বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লঙ্গিনাসের সাহিত্য-তত্ত্ব কবিতার দোষ-গুণ

আবু আফজাল সালেহ
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

শিল্পকে মহামহিমান্বিত এবং সুন্দরতর হওয়াকেই লঙ্গিনাস ঝঁনষরসব বলেছেন। এটি বাহ্যিক নয়, আত্মিক, যা সহজেই পাঠককে লেখকের কাছে নিয়ে যায়। লঙ্গিনাস সাহিত্যের সার্থকতার জন্য একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বিবেচনা করেছেন ংঁনষরসব-কে। ঝঁনষরসব-এর অর্থ দাঁড়ায়- প্রকাশের এমন উৎকর্ষ মাধ্যম- যা বাগ্মীর মতো পাঠককে সম্মোহিত করে। পাঠককে লেখকের কাছে নিয়ে যায়। লঙ্গিনাসের ঙহ ঞযব ংঁনষরসব গ্রন্থে ৪৪টি অধ্যায়ের ১১টিতে ংঁনষরসব বা ংঁনষরসরঃু শিরোনাম ব্যবহার করেছেন। শিল্প-সাহিত্যের বা ইতিহাস প্রভৃতির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একমাত্র বাহন হলো ংঁনষরসরঃু কবিতা ও সাহিত্যে ংঁনষরসরঃু তথা উৎকর্ষতা নিয়েই আজকের ছোট আলোচনাটি।

ঙহ :যব ংঁনষরসব গ্রন্থে খড়হমরহঁং ঝঁনষরসরঃু-তো ৫টি উৎসের কথা বলেছেন। প্রথমত, মহৎ ধারণার সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শক্তিশালী এবং অনুপ্রেরক আবেগের উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে হবে। এ দুইটি একটি সহজাত প্রবৃত্তি। তৃতীয় ও চতুর্থ হচ্ছে, চিন্তাশক্তি ও তার বক্তব্য। বক্তব্যে স্পষ্টতা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে মননশীলতা যে যত আনতে পারবে ততই কবিতা বা সাহিত্য উৎকর্ষতা পাবে। লঙ্গিনাসের ভাষায় যা ঝঁনষরসব। অলঙ্কার গঠনের কৃতিত্ব এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে। অলঙ্কারের মধ্যে কল্পনা যেমন থাকবে তেমনই, শব্দ চয়ন ও নির্বাচনে যে যত পারদর্শিতা দেখাতে পারবেন তিনি কবি-সাহিত্যিক হিসেবে ততই সফল হবেন। সর্বশেষ বিষয়টি হচ্ছে, এসবের উন্নয়ন বা ভাবোন্নয়ন। 'ভাবের উন্নয়ন' যা প্রয়োগে প্রকাশ হবে। ভাবের উন্নয়নের পাশাপাশি তার সফল প্রয়োগ সাহিত্যের অমরত্ব দেওয়ার নির্ভরতা করে।

লঙ্গিনাস মনে করেন ঝঁনষরসব-র সঙ্গে আবেগানুভূতি এসে যায়। তবে আবেগ আর এটা এক নয়। আবেগ যদি নিচমানের হয় তবে সাহিত্যের মানও নিম্মমানের হয়ে যায়। ংঁনষরসব কোনো দেশ ও জাতির নয়- সর্বকালের, সর্বজনের। সাহিত্যের মূল বিষয় হিসেবে ংঁনষরসরঃু গ্রহণের জন্য লঙ্গিনাস বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সাহিত্যে নীরসতা, মেকিত্ব, অতিশয়োক্তি চান না তিনি। পরোক্ষ উক্তি বা বক্রোক্তিকে কাভ্রের শক্তিশালী দিক বলে অভিহিত করেছেন তিনি। কাব্য, জীবনের অনুকরণ বলা হয়ে থাকে। তবে শুধু জীবন উপস্থাপনকেই কাব্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কাব্যকে যথাযথ কাব্য হয়ে উঠতে প্রয়োজন গভীর ধ্যান ও অলঙ্কার সহযোগে ভাষাকে নবরূপ প্রদান করা। অধিক শিক্ষাগ্রহণকারী উদ্ভাবনীশক্তির লেখককে সার্থক বলে মনে করেছেন লঙ্গিনাস। মেকি বা বেঠিক বিষয়ের উপস্থাপনাকে তিনি ংঁনষরসরঃু অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা মনে করেন। 'সম্প্রসারণ' তত্ত্বে ঘটনার পরস্পর ঐক্যবদ্ধতাকে তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। কাহিনির সম্পূর্ণ বিকশিত হতে দেওয়াকে যথার্থ ংঁনষরসরঃু-র পূর্ব শর্ত বলেছেন তিনি। তুচ্ছ বিষয়কে বড় করে দেখা বা আবেগপ্রধান ইত্যাদিকে সাহিত্যের ঐশ্বর্যকে নষ্ট করে। নিচু দরের আবেগকে সামনে এনে কবিতা রচনা করলে কাব্য নিম্মমানের হয়। ছোট ছোট বিষয়কে ক্রিয়াশীল করার পারদর্শিতাও সাহিত্য স্রষ্টার একটি প্রধান গুণ।

রচনার মহত্ব ও ঐশ্বর্যমহিমা বা প্রভাবিত ক্ষমতা তৈরি করতে রূপকল্পনা কার্যকরী পদক্ষেপ। এটি একটি মানসিক ধারণা। আধুনিক কবিতায় রূপকল্প অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ। তাই, কবিতায় কল্পনার পাখা জুড়ে দিতে হবে। কল্পনা যতদূর বিস্তৃতি হবে ততদূরই কবিতার সার্থকতা। চ ই ঝযবষষু বলেন, ঢ়ড়বঃৎু রং :যব বীঢ়ৎবংংরড়হং ড়ভ :যব রসধমরহধঃরড়হ (অ ফবভবহপব ড়ভ ঢ়ড়বঃৎু)। শব্দের খেলা হচ্ছে কবিতা। কবিতায় শব্দের প্রকৃত অর্থ থেকে ভিন্ন হলে কবিতার আরও মান বাড়ে। পাঠক যদি পড়ে বিভিন্ন রকম উদ্দেশ্য ভাবে সেখানেই কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব। ভিন্ন ভিন্ন পাঠক কবিতার অর্থ যতভিন্ন অর্থ খুঁজবে ততই ভালো হবে। কবিতার এ রহস্য কবিতাকে সার্থক করে তুলবে। জুতসই শব্দ নির্বাচন, উপমা ও অলঙ্কার নির্মাণ, রূপতত্ত্ব, রসাস্বাদন, ছন্দ প্রভৃতি কবিতার পার্থক্য তৈরি করে। এগুলোর প্রয়োগে যতটা মুন্সিয়ানা দেখানো যাবে কবিতা ততটাই ভালো ও সার্থক হবে। বাক্যের স্বাভাবিক পরম্পরা এড়িয়ে শব্দ ও ধারণার ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। সব মিলিয়ে কল্পনা ও কল্পনাশক্তির সাহায্যে রূপান্তরের মাধ্যমে কাব্যে বা শিল্পে, সাহিত্যে উৎকর্ষতা অর্জনের কথা বলেছেন লঙ্গিনাস। এছাড়া মনন, ভাষা, বাক্যগঠন ইত্যাদির মাধ্যমে কাব্য বা সাহিত্যে ংঁনষরসব হয়ে ওঠে বা ংঁনষরসরঃু অর্জনের জন্য এগুলো দরকার বলে মনে করেন তিনি। প্রকৃতিই সব কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রক। নিয়ম-রীতির বাধ্যগতায় প্রকৃতিগত প্রতিভা নষ্ট হয় বলে মনে করা হয়। উলিস্নখিত বইতে আরও বেশ কিছু বিষয়ের আলোচনা করেছেন। সেগুলো আজকের আলোচনায় আনেনি। বোড় আলোচনাগুলোর চম্বুক অংশ আলোচনার প্রয়াস করলাম।

বিশেষ ধারা বা প্যাটার্ন কবি-সাহিত্যিককে বাঁচিয়ে রাখে। কবির স্বর বা ফর্মে ভিন্নতা আনতে না পারলে টিকে থাকা সম্ভব নয়। কবির নামবিহীন কবিতা পড়ে কবির নাম বলতে পারেন তখনই বুঝতে হবে সেই কবির স্বর/ফর্মে ভিন্নতা বা নতুনত্ব রয়েছে। সাহিত্যের অন্যান্য ধারার ক্ষেত্রেও প্রায় তাই। লঙ্গিনাসের এ সাহিত্যতত্ত্ব ভারতীয় উপমহাদের সাহিত্যের জন্য আলোকবর্তিকা এবং যথেষ্ট মিল রয়েছে। অ্যারিস্টলের পরেই লঙ্গিনাসের এ সাহিত্যতত্ত্বকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেকে আবার লঙ্গিনাসের সাহিত্য-তত্ত্বকে উন্নততর বলে মনে করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে