বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
গ্রন্থের প্রভাব পাঠক চিত্তে একটা বিশাল অংশজুড়ে থাকে। মহাকবি গ্যাটে পাঠের মাধ্যমেই অপার ও নির্মল আনন্দ খুঁজে পেতেন। পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন, 'রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।' মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, সেহেতু চিরদিনই সে সঙ্গ পেতে চায়। আনন্দ লাভের মানসেই সে অহরহ সঙ্গ কামনা করে। সেই লক্ষ্যে সে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এক পর্যায়ে সংসার বন্ধন তৈরি করে নেয়। অথচ এমন প্রিয় মানুষটিও এক সময় তাকে কাঁদায়, প্রতারণা করে। মানুষের কাছে মানুষ বঞ্চিত হয়। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে ঠকায়। কিন্তু বই মানুষের এমন এক নিঃস্বার্থ বন্ধু, সে কখনো কারো সঙ্গে প্রতারণা করে না, কাউকে প্রবঞ্চিত করে না, ঠকায় না। সে নিঃস্বার্থভাবে তার পাঠককে নীরবে সবচেয়ে আপন বন্ধুরমতো কাজ করে যায়। সে ক্রমে ক্রমে তার বন্ধুর জ্ঞান রাজ্যকে সমৃদ্ধ করতে থাকে। মানুষ যখন নিতান্ত একাকিত্ব অনুভব করে তখন বই তার সবচেয়ে আপন বন্ধুর ভূমিকা পালন করে। 'বই পড়া' প্রবন্ধের লেখক প্রমথ চৌধুরী স্বেচ্ছায় বই পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আমাদের সমাজব্যবস্থা আমাদের সেই সুযোগটি দেয় না। আমরা সবাই অর্থ উপার্জনের চিন্তায় মশগুল। তাই যে বই পড়লে পেশাগত উপকার হবে বলে আমরা ভাবি, শুধু সেই বই-ই পড়ি। এভাবে বই পড়াতে নেই কোনো আনন্দ। আর এই চর্চার ফলে জাতি হিসেবে আমরা হয়ে উঠছি অন্তঃসারশূন্য। জীবনে পরমার্থ অর্জনের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বই। 'বই পড়া' প্রবন্ধে সে কথাই বলা হয়েছে। আমাদের শিক্ষিত শ্রেণি নিতান্ত বাধ্য না হলে বই পড়ে না। পড়ে না এতে উদরপূর্তি হয় না বলে। পরীক্ষা পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়। প্রকৃত শিক্ষিত হতে হলে জীবনের পরম সত্য বা পরমার্থকে উপলব্ধি করতে হবে এবং তা অর্জন করতে হবে। শিক্ষিত হতে হলে মন ও জ্ঞানের প্রসার দরকার। এ প্রসারতার জন্যই বই পড়া আবশ্যক। এ কারণেই প্রমথ চৌধুরী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বই পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রগতিশীল জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে সাহিত্য চর্চার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মিক উন্নতি ঘটে। এই অভ্যাস ব্যক্তিকে স্বশিক্ষিত করে তোলে। তাই 'বই পড়া' প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী আমাদের পাঠ চর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে বলেছেন। পাঠ চর্চার অভ্যাস গড়তে পারলেই একজন যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠা সহজ হয়। আর এক্ষেত্রে লাইব্রেরির ভূমিকা অগ্রগণ্য। জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত জীবনযাপন করতে হলে স্বশিক্ষিত হতে হবে। এজন্য দরকার বেশি বেশি বই পড়া। বই পড়ার চর্চার জন্য আমাদের প্রয়োজন লাইব্রেরি। সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতি উপজেলা ও গ্রামে একটি করে লাইব্রেরি স্থাপন করতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বটে কিন্তু সেই তুলনায় বই পড়া মানুষের সংখ্যা উলেস্নখযোগ্যভাবে বাড়েনি। এ চিত্র হতাশাব্যঞ্জক। এ দেশে প্রত্যেকটি জেলায় গণগ্রন্থাগার রয়েছে। এসব গণগ্রন্থাগারের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। একদিকে চুরি হওয়ার ফলে বইয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে অনেক পুরনো মূল্যবান বইও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে আমরা হারাচ্ছি মণিমাণিক্যের চেয়েও মূল্যবান সম্পদ। দেশের পুরনো কলেজগুলোর গ্রন্থাগারেও অনেক পুরনো মূল্যবান বই আছে; কিন্তু যত্নের অভাবে সেগুলো বিলুপ্তপ্রায়। বইপড়ার মতো একটি অনিন্দ্য সুন্দর চর্চাকে উৎসাহিত করতে আমাদের নীতি নির্ধারকদের এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার ফলে বারবার হোঁচট খাচ্ছে একটি মানবিক