বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় জীবনের গভীরতা

সাগর জামান
  ২২ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

আবদুল মান্নান সৈয়দ ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি। লেখক গবেষক হিসেবেও তিনি সমধিক খ্যাতিমান। কবিতা দিয়ে তার লেখালেখির সূত্রপাত। ছেলেবেলা থেকে সব ধরনের লেখালেখিতে তার ঝোঁক ছিল। সাহিত্যের সব শাখাতেই তিনি বিচরণ করেছেন। সব্যসাচী লেখকের অভিধায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন। তার কীর্তি প্রস্ফুটিত হয়েছে। পরিশ্রমী লেখকের মর্যাদায় আসীন হয়েছেন অবলীলায়। আবদুল মান্নান সৈয়দ অত্যন্ত নিরীক্ষা প্রবণ লেখক ছিলেন। তোলপাড় করা লৈখিক শক্তি নিয়ে বাংলাসাহিত্যের অনাবিল ভুবনে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। বাংলা কবিতায় মান্নান সৈয়দ যুক্ত করেছেন পরাবাস্তববাদিতা। আবদুল মান্নান সৈয়দের উদ্ভাবনী শক্তি ছিল অপরিসীম। এই শক্তি এবং আলাদা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করার ক্ষমতা তার ভাষাভঙ্গিকে করে তুলেছে ব্যতিক্রমী। তিনি তার লেখালেখিতে যে সৃজনশক্তির স্বাক্ষর রেখেছেন তা খুব বেশি লেখকের মধ্যে দেখা যায়নি। তিনি তার প্রকাশরীতির জন্য বিশেষ ভাষার উদ্ভাবন করেছিলেন। এ ভাষার প্রকাশ ক্ষমতা ঋদ্ধ করেছে তার সাহিত্যকে। তার লেখা ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি ছিলেন বিরল সাহিত্য সমালোচক। অসামান্য বু্যৎপত্তি এবং বিশ্ব সাহিত্যের ওপর অগাধ জ্ঞান নিয়ে তিনি সাহিত্য সমালোচনা করেছেন। সৃজনশীল সব শাখাতেই তিনি উজ্জ্বলতা দেখিয়েছেন। সাহিত্যের সব শাখাতে তিনি বিস্তর কাজ করলেও তার মধ্যে মনোকষ্ট ছিল, অনেক কাজ করতে না পারার জন্য।

শারীরিক অসুস্থতা তার কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতো অনেক সময়। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রচুর কাজ করলেও তিনি ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য অনেক কাজ করতে পারেননি। তিনি আরো কাজ করতে চেয়েছিলেন। মাইকেল সম্পর্কে, বঙ্কিমের উপন্যাস সম্পর্কে তার লেখার ইচ্ছা ছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দের একটা আক্ষেপ ছিল কবি জসীমউদ্‌দীনকে নিয়ে কোনো কাজ করতে না পারার জন্য। জীবনানন্দকে নিয়ে তিনি যে কাজটা করেছিলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও সে রকম কাজ করা উচিত ছিল তার। তিনি এমনটাই মনে করতেন। এ নিয়ে মান্নান সৈয়দ মনোকষ্টে ভুগেছেন।

ক্লাস সেভেন এইট থেকে এমএ পাস পর্যন্ত তিনি অবিরাম লেখালেখি করতেন আর ছবি আঁকতেন। কিন্তু তার বাবা লেখা প্রকাশিত হতে দিতেন না লেখাপড়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায়। সে সময় তিনি নিজেকে ক্রমাগত শিক্ষিত ও সংস্কৃত করার চেষ্টা করেছেন। তার বাবা তাকে পড়ালেখায় বাধ্য করেছেন যেন তিনি এমএ পাস করেন। এ জন্য তিনি ১৯৬৫ সালকে মনে করতেন আত্মপ্রকাশের বছর।

আবদুল মান্নান সৈয়দ তার লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠাকে মনে করেছেন দৈবের দান। আর এর সঙ্গে যুক্ত তার নেপথ্য চর্চা। এই চর্চার কৃতিত্ব তিনি তার বাবাকে দিয়েছেন। তিনি ছেলেবেলা থেকে লিখতেন আর ছবি আঁকতেন। আর তার বাবার ধারণা হয়েছিল লেখাপড়া হবে না। বাবার সেই ধারণা সত্যিই ছিল বলে মনে করেছেন মান্নান সৈয়দ। তার বাবা অবিশ্রাম বকাঝকা না করলে একাডেমিক শিক্ষা অনর্জিত থাকতো। মান্নান সৈয়দ মনে করেছেন, একাডেমিক লেখাপড়ার ভালো মন্দ দুটো দিকই আছে। ভালো একটা দিক এই যে, যে ধরনের লেখালেখি তিনি করেছেন তাতে লেখাপড়া না শিখলে না খেয়ে মরতে হতো। যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে।

আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় পরাবাস্তবতা ধরা পড়েছে নানাভাবে। পরাবাস্তবতা তার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। তিনি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। সে কারণে জীবনানন্দ দাশ তার কবি চিত্তে প্রভাব বিস্তার করেছেন। মান্নান সৈয়দ তার কবিতায় পরাবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে,

'জ্যোৎস্না কী? না, জ্যোৎস্না হয় জলস্নাদের ডিমের মতো চুলহীন জলবায়ুহীন মুন্ড, জোড়া-জোড়া চোখ, সাতটি আঙুলের একমুষ্টি হাত, রক্তকরবীর অন্ধকার এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার'।

আবদুল মান্নান সৈয়দ এভাবে তার কবিতায় সফলভাবে পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। পরাবাস্তবতার শিল্পরূপকে তিনি তার কবিতায় নানাভাবে তুলে ধরেছেন।

টানা গদ্যে কবিতা রচনার মাধ্যমে মান্নান সৈয়দ অভিনব একটি ধারার সূচনা করেছিলেন। এই রচনা রীতির প্রচলনের কারণে তার প্রথম কবিতা গ্রন্থ জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ সুধিমহলে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। তার জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ বইটি যখন প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে, তখন আবদুল মান্নান সৈয়দের বয়স ২৪ বছর। কবিতাগুলো লেখা ১৯৬১ সাল থেকে। অর্থাৎ ১৮/১৯ বছর বয়েস থেকে। তিনি তখন বিদ্যাদানের সামান্য একটি চাকরি করেন। দিনরাত্রি কাটে উদ্দাম সাহিত্যচর্চায়। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহাধ্যায়ী আসাদ চৌধুরী তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি কলেজে পড়ান। ঢাকায় এলে মাঝে মাঝে মান্নান সৈয়দের সঙ্গে দেখা করেন। একবার এসে প্রস্তাব দেন আবদুল মান্নান সৈয়দের একটা কবিতার বই প্রস্তুত করবার জন্য। তখনকার দিনে বই প্রকাশ ছিল একটা ঘটনা। আসাদ চৌধুরী একজনের কাছে টাকা পেতেন। পুরানা পল্টনে একটি বিশাল প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন মুহম্মদ আখতার নামের একজন। লেখাপড়া বেশিদূর শেখেননি তিনি, কিন্তু অসাধারণ মুদ্রণরুচি ছিল মুহম্মদ আখতারের। বহু বিপত্তির পর শেষ পর্যন্ত বইটি বের হয়। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন রফিকুন্নবী। এটা ছিল তার প্রথম প্রচ্ছদ অঙ্কন। তখনকার দিনে সবচেয়ে সুদর্শন টাইপ ছিল লাইনো। একমাত্র 'দৈনিক পাকিস্তান' পত্রিকা ছাপা হতো ঐ টাইপে। রশীদ হায়দার ওই প্রেস থেকে জোগাড় করে দিয়েছিল 'জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ' আর আবদুল মান্নান সৈয়দ নামের লাইনো টাইপ। মলাটে ওই টাইপ ছাপা হয়েছিল। টানা গদ্যে লেখা ছিল এই বইয়ের কবিতাগুলো। বইটি প্রকাশের পর বিরোধিতার একটি ঢেউ উঠেছিল। পরে মান্নান সৈয়দের এই রচনা রীতিকে অনুসরণ করেছেন অনেকে।

তিনি সৃষ্টিশীলতা ছাড়া অন্য সবকিছুকে উপেক্ষা করতে পারতেন। দূরে ঠেলে দিতে পারতেন। কেবল সৃষ্টিশীলতাকে বুকে টেনে নিতেন পরম ভালোবাসায়। সৃষ্টিশীলতা ছিল তার কাছে গভীর অনুরাগের বিষয়।

সৃষ্টিশীলতার প্রতি নতজানু হয়ে তিনি উচ্চারণ করেছেন,

'শুধু তোমাকে সালাম- আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,

আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস- শুধু তুমি ঘাসে রত্নফুল,

আর-সব নোংরা টাকা-পয়সার মতো: হাতে-হাতে ঘোরে-ফেরে-

শুধু তুমি অমল-ধবল তুমি,

তোমার আহারে শুধু ঘড়ি লাগে- আর-কিছুই রোচে না তোমার,

নামো ঝরনা ফাটিয়ে পাথর- সৃষ্টি তার মুখোশ ছিঁড়েছে,

বস্তুর বিরুদ্ধে শুধু অফুরান প্রজাপতি ওড়ে'।

ষাটের দশককে বলা হয় সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। এ দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত আবদুল মান্নান সৈয়দ। এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে ষাটের দশক একটি স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ দশকেই বাংলার জনগণের স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম বেগবান হয়ে ওঠে। ষাটের দশকের সংগ্রামমুখর সময়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ খ্যাতি লাভ করেন। শৈশব থেকে নিরন্তর সাহিত্য সাধনায় তিনি নির্মাণ করেন সাহিত্যের নিজস্ব ভুবন। তৈরি করেন সাহিত্যের স্বতন্ত্র স্রোতধারা। তিনি তার সাহিত্যের মাধ্যমে স্বদেশের মানুষের সঙ্গে সংলগ্ন হয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। তিনি তার কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রয়োগ ঘটিয়ে। আধুনিক সাহিত্যধারাকে গতিশীল করেছেন সুনিপুণভাবে। আত্মগত ভাবনা আর অর্তগত বেদনার ছায়াচিত্র মান্নান সৈয়দের কবিতার অবয়বে ফুটে উঠেছে। প্রচলিত নিয়মরীতিকে উপেক্ষা করে তিনি আলাদা নিজস্ব প্রকরণ রীতির আলোকসজ্জা দিয়ে আলোকিত করেছেন কবিতার ভুবন। বিষয় বৈচিত্র্য আর বিচিত্র ভাবনার সৃজনে তিনি আধুনিক কবিতায় আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন। তার বহুমুখী বোধের শিল্প সৃজনে সব ধরনের কবিতা নির্মিত হয়েছে। স্বপ্নের কবিতা বাস্তবের কবিতা পরাবাস্তবের কবিতা। তার কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড শীর্ষক কবিতায় ভিন্ন স্বর এবং এক ধরনের কৌতুক লক্ষ্য করা গেছে,

'এখানে কবিতা বানানো হয়।

সব ধরনের কবিতা।

রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।

নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।

প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।

স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।

চলিস্নশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।

ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।

আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই'।

আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কবিতা ছাড়াও তিনি গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা, নাটক ইত্যাদিতে অবদান রেখেছেন। সমালোচনা-সাহিত্যে তিনি ছিলেন অনন্য। সমালোচনা-সাহিত্যকে আবদুল মমান্নান সৈয়দ একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পঞ্চাশ বছর সমালোচনা সাহিত্যের ওপর কাজ করে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিবিড় গবেষণার ওপর প্রতিষ্ঠিত তার সমালোচনাসাহিত্য। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি জীবনানন্দ দাশের ওপর গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

আবদুল মান্নান সৈয়দ নিরপেক্ষাতার জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সাহিত্যসাময়িকী শিল্পতরুর উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় তিনি নবীন-প্রবীণ সব কবি-সাহিত্যিকের রচনা সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। তার সম্পাদনায় ও প্রচেষ্টায় শিল্পতরু আশির দশকের শেষভাগে একটি মর্যাদাবান সাহিত্যপত্রে পরিণত হয়েছিল।

আবদুল মান্নান সৈয়দ তার সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ক্লান্তিহীন সাহিত্য সাধনায় গড়ে তুলেছিলেন কবিতার শিল্পরূপ এক ভুবন।

আবদুল মান্নান সৈয়দ কল্পনাপ্রবণ কবি যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন সত্যদ্রষ্টা। কল্পনার মোহময় জগতে বিচরণের পাশাপাশি রূঢ় বাস্তবতার রুক্ষ পথে হেঁটেছেন অবিরাম। তিনি উচ্চারণ করেছেন-

'একি, আপনি বাজারে? কবি সাহেব, আপনিও কি বাজার করেন?'

- হঁ্যা, আমাকেও বাজার করতে হয়,

আমাকেও তেল-নুন-মাংসের হিসাব কষতে হয়-

আমি নই বায়ুভুক রবীন্দ্রনাথ।

কবিতাকেও হতে হয় পৌরুষেয়-

শুধু নারীলাবণিগ্রস্ত নয়।

বসন্তের সংঘর্ষে জ্বলে উঠতে হয় আগুনের মতো'।

গদ্যের পাশাপাশি আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা ব্যাপকভাবে পাঠক প্রিয়তা অর্জন করেছে। তার ব্যতিক্রমী ভাবনা ও ভাষায় নির্মিত হয়েছে কবিতার অবয়ব। প্রচলিতধারাকে অস্বীকার করে নিজস্ব ভাবনা ও ভাষা নিয়ে তিনি কবিতা চর্চায় অগ্রবর্তী থেকেছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে