গ্রন্থালোচনা

রাজনীতি, সুশাসন ও উন্নয়ন

প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

ড. মিল্টন বিশ্বাস
কবি ইবনে সালেহ মুনতাসির অন্যতম কাব্যগ্রন্থ ‘রাজনীতি, সুশাসন ও উন্নয়ন’ (২০১৮)। তিনি অনেকদিন থেকে কবিতা লিখছেন। তার কবিসত্তা কখনো পেশাজীবনের চাপে বিনষ্ট হয়নি। তিনি জীবন-জীবিকার ভেতর কাব্যসুধা পান করে চলেছেন একনিষ্ঠভাবে। তার রাজনীতিচেতনা ও প্রগতিমনস্ক কবিতার রয়েছে বিপুল সম্ভার। রয়েছে মানবতাবাদী আন্তরিকতার ঐতিহ্য। এই একবিংশ শতাব্দীর বদলে যাওয়া পৃথিবীতে দঁাড়িয়ে তিনি তার কবিতায় যে ব্যঞ্জিত সুর সংযোজন করেছেন তা আত্মমগ্ন হয়েও সমাজমনস্ক। কারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্র, সরকার ও শাসকের আচরণ নিয়ে ভেবেছেন তিনি, লিখেছেন ইতিবাচক ও মঙ্গলময় অগ্রগতির কথা। তার কবিতায় আছে শানিত বাগভঙ্গি, সম্পূণর্ নতুন ধরনের উপমা আর চিত্রকল্প, নতুন দৃষ্টিকোণ যা একই সঙ্গে স্বাদেশিক ও আন্তজাির্তক। একান্ত বাস্তব জীবনের চিত্রণের অনুপুঙ্খতায়, উৎপীড়িতের প্রতি গভীর সহমমির্তা ও তাদের জন্য আশার সঞ্চয়ে সত্যিই এ কবি সমৃদ্ধ। ইবনে সালেহ মুনতাসির মতে, প্রকৃত রাজনীতি, সুশাসন ও গণতন্ত্রে একটি দেশ সুখসমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে। তিনি নিজের দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসেন বলেই ‘প্রেমে শ্রান্তিতে দেশটা ভরা’র প্রত্যাশা করেন। তিনি রাজনীতিতে ‘জাতীয় সংহতি ভ্রাতৃত্ববোধে দেশটা ভরে’ উঠুক এই স্বপ্ন দেখেন। সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশে জীবনের শুরু ও শেষ দেখতে চান তিনি। কবি হিসেবে ইবনে সালেহ মুনতাসির সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন কবিতার চরণে। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে উৎসুক হয়েছেন। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি তার অনুধ্যানের একটি গুরুত্বপূণর্ বিষয়। তিনি অনেক কবিতায় বারবারই মানবাধিকারের কথা বলেছেন। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে ‘মানবাধিকার’ রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত। এ জন্য মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং নিশ্চিতকরণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জনগণের পক্ষে এভাবে কবি লিখেছেন, ‘সুবিচার সুশাসন কায়েমই জনগণের অভিপ্রায়/স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই জনগণ চান।’ রাজনীতিতে ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূণর্ বিষয়। কবি ‘শান্তিপূণর্ ক্ষমতা হস্তান্তর পদ্ধতি’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমাদের দেশেও শান্তিপূণর্ ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি থাকতে পারে।’ এ জন্যই তার কবিতার চরণ, ‘বাংলাদেশে কি হতে পারে না শান্তিপূণর্ সুন্দরভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের রীতিনীতি?/জাগ্রত জনতা পথ করো, করো পথ সুন্দর শান্তিপূণর্ ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি।’ মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ জাতীয় সংস্থাগুলো কাজ করতে বাধ্য। এ জন্য কবি ‘স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা আর সুশাসন’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম বিষয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। এখানে ‘মানবাধিকার’ বলতে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ঘোষিত ‘মৌলিক অধিকার’ এবং বাংলাদেশ কতৃর্ক অনুসমথির্ত বিভিন্ন আন্তজাির্তক মানবাধিকার দলিলে ঘোষিত মানবাধিকার, যা প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বণির্ত ২২টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে কয়েকটি হলোÑ আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ, গ্রেপ্তার ও আটক সম্পকের্ রক্ষাকবচ, বিচার ও দÐ সম্পকের্ রক্ষণ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ, শৃঙ্খলামূলক আইনের ক্ষেত্রে অধিকারের পরিবতর্ন, দায়মুক্তি-বিধানের ক্ষমতা প্রভৃতি। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে বিচার বিভাগ একজন ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণœ হলে তার প্রতিবিধানে যথাযথ আদেশ কিংবা নিদের্শ দিতে পারেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সেই আদেশ মানতে বাধ্য। উপরন্তু রয়েছে ‘আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার’-এর মতো মৌলিক অধিকারও। ইবনে সালেহ মুনতাসির অভিমত, ‘সকল আইনেই অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব অপরাধীর ফৌজদারি আইনের সংস্কার করা হলে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা হবে।’ ( নিরপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব হবে অপরাধীর) কবি আরও লিখেছেন, ‘বিচারবিভাগের মযার্দা যে সমুন্নত রাখা চাই,/বিচার বিভাগ নিরপেক্ষতা হারালে যে জনগণের শেষ ভরসাস্থল হারায়।’ এই কবি এটাও জানেন যে, মানবাধিকার সুদৃঢ় করার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সংবিধান ও গণতন্ত্র সুরক্ষাসহ রাষ্ট্রবিরোধী সব অপতৎপরতা রোধে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারের প্রতিটি সংস্থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবয়ব হচ্ছে সময়োপযোগী, আধুনিক, জনবান্ধব ও সেবাধমীর্ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানের অধিকার রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের। এ জন্যই কবি ‘আমরা বিচারক আমরা ন্যায়ের শাসক’ কবিতায় বিচারককে দেশের সংবিধান ও আইনের অভিভাবক হিসেবে গণ্য করেছেন। তারা দেশের জনগণের আস্থার সেবকও। তিনি গণতন্ত্র, সুশাসন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই কলম ধরেছেন। তার মতে, ‘গণতন্ত্র হলো জনতন্ত্রের রীতি।’(গণতন্ত্রের বিকল্প নাই) দেশের জন্য সবার অধিকার আছে বলেই কবির আস্থা ‘গণশান্তি’র ওপর। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘অমানিশার অন্ধকার দূর হবে, বন্ধ হবে শকুনির ঝাপটা দেশে আসবে শান্তি।’ কবি ইবনে সালেহ মুনতাসির রাষ্ট্র, সরকার, আইন-আদালত ও দেশের সব প্রতিষ্ঠানের কাযর্ধারা সম্পকের্ পরিপূণর্ ধারণা রাখেন। এজন্য তিনি প্রশাসনিক মঞ্জুরি, আথির্ক বরাদ্দ, আইন প্রণয়ন নিয়েও কবিতা লিখেছেন। প্রশ্ন রেখেছেন, ‘নিবার্চন কমিশনার নিয়োগ আইন কেন হবে না।’ ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করার জন্য তিনি বারবারই সোচ্চার হয়েছেন কবিতায়। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ সভ্য আচরণ আশা করেন। তারা পরাধীনতার মানসিকতা পরিত্যাগ করে স্বাধীনতার পরিচয় দেবে এটাই কবির প্রত্যাশা। কবি ইবনে সালেহ মুনতাসির লিখেছেন, ‘ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের শপথ নিবো মোরা/গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জয়গান গাই জয়গান গাইবো।/ভ্রাতৃত্ববোধ ও সংহতিবোধে থাকবো খাড়া থাকবো খাড়া,/সত্য আর সুন্দরের পূজা করে, গড়বো মোরা দেশটা যে সেরা।’(আয়রে তোরা আয় আয়রে তোরা আয়) অথার্ৎ সুখ-শান্তি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ন্যায়-বিচার, মৌলিক মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সংহতি, সত্য আর সুন্দরের পূজা করা। তার কবিতার চরণ- ‘দেশের স্বাথের্, দশের স্বাথের্, দশে মিলে করি কাজ,/ গণমানুষের ভাগ্যের পরিবতের্ন হারি জিতি নাহি লাজ। (ভিড়াতে হবে সোনার তরী) আলোচ্য ‘রাজনীতি, সুশাসন ও উন্নয়ন’ কাব্যে কবি ইবনে সালেহ মুনতাসির ‘জাতীয় স্বাথের্ ঐকমত্য’ চেয়েছেন। হরতাল ধমর্ঘটের কালচার পরিহার করতে বলেছেন। রাজনীতিতে দেশের স্বাথের্র কথা ভেবেছেন। তবে তিনি ঘুরে-ফিরে মানুষের কথা বলেছেন। তিনি দেখেছেন, ‘সবলের চাপে পড়ে মরে যারা, দুবর্ল হলো তারা/ দুবর্ল হলো তারা, জুলুমের শিকার যারা।’ এই দুবর্ল ও সাধারণ মানুষের প্রতি কবির গভীর মমত্ববোধ চরণের পর চরণে মুদ্রিত হয়েছে। ‘সুশাসন আর উন্নয়ন’ কবিতায় লিখেছেন, সুশাসনের ঘাটতি থাকলে দেশে অথর্ থাকে না/বাণিজ্যের আড়ালে লেনদেনে ভারসাম্য থাকে না। তার কবিতাগুলো সুখপাঠ্য এবং গভীর তাৎপযের্ অভিষিক্ত। (রাজনীতি, সুশাসন ও উন্নয়ন, ইবনে সালেহ মুনতাসির, প্রকাশকাল : ২০১৮, প্রকাশক : সুলেখা পাবলিশাসর্, প্রচ্ছদ : জামিল আহমেদ, মূল্য : ২০০ টাকা)