ও সৃজনশীল সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত এক শ্রেণির মুনাফালোভী, প্রচারমুখী লেখকের আবির্ভাব। যারা কিশোর- তরুণদের আবেগকে পুঁজি করে রাতারাতি 'বেস্ট সেলার' বনে যাওয়ার নেশায় উন্মুখ। লেখক তো নয়ই- সারাদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ভঙ্গিতে ইনিয়ে বিনিয়ে আত্মপ্রচারে মত্ত এই গোষ্ঠী- বস্তুতপক্ষে আদর্শ, চিন্তাশীল পাঠক গড়ার পথে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। ফলস্বরূপ, পাঠরুচির দৈনতা সৃষ্টির পাশাপাশি ভাবনার জগতে তৈরি হচ্ছে নেতিবাচকতা। বিশেষত, যে বয়সি তরুণ-তরুণীদের কেন্দ্র করে, যাদের মেধা, মনন ও চিন্তার ওপর ভর করে একটি নান্দনিক, মুক্তচিন্তার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা হয় ঠিক তাদেরই টার্গেট করে লেখক নামধারী চক্রটি মানহীন বই ছাপিয়ে পাঠকদের ঠকাচ্ছে। বই পড়া যে, সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, এটা আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। বেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলো এবং বড় বড় ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলো যত উদারভাবে নাচ-গানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা করে, সেই তুলনায় বই পড়াকে উৎসাহিত করে না এবং গ্রন্থাগারে বইয়ের সংগ্রহ যোগ করার ব্যাপারে তারা উৎসাহী নয়। এ ধরনের একমুখী চিন্তা পরিহার করতে হবে। সরকারের গ্রন্থাগারগুলোকে সমৃদ্ধ করার জন্য অর্থ বরাদ্দ বহুগুণে বৃদ্ধি করতে হবে। বই সংগ্রহের নামে রাজনৈতিক বিষয়ক লেখা বইগুলো সংগ্রহ করাই যথেষ্ট নয়। দেশের বইপ্রেমী গুণীজনদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখার বই সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে এ দেশে যেন ইউএস লাইব্রেরি অব কংগ্রেস অথবা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মতো গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো খাতে আমরা অনেক অর্থ বিনিয়োগ করছি। কিন্তু রাস্তাঘাট, ব্রিজের মতো অবকাঠামোর চেয়েও জ্ঞানের অবকাঠামো সৃষ্টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটি সভ্য, সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রতিটি পাড়ায়-মহলস্নায় ও গ্রামে পাঠাগার ও পাঠচক্র গড়ে তোলার আন্দোলন শুরু করা দরকার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। ই-বুকও অবশ্যই এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এখন মোবাইল ফোনেও ই-বুক পড়া ও আদান-প্রদান করা যায় খুব সহজেই। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। লেখকরা মননশীল ও বৈচিত্র্যময় লেখার মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করবেন। প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে আরও সহনশীল মূল্যে বই বিক্রির উদ্যোগ নিতে হবে। অভিভাবকরা বই পড়ার বিষয়ে উৎসাহিত করবেন সন্তানদের। এভাবে বই পড়াকে সামগ্রিক একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। পাঠক বইয়ের কাছে না গেলেও বইকে নিয়ে যেতে হবে পাঠকের নাগালের মধ্যে। স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে বড় বড় বিপণিবিতানের মতো জনমানুষের প্রধান প্রধান বিচরণের জায়গাগুলোতে গড়ে তুলতে হবে বইয়ের দোকান কিংবা পাঠাগার। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা মোটেও কম নয়। বড় শপিং কমপেস্নক্সগুলোতে কয়েকটি বইয়ের দোকানের শর্ত জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। এমনকি ছোট ছোট চায়ের দোকানকে কেন্দ্র করেও পাঠাগার ও পাঠচক্র গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রত্যেক বছর স্কুল-কলেজগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বইপড়া কর্মসূচি চালু করতে হবে। যেমন- নতুন শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীদের সরকারিভাবে পাঠ্যবই বিতরণের সময় অতিরিক্ত হিসেবে বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী, সাধারণ জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ক যে কোনো একটি বই উপহার হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। সভ্য ও শিক্ষিত সমাজে বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান প্রগতিশীল বিশ্বে সর্বত্রই চলছে প্রতিযোগিতা। আর এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারলে জীবন হবে সম্পূর্ণ নিরানন্দময় ও অর্থহীন। এ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে মানুষকে অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে হয়। আর জানার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে বেশি বেশি বই পড়া। মানুষকে ভালোভাবে বাঁচার জন্য, জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই একটি উত্তম বই যেমন নিত্যদিনের বন্ধু, তেমনি একজন শিক্ষকও বটে- যিনি মানুষ গড়ার কারিগর বলে অভিহিত। জগতে যারা মরেও অমরত্ব লাভ করেছেন, প্রাতঃস্মরণীয় হয়েছেন, তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রথম এবং প্রধান বিষয় ছিল বই পড়া। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করে থাকে গ্রন্থসমূহ। গ্রন্থের সাহচর্যেই মানুষ অগ্রসর হয়ে চলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রম অগ্রযাত্রার পথে। আমাদের জীবনের চলার পথে সবচেয়ে বড় সঙ্গী বরেণ্য মনীষীদের লেখা মূল্যবান বই। তাই কেবল বইয়ের মাধ্যমেই এসব মনীষীদের চিন্তাধারা সম্পর্কে জানতে পারি এবং একই সঙ্গে পরিচিত হতে পারি তাদের মহৎ কর্মকান্ডের সঙ্গে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলে গিয়েছেন- 'মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।' বড় স্বপ্ন দেখতে হলে এবং জ্ঞানার্জন করতে হলে ছাত্রজীবন থেকেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক গ্রামগঞ্জে যদি একটি করে পাঠাগার গড়ে তোলা যেত এবং প্রতি বছর বই কেনার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির বই পড়ার সুযোগ হতো। ফলে জ্ঞানের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। এ জন্য সারাদেশে স্কুল-কলেজের বার্ষিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই প্রদান করতে হবে। তাহলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পাঠাভ্যাস তৈরি হবে এবং নিজেদের মেধা-মননের বিকাশ হতো। এ জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বিভাগ থেকে স্কুল-কলেজের বার্ষিক সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই প্রদানের জন্য দিকনির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। আত্মীয়স্বজনের বিয়ে, জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীতে উপহার হিসেবে প্রিয়জনকে বই কিনে দিতে হবে। বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজ চালু হলে সারাজীবন ঘরে বই শোভা পাবে ও বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তাই অমর একুশের গ্রন্থমেলা থেকে যার যার পছন্দমতো বই কেনা, বই উপহার এবং বই পুরস্কার দেওয়ার সুন্দর মানসিকতা গড়ে উঠুক। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে বই পড়াকে সামগ্রিক একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। পাঠক বইয়ের কাছে না গেলেও বইকে নিয়ে যেতে হবে পাঠকের কাছে। আর তাহলেই পাঠক সমাজ তৈরি হবে। বইকে সার্বজনীন করা যাবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সুস্থ ও সভ্য সমাজ গঠনে গ্রন্থ পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, আলোকিত জীবন গঠনে বইয়ের ভূমিকা খুবই ব্যাপক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। পাঠাভ্যাস জাতিকে মেধা ও মননশীল হিসেবে গড়ে তুলতে এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে থাকে। সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই আসুন, 'পড়লে বই আলোকিত হই' এই স্স্নোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি পাঠমুখী পরিবেশ ও সুশীল সমাজ গঠনে সবাই মনোযোগী হই। সেদিন বেশি দূরে নয়, পাঠমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেই আমরা বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে মর্যাদার আসন লাভে সক্ষম হব।