শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কলের পুতুল

মাসুমা ডেইজী
  ২২ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

তুই হলি কৃষ্ণ কালো / তুই আমার ঘরের আলো / তোর হাতে লক্ষ্ণীর ভান্ডার / খুলে গেল ভাগ্যের দুয়ার

মায়ের মুখে শুনেছি, বাবা এই চার লাইনের কবিতা লিখে ছিল আমি জন্মানোর পর। বাবা তার এই কুচকুচে কালো মেয়েটার কপালে নাকি রাজটিকা দেখে ছিল। মা'কে বলেছিল, 'দেখো, একদিন এই সংসারে ও নিজ হাতে আঁকবে সুখের জয়োটিকা।'

একদিন দুপুরে বাবা বিশ্রামের জন্য গা এলিয়ে দিল বিছানায় আর নরম সুরে ডাকলো আমায়। বাবার এই ডাকটা আমার চেনা, আমি বুঝতে পারি বাবা আমাকে কিছু বলতে চায়। কাছে যেতেই বাবা বলল, 'আমার পাশে বোস।' হঁ্যা বাবা বলো-

'বিন্দু খুব ভালো ছেলে /কিন্তু ওর তো ছন্নছাড়া জীবন, /বছরের আট মাস থাকে জেলে /ও কি সংসার ধর্ম করতে পারবে? / বামপন্থি রাজনীতি করে ওটাই তার ধ্যান জ্ঞান।'/হঁ্যা বাবা, রাজনীতি ও ছাড়তে পারবে না। /ও আমাকে বলে দিয়েছে, সংসার ধর্মে সে আবদ্ধ হতে চায় না। /'তাহলে উপায়? আমি যে তোকে সংসারী দেখতে চাই মা।'

ঠিক আছে বাবা, তুমি অন্য ছেলে দেখ। ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন ছিল, তাই দশটা-পাঁচটা ছেলের সম্মুখে সং সাজতে হয়নি। একটা ছেলে ঘরোয়া পায়চারিতে দেখে গেছে, তার সঙ্গেই বিয়ে ঠিক হলো।

জুনের ১০ তারিখ।

বিয়ের এখনো পঁচিশ দিন বাকি। তাও বাবার সে কি অস্থিরতা। লাউড স্পিকারে

'(আমার দোয়া তুই নিয়ে যা যেন সুখ ভরা সংসার মেলে শ্বশুর বাড়ির আদরে যেন আমাদের কথা তুই যাস ভুলে।)'

এই গানটা ছেড়ে সারা ঘরে পায়চারির পদ চিহ্ন আঁকত। কি এক অজানা আশঙ্কায় উৎকণ্ঠা আর উদ্দীপনায় বাবাকে ভীষণ অস্থির লাগছিল।

বললাম বাবা, তুমি এত অস্থির হয়েও না। বিয়ের এখনো অনেক দিন বাকি। আর তা ছাড়া ওনারা তো ঢাকাতেই থাকে। যখন ইচ্ছে হয় তুমি যাবে আর তুমি ডাকলেই আমি হাজির হবো।

শুরু হলো ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন জীবন। একদিনের মধ্যেই স্বামীর বাবা-মা, ভাইবোনদের আপন করে নেওয়াই শুধু নয়, তাদের বড় গলায় সম্বোধনও করতে হবে। এক চুলও ছাড় নেই। তিন দিন পর বাবা আমাকে নাইয়র নিতে এলেন। বাবাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম, শাশুড়ি মা'র দিকে চোখ পরতেই মনে হলো, এটা সমীচীন হলো না বোধ হয়।

বিয়ের প্রায় ৮ মাস হয়ে গেল। আমার প্রেগন্যান্সির বয়সও পাঁচ মাস। বাবা প্রত্যেক শুক্রবার আমাকে দেখতে আসতো। একদিন, শাশুড়ি মা তার মেয়েকে বলছে, 'আমাদের কি মেয়ে নেই, আমরা কি শশুড় বাড়ি পাঠাইনি!' আমি শুনে ফেলেছি। ভাবলাম বাবা মনে হয় শোনেনি। শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে।

ঠিক এর পরের বৃহস্পতিবারে স্কুল ছুটির পর গেট থেকে বের হতেই দেখি বাবা গেটে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেমন ছোট্ট বেলায় আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো। বাবাকে দেখে ভেতরটা হুহু করে উঠল। বললাম, এখানে কেন বাবা?

