প্রেমের কাব্যলোকে আহসান হাবীব

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০২১, ০০:০০

সাগর জামান
আহসান হাবীব চলিস্নশের দশকের খ্যাতিমান কবি। তার কবিতার পরিমন্ডল বিষয়বৈচিত্র্যে বিস্তৃত। বিষয়ের বহুতা লৈখিক রীতির ভিন্নতা সাবলীল ভাষাবিন্যাস ইত্যাদি অনুষঙ্গে আত্মোপলব্ধি থেকে উৎসারিত বিভিন্ন বোধ তিনি কবিতায় ব্যক্ত করেন। তার কবিতায় প্রেম নানাভাবে এসেছে। বহু বিষয়ের মধ্যে তিনি নানা রঙে প্রেমের বাণী অবমুক্ত করেন। হৃদয়াবেগ, ভালোবাসার খুনশুটিমাখা প্রেমানুভূতির আদি-অন্ত তিনি কবিতায় উপস্থিত করেছেন। সৃষ্টির আদি থেকে প্রবহমান প্রেমপ্রবণতাকে তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন নিদারুণ দক্ষতায়। আহসান হাবীবের কবিসত্তা মানুষের প্রেমের নানা আকুতি স্পর্শ করতে উদ্দীপক ছিল। তিনি প্রেমের প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজে পেতে প্রেমবন্দনায় ব্রতী হয়েছেন। কখনো কৈশোরিক আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। স্মৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। প্রেমের নিভৃত অনুভবকে তিনি নিবিড়ভাবে কবিতায় চিত্রায়ন করেন। প্রেমের মধ্যে আনন্দ ও বেদনার পরস্পর নৈকট্যের গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল তিনি কবিতায় পরিস্ফুটিত করেছেন। হৃদয় আপস্নুত করা প্রেমের প্রাণবন্ত কবিতা আহসান হাবীবের কবিতার জগতে আলোকিত ব্যাপ্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। প্রতিবেশীর প্রতি পারস্পরিক প্রেমবোধ তিনি কথোপকথনের মাধ্যমে কবিতায় তুলে ধরেছেন। দোতলার ল্যান্ডিং, মুখোমুখি ফ্ল্যাট, একজন সিঁড়িতে অন্য একজন দরজায় শীর্ষক কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। 'আপনারা চলে যাচ্ছেন বুঝি? চলে যাচ্ছি মালপত্র উঠে গেছে সব/বছর দুয়েক হলো তাই নয়? তারও বেশি। আপনার ডাক নাম শানু ভালো নাম? শাহানা, আপনার? মাবু। জানি। মাহবুব হোসেন/আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন।/কে বলেছে। আপনারতো অনার্স ফাইনাল তাই নয়?/এবার ফাইনাল/ফিজিক্সে অনার্স কি আশ্চর্য! আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?/মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে বসে... সে যাকগে। পা সেরেছে?/কি করে জানলেন?/এই আর কি, সেরে গেছে?/ও কিছু না, প্যাসেজটাই পিছল ছিল, মানে.../সত্যি নয় উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে/ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো? মা বলেছে?/শুনতে পাই। বছর দুয়েক হলো, তাই নয়?' আহসান হাবীব ব্যতিক্রমী রীতিতে কবিতা চর্চা করেছেন। আলাদা আলাদা অনুভূতিকে তিনি পরিমিলন করে কবিতায় উন্মীলিত করেছেন। পাশাপাশি বসবাস, একে অপরের প্রতি প্রেমের জাগরণ। প্রকাশের দ্বিধায় দুলতে থাকা যুগলের আকস্মিক দেখা প্রেমের আবেদনময় কথোপকথন। সুন্দরভাবে তিনি কবিতায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আহসান হাবীবের কবিতায় প্রেম-চেতনা তাকে আলাদা আলোয় উদ্ভাসিত করেছে। তার কবিতার ভুবন ভালোবাসার কলতানে মুখরিত। তিনি