধের সময় শরনাথীর্ শিবিরে ছিলে তোমরা। নিরাপত্তার কথা ভেবে তোমার বিয়ে দেয়া হলো। তুমি রয়ে গেছ। আমি আর জ্যোৎস্নাভাসা রাতে সেই পুকুরঘাটে যাই না। মন্তোষ কাকার সুর আমাকে আর টানে না। বরং আমি মনে মনে এক পরদেশে পরস্ত্রীর গোছানো সংসার দেখি। একটা অচেনা লোকের ভাগ্যকে হিংসা করি। জীবনের পথে পথে বসে থাকে বঁাধা। সেই বঁাধা অতিক্রম করাই জীবন। সব বঁাধা দূর হলেই ওপারে তোমার হাসিমুখ। আমি ডিঙিয়ে যাচ্ছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অনেক সমস্যা অনেক কাজ। সেসব সমস্যা দূর করার কাজে আমারও যে অনেক দায়। মা তঁার নোলকটা আমাকে দিয়ে বলেছিলেন আমার বউকে যেন দিই। তোমার আমার বিষয়টা মা জানতেন। আমি নোলক হাতে না নিয়ে মায়ের চোখে তাকাই। মুখ নিচু করে তার পায়ের কাছে বসে পড়ি। এতদিনে মনে হলো আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। মা তখন বললেন, তাহলে তোর কাছেই থাক। নোলকের কৌটায় এই চিঠি রয়ে যাবে। মনের জাদুঘরে থাকুক আমার প্রিয় নাম। আমি এক আজন্ম তৃষিত প্রেমিক। কিছু সম্পদের কিছু স্বপ্নের কোনো মীমাংসা হয় না। ভালো থেকো। কংশতীর থেকে রঞ্জন