অস্তলগ্নে আল মাহমুদ

প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

ঊষার মাহমুদ
‘মৃত্যুচিন্তা আছে আমার। তবে মৃত্যুকে সমাপ্তি মনে করি না। মৃত্যুর ওপারে আরেকটা জীবন আছেÑএটা বিশ্বাস করি। কিন্তু মৃত্যু আমার মধ্যে বেদনা তৈরি করে। কারণ, মৃত্যু মানে বিচ্ছেদ, চ‚ড়ান্ত বিচ্ছেদ।’-আল মাহমুদ (অংশটুকু, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত কবির দেয়া সাক্ষাৎকার থেকে নেয়া) মানুষের জীবনে কত ধরনের ইচ্ছেই না থাকে। ছোট ইচ্ছে বড় ইচ্ছে। আমার একটি বড় ইচ্ছে বা স্বপ্ন, কবি আল মাহমুদকে কাছে থেকে দেখার। কিন্তু সময় আর ভাগ্যের দারুণ একটা দূরত্ব বিদ্যমান আমার জীবনে। জানি না এই ইচ্ছেটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়। ‘কবি আল মাহমুদ অসুস্থ’ কথাটা শুনলেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। এ পযর্ন্ত আমি সবচেয়ে বেশি পাঠ করেছি আল মাহমুদ রচনা। কমবেশি অনেকের লেখাই পড়েছি। আল মাহমুদের গল্প কবিতার মতো এতটা আকৃষ্ট করেনি কারও লেখাই। আহ কী দারুণ! অনন্য ভাষাশৈলী, নিমার্ণকৌশল। উপমার ভিতর দিয়ে শব্দের মৃদু পায়ে প্রতিটা গদ্য মা-মাটি মানুষের সুখ-দুঃখ ছড়িয়ে বয়ে গেছে নিজস্ব গন্তব্যের দিকে। কাবিলের বোন, পোড়া মাটির জোড়া হঁাস, পানকৌড়ির রক্ত, কালো নৌকা, নীল নাকফুল, মাংসের তোরণের মতো বিখ্যাত গল্প উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় সৃষ্টি! গল্প, কবিতা, উপন্যাস, সবের্ক্ষত্রেই প্রবাদতুল্য অক্ষয়ী স্রষ্টার নাম আল মাহমুদ। কতিপয় খোলস পরা সাহিত্যিক আল মাহমুদকে ফেলে দেয়ার অপচেষ্টা করে নিজেরাই সময়ের শুরুতে বিলীন হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো আল মাহমুদ বেঁচে থাকবে অনন্তকাল বাংলা সাহিত্যে। কবি জীবনের গোধূলি বেলায়, হাজারো অনুযোগ অভিযোগ বুকে চাপা দিয়ে, সহস্র অভিমান নিয়ে নিঃশব্দে পড়ে থাকেন দিনমান। হয়তো এখনো তিনি, নিঃশব্দের ডায়রিতে, অন্তর আত্তার তুলিতে সোনালি কাবিনের মতো অসংখ্য সনেট অঁাকেন। কল্পনার পাখা মেলে হরিদটিয়ের মতো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে যান শেকড়ের টানে তিতাস পাড়ের মুড়াইল গ্রামে। হেঁটে বেড়ান নিঃশব্দে সেই ‘মক্তবের চুল খোলা আয়েশা আক্তার’-এর খেঁাজে। ‘আব্বার সাইকেলের ঘণ্টারধ্বনি’ আরেকটা বার শোনার জন্য, আরেকটাবার ‘পাতার দহন ঘিরে রাত জেগে ভাইবোনগুলোকে নিয়ে বসার জন্য। তিনি হয়তো ছুটে যান মেঘনার শান্তমেয়ে তিতাস নদীর পাড়ে। বোতাম খোলা বুকে দঁাড়িয়ে তিতাসের স্তন ছুঁয়ে আসা বৈরী বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেন, তারপর কাশফুল দোলাতে দোলাতে হেঁটে যান মহাকালের দিকে...। কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকারগুলো যেন সুভাস মেলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বকুল ফুলের মতো! সহজ আর সুন্দর করে বলা কথাগুলো চম্বুকের মতো টেনে ধরে। কবি আবিদ আজিমকে দেয়া জন্মদিনের এক একান্ত সাক্ষাৎকারে কবি বলেন, আমার এই একাকী স্বেচ্ছা নিবাির্সত জীবনে শুয়ে-বসে, বিশ্রাম নিয়ে দিন কাটাচ্ছি বতর্মানে। ইচ্ছে হলে লিখি, না হয় অলসতা করি। পেছন অতীতের কথা চিন্তা করি। অনেক মুখ মনে পড়ে। ফিরে যাই পেছনে। ভাবতে ভাবতে ফিরে যাই কৈশোরে। মায়ের অঁাচল ধরে যেন অলক্ষ্যে বলে উঠি, বাড়ি যাব। মাঝেমধ্যে ভাবি আমার বাড়ি কই, আমার বাড়ি কি কখনো ছিল। জীবনে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, তা যেন ফুরোবার নয়। আমি কৃতজ্ঞ এই মা, মাটি আর মানুষের কাছে। আমি আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকি। আর এরই মধ্যে তোমরা একদিন শুনবে ‘আল মাহমুদ আর নেই’।’ ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্যের জন্য কিনা করেছেন কবি আল মাহমুদ। আধুনিক বাংলা কবিতার রাজপুত্র, বাংলা ভাষার প্রধান কবির এই সূযার্স্তকালে, দেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য কতটা দঁাড়িয়েছে কবির পাশে? এই না দঁাড়ানো বা না দঁাড়াতে পারা দেশ ও বাংলা সাহিত্যের চেয়ে বড় হতাশা কী হতে পারে আর?