প্রথা ভেঙে প্রেমের কবিতায় দিগন্ত পস্নাবিত ধারার সূচনা করেন। আহসান হাবীব তার কবিতায় মনস্তাপ, দুঃখকাতরতা, আনন্দ-উলস্নাস প্রেমের পঙ্ি‌ক্তর মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ করেছেন। প্রেম মানুষের চির সুখের প্রসঙ্গ। প্রেমের সফল পরিণতি মানুষকে সুখী করে। মানুষ প্রেম-বিচ্ছিন্ন নয়। প্রেমে বিরহ-বেদনা ও ব্যর্থতাও থাকে। সে সবকিছুর মিলিত অনুভূতি আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। তিনি ভালোবাসার এবং ঘৃণার মিলিত বাণী উচ্চারণ করেন। 'একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি, একবার বলেছি, তোমাকে আমি, তোমাকেই ভালোবাসি বলো এখন সে কথা আমি ফেরাব কেমনে। আমি একবার বলেছি তোমাকে... এখন তোমাকে আমি ঘৃণা করি। এখন তোমার দৃষ্টির কবলে এল ক্ষত স্থান জ্বলে জ্বলে ওঠে। \হতোমার সান্নিধ্যে এলে তুমি উষ্ণ নাভিমূল থেকে বাতাসে ছড়াও তীব্র সাপিনীর তরল নিঃশ্বাস। আমি যতবার ছুটতে চাই তোমার দৃষ্টির বাইরে \হযেতে চাই তুমি দু'চোখে কি ইন্দ্রজাল মেলে রাখো আমি ছুটতেও পারি না। আমি ফেরাতে পারি না কথা।' ভালোবাসার মোহন শব্দের উল্টো দিকে ঘৃণার অবস্থান থাকে। গভীর ভালোবাসা প্রেমের বন্ধনকে দৃঢ় করে। ঘৃণার আগ্রাসী রূপ হালকা ভালোবাসাকে তছনছ করতে পারে। কিন্তু প্রবল প্রেমের প্রবাহকে রুখতে পারে না কখনো। আহসান হাবীব তার কবিতায় এ ধরনের কথা প্রকাশ করেছেন নানা ভঙ্গিতে। কবিতার কাছে নতজানু হয়ে। আহসান হাবীব প্রেমের কবিতা রচনায় অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি দেশ বিভাগের পূর্বে সমকালীন কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মধ্যবিত্তের টানাপড়েন সংকট সীমাবদ্ধতার যন্ত্রণা আহসান হাবীবের কবিতার যেমন ঘুরে ফিরে এসেছে তেমনি তিনি প্রেম ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে কবিতার বিষয় করেছেন। শৈশবে তার লেখালেখির সূত্রপাত হয়। স্কুল ম্যাগাজিনে ধর্ম শীর্ষক প্রবন্ধ রচনার মধ্য দিয়ে। দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় লেখেন : 'মায়ের কবর পাড়ে কিশোর' শীর্ষক একটি কবিতা। বিরলপ্রজ কবি আহসান হাবীব, মেঘনা পাড়ের ছেলেসহ অসংখ্য কবিতায় তিনি শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনা ও অনেক চরিত্র চিত্রিত করেন। আহসান হাবীবের উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থ রাত্রি শেষ (১৯৪৭)।। ছায়া হরিণ (১৯৬২) সারা দুপুর (১৯৬৪)। প্রেমের কবিতা (১৯৮১)। আশায় বসতি (১৯৭৪)। মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬)। দু'হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০) বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫)। রাণী খালের সাঁকো (১৯৬৫)। আরণ্য নীলিমা (১৯৬২)। জাফরানী রং পায়রা জোছনা রাতের গল্প/ছুটির দিন দুপুরে/বিষ্টি পড়ে? টাপুর টুপুর/রেলগাড়ি? ঝমামমে রাণীখালের সাঁকো/ জোৎসনা রাতের গল্প /ছোট মামা দি গ্রেট/পাখিরা ফিরে আসে। রত্নদ্বীপ ( ট্রেজার আইল্যান্ডর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ) হাজীবাবা/প্রবাল দ্বীপে অভিযান (কোরাল আইল্যান্ডর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)। কাব্যলোক/বিদেশের সেরা গল্প প্রভৃতি। আহসান হাবীব \হপ্রেমের কবিতা বিনির্মাণে তারুণ্যের স্পন্দন প্রেমের নানা অনুভূতি বিচিত্র ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি উচ্চারণ করেন : 'তুমি ভালো না বাসলেই বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে/তুমি ভালো না বাসলেই, ভালোবাসা জীবনের নাম/ভালোবাসা ভালোবাসা বলে/দাঁড়ালে দু'হাত পেতে/ফিরিয়ে দিলেই বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে/না না বলে ফিরিয়ে দিলেই ঘাতক পাখির ডাক শুনতে পাই চরাচরময়।' \হপ্রেমের প্রবল প্রবাহ স্বপ্নবিন্দুতে পৌঁছানোর দায়িত্ব আহসান হাবীব তার কবিতায় পালন করেছেন সফলভাবে। প্রেমিক-প্রেমিকার পারস্পরিক গন্তব্যে ছুটে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তিনি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মানবপ্রাণের চিরাচরিত স্পন্দন আহসান হাবীবের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। তরুণ-তরুণীদের প্রেম প্রকাশের অবলম্বন হিসেবে তার কবিতা চিহ্নিত। আহসান হাবীবের কবিতার উচ্চারণ দিয়ে প্রেমের অভিব্যক্তি তরুণদের প্রকাশ প্রবণতা লক্ষণীয়। তার কবিতায় ভালোবাসা ও জীবনের অর্থময়তা ফুটে ওঠে। জীবনের অমোঘতা, ভালোবাসার মানুষের একে-অপরের প্রতি আকর্ষণ, গন্তব্যের উলেস্নখ তার কবিতায় অপূর্ব অপরূপে উঠে আসে। 'আমার একটাই গন্তব্য ছিলে তুমি/ তোমারও গন্তব্য আছে তাই বারবার তোমাকে হারাই/ভুল পথে ক্লান্ত হই, নিজের অজ্ঞাতে বারবার নিজের দরজায় এসে দাঁড়াই এবং/আমার একটাই গন্তব্য থাকে তুমি।' আহসান হাবীব দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনি অনেক লেখক তৈরি করেছেন। তার নিপুণ সম্পাদনায় উজ্জ্বল হয়েছে দৈনিক বাংলার সাহিত্য বিভাগ। দীর্ঘ দিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদের দায়িত্ব পালন সূত্রে তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চলিস্নশের দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে পরিগণিত। বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। প্রেমের কবিতায় অনন্য আহসান হাবীব প্রেমের পরিণতিহীনতা ব্যর্থতায় নিরাসক্ত জীবনের বিষাদ বেদনা এবং সফল প্রেমের আনন্দ বিলাসিতা সুখানুভূতি একই সঙ্গে সন্নিবেশিত করেছেন। তিনি প্রেমের কবিতায় অভিনব রীতি সূচিত করেন। প্রেমের আলোকিত ভুবনে অনিবার্যভাবে পদচারণা করেছেন। তার কবিতায় প্রেম শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তীক্ষ্ন দৃষ্টিক্ষমতা এবং গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে মানুষের অনুভূতির জায়গাগুলো তিনি স্পর্শ করেছেন। তিনি মানবপ্রাণে প্রেমের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন নানাভাবে। প্রেমশূন্য মানুষ হয় না। প্রেমের কারণে মানুষ আবেগতাড়িত হয়। প্রেমাবেগ মানুষকে কখনো ভুল পথে নিয়ে যায়, আবার কখনো ভুল শুধরে নেয়ার প্রেরণা দেয়। আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতা সত্যিই অনবদ্য।