সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমাজ রূপান্তরের কারিগর

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

ড. ফজলুল হক সৈকত
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (জন্ম : মুন্সীগঞ্জ ২৩ জুন ১৯৩৬) কমর্জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে একাডেমিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন দীঘির্দন। পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন ইংরেজি ভাষা। লিখেছেন বাংলা ভাষায়। সম্ভবত লেখক হবার চিন্তার কালে তিনি মাইকেলের ইংরেজিপ্রীতির কথা মনে করে থাকবেন। আর বোধকরি এও ভেবে থাকবেন যে, মধু কবি শেষপযর্ন্ত অনুধাবন করতে পেরেছিলেন মাতৃভাষায় সাহিত্যচচার্র কোনো বিকল্প নেই। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সমকালের সতকর্ লেখক। অসামান্য খ্যাতিও অজর্ন করেছেন গদ্যনিমার্তা এবং সাময়িকীর সম্পাদক হিসেবে। সমকালীন বাংলা ভাষার প্রথম সারির প্রাবন্ধিক তিনি। শুধু গদ্য রচনা নয়Ñ গদ্যসাহিত্যে লেখক তৈরির ক্ষেত্রেও তার অবদান বেশ। ত্রৈমাসিক নতুনদিগন্ত সম্পাদনা করছেন দীঘির্দন ধরে। এই কাগজটির মাধ্যমে তিনি প্রায় নীরবে সমাজ-রূপান্তরের অধ্যয়ন করে চলেছেন। শ্রেণি-সংগ্রাম নিয়ে যারা ভাবেন ও লেখেন, তাদের একটি নিভর্রযোগ্য প্ল্যাটফমর্ হিসেবে দঁাড়িয়ে গেছে পত্রিকাটি। বিশেষ ভাবধারার নতুন লেখক তৈরিতেও এর ভূমিকা স্মরণ করা যেতে পারে। শিক্ষক হিসেবে সমাজের প্রতি যে দায় ও দায়িত্ব রয়েছে, তার প্রতি তিনি সব সময় আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল। নিরন্তর সাহিত্য-সাধনা, গবেষণা আর জাতির চিন্তা-বিকাশে দিক-নিদের্শনার মতো অভিভাবকীয় কাজ করে যাচ্ছেন এই পরিশ্রমী গবেষক, রাষ্ট্রচিন্তক ও সাহিত্য-সমালোচক। সাহিত্যের নানানকৌণিক সমাজলগ্নতা এবং মানুষের চিন্তাবৃত্তির বিকাশে শিক্ষা ও প্রতিবেশের ভূমিকা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাবনা-বলয়ের প্রধান প্রধান বিষয়। শিক্ষাকে উপায়-অবলম্বন ভেবে যেমন সমাজের-রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবতর্ন সম্ভব, তেমনই সমকালীন সমাজ-রূপান্তরের ধারায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংযোগে মানুষের জীবন-যাপনকে আরো অথর্পূণর্ করা চলেÑ এইসব অভিনব চিন্তার সাথে বোধকরি চৌধুরীর সাধনার একটা চমৎকার যোগসূত্র আছে। তিনি মিডিয়া-সন্ত্রাস, মানুষের নৈতিক অবক্ষয় এবং লোভ ও লাভের নেশাগ্রস্ত মানব-সভ্যতার বিপরীতস্রোতে চলতে অভ্যস্ত। অন্যকে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চান নাÑ তার অভিলক্ষ্য হলো তরুণপ্রজন্মের সামনে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের দরোজাগুলোকে খুলে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাওয়া। জাতীয়তাবাদ চৌধুরীর সমাজলগ্নতার বিশেষ অধ্যায়। অবশ্য সমাজ কিংবা চলমান রাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলো পরিবতের্ন চৌধুরীদের কথা ও পরামশর্ যে খুব বেশি কাজে লাগছে, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তারপরেও তিনি থেমে নেই। নিজের ভাবনাবলয় খুলে ধরছেন সমকালের ও উত্তরকালের সচেতন মানুষের দরোজায়। বাঙালির জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার, রাষ্ট্রভূমি ও সমাজ-ব্যবস্থার ক্রম-পরিবতর্নধারা প্রভৃতি প্রসঙ্গ চৌধুরীর লেখালেখির বিষয়-আশয়। তিনি মনে করেনÑ জাতীয়তাবাদের পক্ষে যেমন বিপক্ষেও তেমনই অনেক কিছু বলার আছে, এবং থাকবে। জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেম এক বস্তু নয়Ñ জাতীয়তাবাদ অধিকতর রাজনৈতিক বিষয়। বাঙালির জাতীয়তাবাদ ভাষাভিত্তিক এবং আত্মরক্ষামূলক। একসময় এমন ধারণা ছিল যে, জাতীয়তাবাদ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করবে, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। না