'তোকে দেখতে ইচ্ছে করল।' তখনই বুঝতে পারলাম বাবা শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে ফেলেছে। তাই শুক্রবার আমার শশুড় বাড়ি যাবে না বলেই বাবা স্কুল গেটে দেখা করতে এসেছে। নিজেকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে এই নিয়ে আর কোনো কথা বললাম না।

চলো বাবা, ক্ষুধা লাগছে কিছু খাবো।

'না না মা, রেস্টুরেন্টে বসলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। দাদুভাই তোর পথ চেয়ে আছে, শেষে কান্নাকাটি করবে।' করুক, ওর আপনজন, দাদি-ফুফুরা আছে, তারা দেখবে। এভাবেই প্রতি বৃহস্পতিবার বাপ-বেটি লাঞ্চ করতাম রেস্টুরেন্টে। কেটে গেল দেড় বছর।

প্রত্যেক দিন সকাল বেলা মা-ছেলের কথোপকথন, 'আমি তোমাদের চার ভাইবোনকে পেলেপুষে বড় করছি, এখন কি তোমাদের ছেলে মেয়েকেও পেলেপুষে দিতে হবে। কিন্তু আমার তো বয়স হয়েছে, হেঁশেল সামলানো আর তোমাদের বাচ্চা সামলানো এসব আমি পারছি না।'

প্রতিদিন এমন অশান্তির কথোপকথনে আমি হাঁপিয়ে উঠে ছিলাম। স্কুল থেকে ফিরে হাতের সব কাজ শেষ করে যখন দুটো খেতে বসতাম, ছেলে তখন মা বলে ডাকতেই শাশুড়ি মা বলতেন, 'তোমার মা খাচ্ছে, খাওয়া শেষ করুক, তারপর ডেকো।' এমন খোঁচা দেয়া কথায় মনে হতো, আমার খাওয়াটাও পাপ।

একদিন রাতে স্বামী বলল, 'তোমার তো বেসরকারি স্কুলের চাকরি, ও তো ছেড়ে দিলেও আবার পাওয়া যাবে। ছেলে একটু বড় হলে আবার না হয় চাকরি করো। মা'র কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রোজ রোজ এই অশান্তি ভালো লাগে না।' বেশ তাই হবে। পরদিন অ্যাপলিকেশন দিলাম স্কুলে। আর বাবাকে বললাম, তোমার দাদুভাইয়ের জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিতে হচ্ছে, খুব চঞ্চল হয়েছে, শাশুড়ি মা সামাল দিতে পারছে না। বাবা তোমার সঙ্গে তো আর এভাবে দেখা হবে না। কিন্তু তুমি একদম চিন্তা করো না, আমি তোমার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলব।

সারাদিন একটার পর একটা কাজ। মনে হতো চাকরি করার সময় থেকে চাকরি না করার সময় বেশি ব্যস্ততা।

সব কাজ শেষ করে, সবার মন রক্ষা করে রাত ৮টায় বাবাকে ফোন করতাম যখন, স্বামী বলতো, 'কী এত কথা বলো বুঝি না! ছেলে ওই দিকে একা একা থাকে।' একদিন স্বামী ছেলেকে ভিজা অবস্থায় ওয়াশরুম থেকে নিয়ে এসে বলল, 'সারাদিন কী এমন কথা বলো, ছেলে ওয়াশরুমে গিয়ে ভিজতেছে সে খেয়াল আছে!'

বাবা শুনতে পায় যদি, তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিলাম।

ছেলেকে মুছাতে মুছাতে পিঠে দুটো চর লাগালাম, কেন গেলি ওয়াশরুমে, বল। অমনি শাশুড়ি মা'র সে কি চিৎকার! স্বামীও খুব রেগে গেল, পারলে গায়ে হাত তোলে আমার। মনে হলো আমি বুঝি ছেলের কেউ না। ওরাই ছেলের আপনজন, ছেলের প্রতি ওদের দরদ আমার থেকে বেশি।

এই প্রথমবার, বাঁধ ভেঙে কান্না পেল। মনে পড়ল বাবার কথা! বলেছিল, শশুড় বাড়ির আদরে যেন, তাদের কথা ভুলে যাই। হঁ্যা বাবা, এত আদর যে, তোমার কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে দেয় না। প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয়।

আস্তে আস্তে আমার ভালোলাগা ভালোবাসা শখ আহ্লাদ সবকিছু বিবর্ণ হতে লাগল। ছোট বেলা থেকেই একটু লেখালেখি অভ্যেস ছিল। এ বাড়িতে তাও সম্ভব নয়। দিনে সময় নেই এক বিন্দুও। রাতে লাইট জ্বালালে অন্যদের ঘুমের ডিস্টার্ব হয়।

আজকাল নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না।

নিজেকে বড্ডো অচেনা নিষ্প্রাণ লাগে।

নিজের কাছে নিজেই আজ বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

কে আমি?

শুধুই কী অবোলা মেয়ে মানুষ?

নাকি একটা জীবন্ত কলের পুতুল??

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে