শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কবি

শারমিন সুলতানা রীনা
  ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

কবি

তুমিতো জানো আমি ভালো নেই। পৃথিবীর এই নাট্যমঞ্চে আমরা সবাই শুধু ভালো থাকার অভিনয় করে যাই নিপুণভাবে। আমার জীবন থেকে বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে যে আলো নিভে গেছে তাকে আর জ্বালানোর সাধ্য নেই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের সঙ্গেই খেলছি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এ খেলার শেষ পরিণাম অজানা।

রাত গভীর আমার দুচোখে ঘুম নেই। জানালা দিয়ে আকাশে নিশ্চুপ তাকিয়ে দেখি নক্ষত্রের মেলা। পুঞ্জীভূত আলোতে খুঁজে যাই প্রগাঢ় রহস্যের ইতিকথা। খুঁজলেই কি সব কিছু পাওয়া যায়? যে নিজেকে আড়াল করে রাখে তাকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। যে চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রাখে জোছনা সে জোছনায় কি স্নান করা যায়? যায় না সে কথা সবাই জানে। তাই তোমাকে আর খুঁজে পাওয়ার বৃথা চেষ্টা করি না।

তুমি যাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলে দূর থেকে বহুদূরে, সে তোমাকে খুঁজবে কোন আত্মবিশ্বাসে? তার সবটুকু বিশ্বাস তুমি কাঁচের মতো টুকরো টুকরো করেছ। তবু তোমাকে আজো ঘৃণা করতে পারি না। আমার ভাবলেশহীন অন্ধ হৃদয়ে তোমার যে ছবি আঁকা আছে থাকুক না জন্ম জন্মান্তর। কতবার নিজেকে বাঁচাতে তোমার দিকে ঘৃণা ছুড়েছি তীরের মতো তা আমাকেই আঘাত করেছে। মুখের হাসি দিয়ে জীবনের সব অপ্রাপ্তিকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। অন্ধের জীবন দুঃসহ নয় দুঃসহ সে জীবন যে চোখ থাকতেও দেখতে পারার ক্ষমতা রাখেনা। আমি তোমাকে নিষ্ঠুরতার উপমা দিতে চাইনা। তুমি কবি শব্দ ছন্দ নিয়ে খেলা তোমার নেশা। ছন্দের উপমায় তোমার কলমে নারীকে প্রিয়ার রূপে অধিষ্ঠিত করো। আর তোমার এই কবি রূপটিই ছিল তোমার প্রতি আমার আকর্ষণের মূল কারণ। প্রকৃতি আর মানুষের মন নিয়ে তোমার অবিরাম চলা। তবে আমি কি তোমার কাছে শুধু একটা মাংসপিন্ড? কি এমন করেছিলাম যার লঘু পাপে গুরুদন্ড দিলে? আমাদের সেই আনন্দময় দিনগুলো এভাবে ভুলে যেতে পারলে? তুমি না কবি, মন নিয়ে তোমার সাধনা। তবে আমাকে কেন বুঝতে পারলে না। এ তোমার কেমন হৃদয়হীন খেলা। যার প্রায়শ্চিত্ত শুধু আমি একা করি। দোষ-গুন নিয়েই একজন মানুষ। তোমার কি কোনো দোষ ছিল না। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করো উত্তরটা পেয়ে যাবে। শুধু একবার ডুব দিয়ে দেখো জীবনের অন্তঃস্থলে ভুলটা না ভাঙুক যেন বুঝতে পারো তোমার অক্ষমতা কোথায়? জীবন চলে তার নিজস্ব গতিতে।

আমার আকাশে ছিল পঞ্চমীর চাঁদ। আজ তারা মানুষের অবিশ্বাস্যতায় বিমূঢ় বিমুখ। সাক্ষীর কাঠগড়ায় তারা দাঁড়াতে অপারগ। তাদের বুঝি অভিমান থাকতে নেই? আজ ক্লান্তির সিংহাসনে বসা রাজ্যহীন রানী। প্রতিদিন মরে মরে বেঁচে উঠি। মৃত মাছের মতো ধূসর চোখে খুঁজে ফিরি আমাদের ফেলে আসা দিনের খুনশুটি। স্বপ্ন মরে গেলে থাকে না কিছু। পড়ে থাকে ঝলসানো শরীর। যে শরীর অপেক্ষায় থাকে প্রতিনিয়তই একটি নীরব নিস্তব্ধ রাত্রির।

ভালো থেকো তোমার সৃষ্টিতে অমর হয়ে থেকো মহাকালের কাছে।

ইতি

তোমার দেয়া নামটি যার জীবনে সত্যি হয়ে গেল।

সেই....

চিঠিটা হাতে নিয়ে রুমানা বসে থাকে বিমূঢ় হয়ে,

সাজিদকে পাঠানো ঠিক হবে কিনা! নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে গতকালের সামান্য একটা ম্যাসেজ নিয়ে।

\হইদানীং তুমি রাত জাগো। ম্যাসেজটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অপর প্রান্ত থেকে কোনো রিপস্নাই না দিয়ে সবুজ আলোর বিকিরণ নিভে যায়। রুমানা ভাবতে পারনি এমনটি হতে পারে। ডিজিটালের এ যুগে সব না হলেও কিছুটা অন্ততপক্ষে বোঝা যায় ফেসবুকের কল্যাণে অপর প্রান্তে থাকা প্রিয় বা অপ্রিয় ব্যক্তিটির পছন্দ-অপছন্দের রুচিবোধ, কে কখন ফেসবুকে থাকে বা না থাকে ইত্যাদি বিষয়গুলো।

একরাশ ঘৃণা নিয়ে রুমানা বারবার ম্যাসেজটি দেখে। মানুষ উপরে উঠলেও অনেকের আত্মঅহমিকা বেড়ে যায়। অতীতকে এত সহজে ভুলে যেতে পারে? বিশ্বাস হয় না রুমানার। তবু বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। একদিন রুমানা সাজিদকে বলেছিল কখনো কি ভুলে যাবে আমায়। অপর প্রান্ত থেকে সাজিদের অট্টহাসি। প্রশ্নই আসে না তোমাকে ভুলে গেলে আর আমার থাকে কি।

রুমানার ভাবনা জুড়ে সাজিদের বসতি। আকাশের তারাও হয়তো নিভে যেতে পারে। কিন্তু সাজিদ তার মনে যে ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালিয়েছে তা কখনো নেভবে না। সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে ভালোবেসেছিল সাজিদকে।

বাইরে মুসলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভেজা তার আজীবনের শখ। ছোটবেলায় একবার ভিজে জ্বর হয়েছিল রুমানার। কয়েক দিনের মধ্যে জ্বর আর কমে না তারপর ডা. দেখানোসহ নানাবিধ পরীক্ষায় ধরা পড়ে রুমানার বৃষ্টিতে অ্যালার্জি। মা কেঁদে কেটে তাকে শপথ করিয়েছিলেন আর যেন সে বৃষ্টিতে না ভেজে। মায়ের গলা ধরে রুমানা প্রতিজ্ঞা করেছিল আর বৃষ্টিতে ভিজবে না।

কিন্তু আজকের বৃষ্টিতে সে ভুলে যায় মাকে দেয়া প্রতিশ্রম্নতি। ছাদ থেকে নেমে ড্রেস চেঞ্জ করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে সাজিদের অনেকগুলো মিস কল। এক কাপ চা খেয়ে সে ফোন ব্যাক করে। সাজিদ তখন কাজে ব্যস্ত ফোন রিসিভ করেনা। রুমানার তখন ভীষণ অভিমান হয়। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে রাগ কমায়। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টের পায় গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। সাজিদকে ফোন দেয়। ফোন রিসিভ হয় না। ম্যাসেনঞ্জারে ম্যাসেজ লিখে রাখে। আমার গায়ে জ্বর। মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে কথা বললে জ্বর-ঠান্ডা চলে যাবে। ম্যাসেজ শো হয় না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই সাজিদের ফোন। আমি গতকাল ভীষণ বিজি ছিলাম তাই যোগাযোগ করতে পারনি তুমি উঠে নাস্তা করে ওষুধ খাও। রুমানার কণ্ঠে অভিমান। কাল এতটুকু সময় তুমি পাওনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার?

আমি তোমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিলাম বৃষ্টির সময়। জানি তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে কিন্তু খালাম্মার সঙ্গে তুমি প্রমিজ করেছিলে বৃষ্টিতে ভিজবে না আমি তোমাকে সতর্ক করতেই ফোন দিয়েছিলাম; তুমি ধরনি। কারণ আমি জানতাম তোমার জ্বর হবে। মায়ের ছোট মেয়েতো তাই এত আদরে বাদর হয়ে গেছ।

কি বললে রুমানা অভিমান বাড়ে কোথায় একটু সান্ত্বনা দেবে, তা না লেকচার শুরু করেছ। ওসব লেকচার তোমার ছাত্রছাত্রীদের দিও- স্যার আমাকে নয়। আমি তোমার ছাত্রী নই।'

মা এক কাপ চাসহ পাউরুটি ডিম এনে সামনে দিয়ে বলেন, এগুলো খেয়ে ওষুধ খাও, আমাকে রক্ষা কর। আর কত জ্বালাবি বলতো মা। তোর বাবা সারারাত ঘুমাইনি তোর টেনশনে।

- সাজিদ ফোন করেছে মা, তুমি কথা বলবে?

- না আমার কাজ আছে, তুই কথা বল। মা ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

- শোন লক্ষ্ণীটি, আমি আজ সন্ধ্যায় অফিসের কাজে লন্ডন যাচ্ছি। তুমি কিন্তু কোনো টেনশন করবে না; এক সপ্তাহ পরই আমি চলে আসব। তোমার সঙ্গে কথা হবে নিয়মিত- সো, নো টেনশন।

তুমি সন্ধ্যায় যাবে, আর আসবে এক সপ্তাহ পর। আমাকে এখন জানালে?

- কি করব, সিদ্ধান্তটা রাতে হয়েছে। বস ফোনে জানিয়ে দিলেন। না যেয়ে উপায় নেই।

- আমাকে সঙ্গে নেবে?

- তোমাকে সঙ্গে নিলে লোকে কি বলবে। বিয়েটা হোক তারপর দুজনে ইচ্ছেমতো ভ্রমণ করব। তাহলে এখন রাখি লক্ষ্ণীটি, আমাকে গোজগাছ করতে হবে। তোমার জন্য কি আনব বলতো?

- তোমার যা ইচ্ছে।

- ওকে তুমি কিন্তু মন খারাপ করবে না আসলে হয়তো একটা প্রমোশন হবে। প্রোমোশন হলে লাভটা তোমারই কিন্তু। ওকে.... বাই।

এভাবেই অনেক দিন, ক্ষণ পার হয়। তাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। রুমানা মাস্টার্স শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে যোগ দেয়। স্যালারিটা ভালো, তাই রুমানাও বেশ এনজয় করে চাকরিটা। অফিস থেকে তাকে গাড়িও দেয়া হয় বেতনও দ্বিগুণ বাড়ে। এত গুণের মধ্যে তার একটা বড় দোস সে সন্দেহ প্রবণ। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ ওর চোখ যায় সাজিদের সঙ্গে গাড়িতে একটি মেয়ে। অপূর্ব সুন্দরী বললে ভুল হবে না। মেয়েটি কথা বলতে বলতে সাজিদের গায়ে পড়ছে বারবার। চলন্ত গাড়ি দুজনেরই।

রুমানার রাগ বেড়ে যায়। বাসায় এসে আবার ফোন দেয় সাজিদকে। সাজিদ ফোন রিসিভ করতেই রুমানার যত রাগ সঙ্গে সঙ্গেই ঝাড়তে থাকে। অপর পক্ষকে কোনো সুযোগ দেয় না কিছু বলতে।

- সাজিদেরও রাগ বেড়ে যায়।

- আমি যাকে খুশি তাকে নিয়ে ঘুরব- তাতে তোমার কি? এখনওতো আমাদের বিয়ে হয়নি। এর মধ্যে এত শাসন ঠিক নয়। বুঝতে চেষ্টা কর। মেয়েটি আমার...

কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুমানা ফোন কেটে দেয়। আর কিছু জানতে বা বুঝতে চায় না। মোবাইলে সাজিদের নাম্বার বস্নক করে দেয়। বড় একটা ম্যাসেজ লিখে ফেসবুক থেকেও তাকে বস্নক করে দেয়। সাজিদ রুমানার মাকে ফোন দিয়ে জানায় মেয়েটি তার কলিগ।রুমানা কাঁদতে কাঁদতে মাকে জানায়, কলিগ বলে কথা বলতে বলতে গায়ে পড়বে কেন মা। এটা কেমন ব্যাপার।

পাঁচটি বছর কেটে যায়। রুমানা জানতে পারে সাজিদ বিয়ে করেছে। দুজনের যোগাযোগ শেষ হয়ে যায়। রুমানা বিয়ে করে সন্তানের মা হয়। তবু মাঝে মাঝে সাজিদকে ভেবে চোখের জল মোছে। সাজিদ এখন অনেক বড় সরকারের আমলা। রুমানা নিজেকেই প্রশ্ন করে সাজিদ কি তাকে মনে রেখেছে? ফেসবুক ঘাটতে ঘাটতে খুঁজে পায় সাজিদের নতুন আইডি। লজ্জা অভিমান ভুলে সে রিকুয়েস্ট পাঠায়। সাজিদ এক্সেপ্ট করে। কোনো কথা হয় না। সাজিদের দেয়া পোস্টগুলো দেখে। নিজেও আপলোড দেয় অনেক কিছু। গভীর রাত রুমানার ঘুম আসে না। ফেসবুক খুলে দেখতে পায় সাজিদকে। সাজিদের সবুজ বাতি জ্বলছে। নিজেকে আর সংবরণ করতে পারে না। ছোট্ট একটা ম্যাসেজ দেয়। তুমি এখন রাত জাগো কেন? পরদিন ঘুম ভাঙার পর মোবাইল খুলে দেখে আপনি আমাকে আর ম্যাসেজ দেবেন না। তুমি থেকে আপনি।

আত্মবিশ্বাসের কাছে হোঁচট খায় রুমানা। নিজেকে ধিক্কার দেয় কেন যেচে তাকে ম্যাসেজ লিখতে গেল। তাদের দুজনের সম্পর্কটা রায়হান জানতো কিন্তু কোনো দিন কিছু জানতে চায়নি কেন তারা আলাদা হয়ে গেল। রায়হানের জন্য ভালোবাসাটা আরো তীব্র হয়। কিন্তু আজ সাজিদের জন্য কেন তার এমন লাগছে সেকি তবে আজো সাজিদকে ভালোবাসে। বাচ্চাটা কয়েকবার মা মা বলে কাঁদছিল, তাকে থামিয়ে কাগজ কলম নিয়ে বসে রুমানা। সাজিদকে আজ সে এতগুলো বছর পরে চিঠি লেখে। চিঠি লেখা শেষ হলে বারবার পড়ে সে। সাজিদ কি তার এ চিঠি পড়বে? চিঠি লেখার রেওয়াজ এখন আর নেই। মানুষের ভাব অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম এখন মোবাইল ফোন অথবা ফেস বুক। তবু সে মন স্থির করে চিঠিটা সাজিদের ঠিকানায় পাঠাবে। সাজিদ কি চিঠিটা পড়বে? নাকি ফেলে দেবে না দেখেই ডাস্টবিনে?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে