শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তনু বিশ্বাসের নাট্যচিন্তা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

নতুনধারা
  ২২ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

অনেক মানুষ মিলে সমাজ আর দুটি মানুষ মিলে সংসার। সেই সংসার নাট্যশালায় স্বামী বড় না স্ত্রী বড় সে এক অমীমাংসিত রহস্য। তবে ঢাকার নাট্যশালায় শ্রদ্ধেয় রামেদু মজুমদার-ফেরদৌসী মজুমদার, ইনামুল হক, লাকী ইনাম, আলী যাকের- সারা যাকের, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, শিমূল ইউসুফ প্রভৃতি শ্রদ্ধাভাজনরা একে অপরের পরিপূরক সহকর্মী- সহযাত্রী- সহশিল্পী হয়েই ব্যক্তিজীবনে বড় আবার সাংস্কৃতিক জীবনেও বড়। কেউ একজনের শূন্যতা অন্যকে যে কতটা নিঃসঙ্গ করে তোলে, অসহায় করে তোলে তার মর্মভেদী অভিব্যক্তি দেখা গেল ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে ড. ইনামুল হকের অন্তিম বিদায়কালে লাকী ইনামের দিশাহীন ক্রন্দন উচ্চারণে, 'ইনামকে ছাড়া থিয়েটারটা আমি কি একা করতে পারব!' পারেননি লিলি চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম নারী মঞ্চাভিনেত্রী এবং নিত্যশিল্পী হওয়া সত্ত্বেও কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের আধুনিক নাট্যকার স্বামী মুনির চৌধুরীকে স্বশরীরে পাননি বলে। নিয়তিকে অস্বীকার করা চলে না আবার জীবন চলার পথে থামলেও চলে না। স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রীরাও যে স্বামীকে, স্বামীর শিল্পকর্মকে শিল্পানুরাগীদের সামনে তুলে ধরেন তার বাস্তবিক প্রমাণ ক্যাথরিন মাসুদ (তারেক মাসুদের রচনা- সাক্ষাৎকার প্রকাশ), সারা যাকের (আলী যাকেরকে ঘিরে স্মারক লেখা নিয়ে চলমান সম্পাদন) এবং চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভ্রা বিশ্বাস (অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক, সংগীতজ্ঞ, সম্পাদক, দলপ্রধান শান্তনু বিশ্বাসের রচনা সংকলন নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ)। শোককে শক্তিতে রূপ দিয়ে আগস্ট ২০২১ সে চট্টগ্রামের প্রকাশনা সংস্থা এডিটর থেকে প্রকাশিত হয়েছে শান্তনু বিশ্বাসের আজীবনের জীবনসঙ্গী-শিল্পসঙ্গী-সহমর্মী ও বর্তমান গ্রন্থের সম্পাদক শুভ্রা বিশ্বাস সম্পাদিত, পীযুষ দস্তিদার প্রচ্ছদিত, নাট্যবিষয়ক গ্রন্থ শান্তনু বিশ্বাসের নাট্যচিন্তা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ।

প্রসঙ্গক্রমে নাট্যকার আবদুলস্নাহ আল মামুনের শূন্যতায় থিয়েটার দলপ্রধান রামেন্দু মজুমদার বলেছিলেন, 'দলের নিজস্ব নাট্যকার না থাকাটা নাট্যচর্চার বড় ঘাটতি'। আর চট্টগ্রামে বসে শান্তনু বিশ্বাস কালপুরুষ নাট্যসম্প্রদায়ের দলীয়চর্চায়, সেমিনারের প্রবন্ধ উপস্থাপনায়, পত্রিকার নিবন্ধ রচনায় কথার পিঠে কথা সাজিয়ে বলছেন এবং লিখেছেন, 'এই মুহূর্তে আমাদের থিয়েটারকে দীর্ঘায়ু করার জন্য আপাতত আর কোনো নতুন দল চাই না। দল নিয়ে দলাদলি চাই না। চাই নতুন নাটক, নতুন নাট্যকার, বিষয় ভাবনার যথেচ্ছ স্বাধীনতা'। স্বাধীনভাবে নাট্যকাররা নাটক লিখুক এবং প্রথিতযশা নাট্যকারের নাটকের পাশে তার নাটকটাও সমান গুরুত্ব এবং অর্থ নিয়ে প্রকাশিত হোক সেই ভাবনা থেকে সদ্য পাওয়া চাকরির বেতনে প্রায় পুরোটা দিয়ে  নিজের সম্পাদনা ও প্রকাশনায় প্রকাশ করলেন থিয়েটারবিষয়ক পত্রিকা 'প্রসেনিয়াম'। প্রসেনিয়াম প্রকাশ সংখ্যা ছয়টি। আর কি অদ্ভুত কাকতালীয় শান্তনু বিশ্বাসের বিয়ালিস্নশটি রচনা জায়গা করে নিয়েছে যথোপযুক্ত সেই ছয়টি অধ্যায়ের অন্তরালে।

অন্তরাল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থিয়েটার বাস্তবতা যেন স্বচক্ষে দেখে এবং বিন্দু দৈর্ঘ্যের  আয়নতনে সিন্ধুর বিশালতা তথা  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনীত নাটকের আলো-মঞ্চ-সংগীত-অভিনয়-রূপসজ্জা-নির্দেশনা যেভাবে তুলে ধরলেন 'রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার ভাবনা' প্রবন্ধে সে তো এক কথায় বিস্ময়। নাট্যকারের খোঁজে প্রবন্ধে লিখছেন, 'সফোক্লিস, শেক্সপিয়র, মলিয়ের, ইবসেন, ব্রেশট, ওসবোর্ন, বেকেট, আইনেস্কো, বার্নাড'শ  প্রমুখ নাট্যকারের নাটক আমাদের থিয়েটারকে একটি পর্যায় পর্যন্ত সমৃদ্ধ করবে। কিন্তু আয়ুষ্মান করতে পারবে না। আমাদের চাই নতুন নাটক, নতুন নাট্যকার'। খন্ডকালীন শিল্পচর্চা আর সর্বাঙ্গীন শিল্পনেতা হওয়া প্রবন নাট্যকর্মীদের পথভ্রষ্ট রুখতে দূরদৃষ্টি নিয়ে বলছেন, 'সামাজিকভাবে সর্বজনে পরিচিত হচ্ছেন নাট্যকর্মী হিসেবে অথচ নাটকে সময় দিচ্ছেন প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা। অর্থাৎ কিনা গাছেরও খাচ্ছেন তলারও কুড়োচ্ছেন। উন্নাসিক ধারণায় বশবর্তী হয়ে আত্মপ্রচার-আত্মমুগ্ধতা ও আত্মাভিমানে  দিন গুজরান করা যায় কিন্তু সৃজনশীল ধারাকে অব্যাহত করা যায় না। শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে করতে স্বসৃষ্ট একটি ইলিউশনারি বৃত্তে এক সময় সে নিজের অজান্তেই আটকে পড়বে। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার বিলাস মস্ত বিড়ম্বনাই শুধু নয়, এটা আত্মঘাতী'। রাবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নের অনুপযোগী প্রচলিত সিদ্ধান্তটাই শম্ভু মিত্রের কাছে আত্মঘাতী। শুধু মঞ্চায়ন নয়, সফল মঞ্চায়নও যে সম্ভব সেটাই শম্ভু মিত্র করে দেখিয়েছেন। কিন্তু কোন তৎকালীন সময়ে রাবীন্দ্রনাথের নাটক অচল সে কথার ব্যাখ্যা শান্তনু বিশ্বাস তুলে ধরেছেন 'শম্ভু মিত্র থিয়েটারের পরম নির্ভরতা' প্রবন্ধে। শম্ভু মিত্রের চোখে চোখ রেখে, ন্যায়-বিচারের তুলা মানদন্ডে, 'আমাদের নিজস্ব কোনো মানদন্ড নেই নাটক বিচারের। যা আছে তা অন্যের থেকে ধার করা। ঠিক যেমন বিলেতি চিত্র শিল্প বিচারের মানদন্ড অনুসরণ করে একদিন আমরা আমাদের দেশীয় চিত্র ত্রম্নটিপূর্ণ মনে করেছি। ঠিক তেমনি বিলেতি বিচার করেই আমরা একদিন রাবীন্দ্র নাটককে ঠিক করেছিলাম যে এগুলো সঠিক অর্থে নাটক নয়'।

নয় এসএম সোলায়মান মাত্র কোনো একটি নাট্যদলের। যাপিতজীবনে তার নাট্যভ্রমণ পাঁচটি দলে। শান্তনু বিশ্বাসের যাপিতজীবনে নাট্যভ্রমণ তিনটি দলে। উভয়ে চট্টগ্রামের সন্তান এবং উভয়ে স্বাধীনচেতা, সৃজশীল এবং শিকড় সন্ধানী। এসএম সোলায়মান ঢাকার নগরজীবনে লোকসংস্কৃতির মাইলস্টোন প্রডাকশন 'আমিনা সুন্দরী' তুলে এনেছেন আর উৎসমূলে শান্তনু বিশ্বাস 'সুচরিত চৌধুরীর আমিনা সুন্দরী'র গানে' তুলে এনেছেন আমিনা সুন্দরী নাটকে সুচরিত চৌধুরীর গান সৃজন এবং গায়ক মিলন মজুমদারকে সর্বস্ব অর্পণের পেক্ষাপটে । বাংলাদেশের পথনাটক চর্চায় 'যায় দিন ফাগুনো দিন ' কীভাবে পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় আবার উদায়শংকরের ট্রুপে বিশ্ব পরিচিতি এবং বিশ্বভ্রমণের সুযোগ অপেক্ষা দেশীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখতে পেরে ধন্য বোধ করা কধুরখীল গ্রামের বাদক- নৃত্যশিল্পী বিনয় বাঁশির, সে সব কথাই শান্তনু বিশ্বাসের রচনায় জীবন্ত হয়ে যায়। নাম, জীবন নাটকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কেন জীবন্ত, অভিনেতা কীভাবে মঞ্চে হয় চরিত্র থেকে চরিত্রে রূপন্তরিত, সাবিনা ইয়াসমিন কেন সুরকারদের কাছে সর্বাপেক্ষা গ্রহণীয়, ক্ল্যাসিক আর ফোকের সুরের সংমিশ্রণে কুমিলস্নার সন্তান শচীনদেব বর্মণ গায়কীতে কেন বিশ্বে উদ্ভাসিত এরকম অসংখ্য কার্য কারণের ব্যাখ্যা কথার পিঠে কথা হয়ে বাঁধা রয়েছে সম্পাদক শুভ্রা বিশ্বাসের সম্পাদনায় শান্তনু বিশ্বাসের নাট্যচিন্তা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ গ্রন্থে। শান্তনু বিশ্বাস তার জীবিত কালে কবি-সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ আবুল মোমেনকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল, 'বন্ধু, চিরদিনের' নামে রচনার মধ্যদিয়ে আর আজ আবুল মোমেন শান্তনু বিশ্বাসের কর্মের মূল্যায়ন এবং গ্রন্ত্রটি প্রকাশনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরলেন বইটির মুখবন্ধে, 'এ কাল বিস্মৃতি এবং আত্মমোহের দ্বৈরথে পিস্ট, কে কার খোঁজ রাখে, কাকেই বা মনে রাখে! তাই এখন চাই হাতের কাছে এক সঙ্গে। শুভ্রা তা জানে, তাই চেষ্টা করছে শান্তনুকে-ভাবুক, লেখক, শিল্পী শান্তনুকে গ্রন্থাবদ্ধ করে সবার কাছে তুলে ধরতে। সেই ভাবনা থেকেই এই বই'।

অপূর্ব কুমার কুন্ডু

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে