গ্রন্থালোচনা

ভ‚মিপুত্র

প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ড. রানা গুপ্ত
কবি সমরেশ দেবনাথের ‘ভ‚মিপুত্র’ (পরিবধির্ত বেশ কিছু নতুন কবিতায়) একটি কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ একথা ইতস্তত না করেই বলা যায়। বহু আলোচিত এই গ্রন্থটির কথা বতর্মান আলোচকের দেবনাথকে নিয়ে লেখা অনেক প্রবন্ধে-নিবন্ধেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাই ঢ়ৎবংবহঃ ফরংপঁৎংরড়হংটি হয়তো কিছুটা ফিরে দেখার মতোই হবে। মোট ৫৮টি কবিতা এই কাব্যগ্রন্থজুড়ে বিরাজমান সেগুলোর প্রতিটিই স্বাদে-সৌরভে এক একটি নানা বণের্র মালার সমাহার। গ্রন্থের প্রথম কবিতাটিই ‘ভ‚মিপুত্র’ (ড়ৎ, ঃযব ংড়হ ড়ভ ঃযব ংড়রষ) যেখানে তিনি সরাসরি বলতে পেরেছেন- ‘প্রযতেœ-ট্রযতেœ নয়, আমি সরাসরি ভ‚মিপুত্র’। শহর কোনো মানচিত্র তৈরি করে না’য় লিখছেন, পাঠককে কিছুটা হতচকিত করেই : ‘শহর কোনো মানচিত্র তৈরি করে না। তাকিয়ে দেখো আমাদের গ্রাম। শহর এদিকেই আসছে।’ বাংলাদেশের মহাকবি তিনি, কিন্তু চিন্তায় মেধায় মননের তিনি অখÐ বাংলার তথা ভারতের-তথা সমগ্র পৃথিবীর। যদিও ভ‚মিপুত্রের কবিতায় চিরকালীন বাংলাদেশেরই ছবি, তথা দুই বাংলার অতীত বতর্মানের সংস্কৃতির সমগ্রটাই তার কবিতায় প্রতিফলিত। একই কবিতায় যদিও বাস্তব চিত্রই ফুটে উঠেছে : ‘গ্রামে কি কেউ ফিরতে পারে?/আমি তো এসেছি মনের জোরে।’ তাই ‘গ্রামে ফেরা’ কবিতায় লিখছেন আমার প্রাণ এখন চলে যাচ্ছে/ অন্যদের গ্রামের ভেতর...’ তাইÑ ‘আমার গন্তব্য এখন/আমারই পকেটে।’ প্রকৃতি প্রেম, নিসগর্ তবু একই কথা থেকে থেকে বলে যায়; ‘বৃক্ষের সংসারে একা। কবিতাটিতে যেমন : মানুষ যখন দঁাড়ায়Ñ তখন সে বৃক্ষ/ আর বৃক্ষ যখন হঁাটে-তখন সে মানুষ।’ অস্ট্রিক কবি তাই কখনো পাখি হত্যা নিয়েও কবিতা লেখেন, অনুভবে, মরমে যা বড় যন্ত্রণাদায়ক, করুণ হয়ে ওঠে। লাঙল দিয়েও যেমন চাষ হয় তেমনি কলম দিয়েও, ‘কৃষক’ শব্দটিকে তিনি পিতার মযার্দা দিয়েছেন যথাথর্ভাবেই, অন্যবদ্য যার ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ ‘চাষবাস’ ও ‘নিজের বাবা’সংক্রান্ত কবিতাতে যেখানে তিনি আগে কৃষক, পরে লেখক বা কবি, বা ‘জানাির্লস্ট’। প্রকৃত কবিতা/শিরোনামের কবিতাটিতে প্রকৃত কবিতার সন্ধান কোথায় মেলে এ কথা ভাবতে কবি পাখিদের কাছে গেছেন, গেছেন বৃক্ষের কাছে, অতঃপর নদী ও শেষে পাহাড়ের কাছে... এ এক অনবদ্য, অদ্ভুত কবিতা যা আমাদের অজেয়বাদের দিকে টেনে নিয়ে যায়; তবে কি নিসগর্, প্রকৃতি রাজ্যই কবিতা অথবা কবিতার মতো, যা অনুভ‚ত হয় অথচ লেখা যায় না কোনোভাবেই...! আবার অন্যদিকে বিশ্বপরিস্থিতি মাথায় রেখেই ‘বঙ্গপিতা’-কে শুধোচ্ছেন, দাসের এ দেশে/ কেন এত উজ্জ্বল হলে তুমি?/ পিতা, মুক্তি কি জানেনা এই দাস বংশ! (ইধশঃরহ/ফরধষড়মঁব); অন্যদিকে জীবনের কথা লিখতে গিয়ে তিনি একাধারে যেমন সৎ প্রজ্ঞামন হয়েছেন অন্যদিকে তেমনই সরল, ঋজু : এ হৃদয় অনেক ভুল করেছে/ তারপরও ভালোবাসার কাছে যেতে হয়েছে।’ গোলাপ ও রবীন্দ্র কবিতায় কবি গোলাপের সঙ্গে রবীন্দ্রের তুলনা করেছেন তার অনন্য স্বকীয়তায় কবি শীষর্ক কবিতায় লিখছেন : একদিন বিদায় নিয়ে চলে যাবে প্রেমিক পুরুষ/কবি পরিচয়ে এ গ্রহে যার বেড়ে ওঠাÑ! সে কাউকে জ্বালায়নি, জ্বলেছে একা একা/নিত্য চিতা ছিল তার বুকের দু’ভাগে; শুধু কৃষক পিতাই, নয় মাতৃ আরাধনাও পাশাপাশি চলে আসে জীবনে, দুনির্বার পথ চলায়, রক্তক্ষরণে মা, ‘তোমার কাছে থাকা মানেই/সারা দেশে থাকা...’ ‘সুন্দরবন... সংক্রান্ত কবিতাটিতে লিখছেন সেই নিসগর্ প্রেম হয়েই’ : তুমি কেন্দ্রবিন্দুতে ধরে রেখেছো/সুগন্ধি কস্তুরী/যার ঘ্রাণ বাতাস বাহিত হয়ে চলে আসে/আমার নাসামূলে,/আমি তোমাকে গ্রহণ করি গোল মুদ্রা ভেবে/হঠাৎ মুদ্রা ভেঙে বেরিয়ে আসে/বনের পোশাক। ‘কয়েকজন কবির সাথে সহবাস’ কবিতায় রেখেছেন দুই বাংলার কবিকেই যারা হলেন : রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, জহর সেন মজুমদার, জয় গোস্বামী, রণজিৎ দাস, আবুল হাসান, ভাস্কর চক্রবতীর্Ñ এ ছাড়া বিশ্বের খ্যাতনামা ডেরেক ওয়ালকট, সীমাস হীনি, টমাস ট্রান্সট্রোমার, যাদের প্রতি কবির অন্তরের অনুভব বিধৃত হয়েছে এক অতিবিরল চেতনায়। ‘ঋষি ও বৃশ্চিক’-এর একদিকে সজ্ঞা তো অন্যদিকে প্রজ্ঞা হয়েছে, অতি উন্নতমানের ঢ়ধৎধনষব; সাধারণ ছোট্ট ছোট্ট ঋধনষব, ঢ়ধৎধনষব, ধষষবমড়ৎু-তে দেবনাথকে আমরা পাইথ এক. ‘প্রকৃত কবি’ হিসেবে, দুই. বাংলায় যার জুড়ি নেই কোনো; পরমাণু কবিতার ৫টিই যরমযষু ধঢ়যড়ৎরংঃরপ ‘এপিটাফ’ কবিতাটি বড় বেদনাময়, করুণ সুরে বাজে, জানতে ইচ্ছে হয়, কবিকৃতীর মধ্য গগনে এসে হঠাৎ এই এপিটায়। এও কি কাক্সিক্ষত ছিল! ‘উদ্ভিদের জন্মদিন’ কবিতাটি অতি উৎকৃষ্ট মানের; লিখছেন, ‘একজন মানুষ যখন বৃক্ষকে কাটে/তখন সে নিজেকেই কেটে ফেলে;’ বাতাসে অক্সিজেন গাছ ছাড়া আর কেই-ই বা দেয়! পরের পরমাণু কবিতার ৪টি সম্পকের্ প্রায় একই কথা বলা চলে; বিদ্যাসাগরের চরণ ছাপ কবিতার শেষ লাইনগুলো যেন গবেষণালব্ধ এবং সবাের্থর্ই সত্য, যেনও বা দেবনাথের আবিষ্কার তাÑ ‘অথচ এই ভাষা-মৃত্তিকা থেকে/ যে ব্যাকরণ তৈরি হচ্ছে/তাতে রয়েছে বিদ্যাসাগরের চরণ ছাপ! কবি পৌলমী সেনগুপ্তকে উৎসাহিত কবিতাটি কবীর চৌধুরী স্মরণে লিখিত এক অসামান্য কবিতা; তার অনন্যতা ধরা পড়ে এই সমস্ত লাইনে; ‘বাক্সটা আসলে কফিন, আর কবীর চৌধুরী মৃত নন, সাংঘাতিক রকমের জীবিত সেখানে : একটি জাতির সংস্কৃতি ওখানে ঘুমিয়ে/হাত দিলেই জেগে উঠবে, বলবে, শামসুর কোথায়?/ নিমের্লন্দু কি এখনো কবিতা লেখে?/ ছবি অঁাকে কি কাইউম?/ হুমায়ুনকে হত্যা করে ও কি সাহসকে হত্যা করেনি?/ রোদ ফিঁকে হয়ে যায়, সমরেশ, তোমাদের অনুষ্ঠান কয়টায়? ...(বাক্স)। ‘ভ‚মিপুত্র’-র পাশাপাশি একটি মাত্র কবিতা এ কাব্যগ্রন্থে যা বৈপ্লবিক (জাতীয়তাবোধে) ও বিদ্রোহী, যদি জীবন-অজীবনের অনেকদিকেই সোচ্চার হয়েছে তার সামগ্রিক কমর্কাÐে, অন্যান্য কবিতায় (এ গ্রন্থে বিশেষত) কলকাতাকে ভালোবাসে লিখছেন : ‘ঢাকা আমার নয়নের মণি/কলকাতা আমার হৃদয় (আহ ঢাকা, আহ কলকাতা)। এ শুধু কথার কথা নয়, হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা ভালোবাসার নিযার্স... আজ আপাতত এটুকুই বলা, এটুকুই ...