ঘটার কারণ হচ্ছে সামাজিক ও অথৈর্নতিক প্রবল বৈষম্য। বৈষম্যের মুখ্য প্রকাশগুলোর মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণিবিভাজন। সাম্প্রদায়িক কারণে বাংলা বিভক্ত হয়েছে, পরে প্রতিষ্ঠা ঘটেছে বাংলাদেশের, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও সব বাঙালি যে ঐক্যবদ্ধ তা নয়, এখানে ঐক্যের পথে প্রধান বাধা হয়ে দঁাড়িয়েছে মানুষে মানুষে সামাজিক দূরত্ব। সমাজচিন্তক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিশ্বাস ঐক্যের অন্তরায়গুলোকে চিহ্নিত করতে পারলেই সামাজিক সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবÑ অন্যথায় নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও অথর্নীতিতে, শিক্ষায়, নারীর রাষ্ট্রীয় অবস্থানে, শিশুর মযার্দা প্রতিষ্ঠায় রয়েছে বিপুল বৈষম্য। ভাষার দায় গ্রহণের ব্যথর্তা, ধমির্নরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মধ্যবিত্তের অপরাগতা আর আমলাতন্ত্রের অনাকাক্সিক্ষত প্রভাব বাঙালি সমাজে সম্প্রীতি স্থাপনে প্রধান প্রধান অন্তরায়। এইসব অন্তরায় দূর করার উপায় বের করার কৌশল আবিষ্কার এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার নৈতিক সংগ্রামÑ বৃদ্ধিবৃত্তিক ও শিক্ষাকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার একটা প্রত্যয় চৌধুরীর লেখায় আমরা পাই। ইংরেজরা ভারত ছেড়েছে বটে কিন্তু আমরা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধারণা প্রতিষ্ঠা করার পরিবতের্ আমরা দিনে দিনে শ্রেণি-সমাজ ও বৈষম্য সৃষ্টি করেছি। চিন্তার এবং বিশ্বাসের মূল ¯্রােত থেকে আমরা ক্রমে ক্রমে দূরে সরে পড়েছিÑ এই কষ্ট কুরে কুরে খাচ্ছে চৌধুরীর মন ও মননকে। গবেষক-প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর নাম পাঠ করলেই আমরা তার চিন্তা-পরিসর সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে পারিÑ জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি : ১৯০৫-১৯৪৭, উপরকাঠামোর ভেতরেই, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি, দুই যাত্রায় এক যাত্রী, শেকসপিয়রের মেয়েরা, লিও টলস্টয় : অনেক প্রসঙ্গের কয়েকটি, দ্ইু বাঙালীর লাহোর যাত্রা, স্বাধীনতার স্পৃহা সাম্যের ভয়, বিচ্ছিন্নতার সত্য-মিথ্যা, রাষ্ট্র ও কল্পলোক, মাঝখানের মানুষেরা, কত মূল্য লইবে ইহার, উপনিবেশের সংস্কৃতি, নেতা জনতা ও রাজনীতি, লেনিন কেন জরুরি, বাঙালির জয়-পরাজয়, ১৮৫৭ এবং তারপর, কালের সাক্ষী। চৌধুরীর লেখাজোখার মূল বিষয় রাজনীতি। তবে নিখাত সাহিত্যচচার্য়ও তার সাফল্য ও খ্যাতি কম নয়। বিশেষ করে শেকসপিয়রের মেয়েরা, লিও টলস্টয় : অনেক প্রসঙ্গের কয়েকটি গ্রন্থগুলোর পাঠ থেকে অন্তত সেরকম ধারণাই আমরা পাই বটে। আবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এবং আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বিষয়ে কিংবা যারা তাকে পথ দেখিয়েছেন, তাদের সম্পকের্ লিখতেও তিনি ভুল করেননি। মাঝখানের মানুষেরা তার একটি আত্মস্মৃতিমূলক বই। সাহিত্যসেবক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালে জাতির একজন একনিষ্ঠ অভিভাবক। কল্যাণময় রাষ্ট্র ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি নিরলস সাধক। কথায়, জীবনাচরণে, লেখায় এবং সাংগঠনিক কাজে সবসময় তিনি লালন করেন পরিবতর্নকামী প্রবল এক চেতনা। তঁার সংগ্রামের পথ ধরেই হয়তো বাংলাদেশে কোনো একদিন ঘটবে চিন্তার রূপান্তর এবং সংঘটিত হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লব। জাতির চেতনা বিকাশে এই দিক-নিদের্শকের প্রেরণা ও উৎসাহ একদিন ঠিকই সকলের সামনে আরও স্পষ্ট ও বোধগম্য হয়ে প্রকাশ হবেÑ এই মনীষীর জন্মদিনে এইটুকু কেবল প্রত্যাশা।