জলজ জীবন

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
সূযের্র অসহনীয় তাপ মাথায় নিয়ে ঘন ঘন পা ফেলে সৈয়দ সাহেব ব্যস্ত ও জনকোলাহলপূণর্ নগরী ঢাকার ফুটপাত ঘেঁষে অবিরাম হেঁটে চলেন। আজ তার জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে বেঘোরে প্রাণপাতের আশঙ্কা যে ঢাকা নগরীতে সবচেয়ে বেশি এ কথা জেনেও তিনি সম্পূণর্ মনোযোগহীনভাবে রাস্তা চলতে থাকেন। ঘামে ও ক্লান্তিতে তার সারা শরীর একাকার হয়ে গেছে। যেন সে পঁাচ কিলোমিটার ঠেলাগাড়ি চালিয়ে এসেছেন। হেঁটে হেঁটে তিনি কোথায় যাবেন, ঠিক এ মুহ‚তের্ যাবার কোনো জায়গা আছে কিনা তাও আজ তার বোধের মধ্যে নেই। প্রথমে হঁাটার সময় যতটা বিরক্তি তার মধ্যে কাজ করেছেÑ মাত্রা কমে এসেছে পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে, কয়েক পবর্ ঘাম-গোসল শেষ হওয়ার পর। এই অবস্থায় তিনি এক জায়গায় স্থির দঁাড়ালেন, তাকালেন আকাশের দিকে। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। মুহূতের্ চোখের কোণে পানি জমে গেল। নিজেকে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ও বিপন্ন মানুষ। এবার তিনি রাস্তার দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা চালালেন। রাজপথে গাড়িরও যেমন শেষ নেই, একইভাবে মানুষের ব্যস্ততারও শেষ নেই। কে কাকে কত দ্রæত অতিক্রম করে যেতে পারবে সে চেষ্টায় সবাই যেন ব্যস্ত। এ যেন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কেবল ব্যস্ততা নেই তার মধ্যে। তিনি আজ দিশাহারা, ভাষা-হারা। স্বামী হিসেবে তিনি ব্যথর্ কিংবা অযোগ্য অথবা স্ত্রীর শাড়ি-গহনা-টাকা-পয়সার চাহিদা তিনি পূরণ করতে পারেননি এমন কোনো অভিযোগেই আজ তিনি রাস্তায় নামেননি। তিনি আজ রাস্তায় নেমেছে শাকিলার একটি মাত্র অভিযোগে। এই অভিযোগের সঙ্গে যোগ হয়েছে তার ব্যক্তিগত তীব্র অশোভন আচরণও। ‘পঁচিশ বছরে তুমি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করোনি। তুমি একজন মানসিক রোগী। তোমাকে হাসপাতালে পাঠানো উচিত।’ শাকিলার এমন তিযর্ক মন্তব্যে ভাষা হারিয়ে ফেলেন জাবের সৈয়দ। শাকিলা বিগত পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে অনেক গা-জ্বালা করা কথা বলেছে এবং সৈয়দ সাহেব তা অবলীলায় হজমও করেছেন। কখনো কখনো উত্তর দিতে গিয়ে তোপের মুখেও পড়েছেন। কিন্তু আজকের ঘটনা সম্পূণর্ অন্য রকম। শাকিলা আজ তার দাম্পত্য জীবনের মূল্যায়ন করেছে, তার ভাষায়। সৈয়দ সাহেব ভাষাহীন হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, শাকিলাকে কেন্দ্র করে তার ত্যাগ সংগ্রাম ভালোবাসা সব ধুলোয় মিশে গেল নিমিষে। মনের গোপনে দীঘির্দন লালন করা সত্যই আজ সে বলেছে, যা সৈয়দের পক্ষে হজম করা সম্ভব হচ্ছে না। কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলতে গিয়ে হয়তো বা তিনি দু-চারটে আপত্তিকর কথা বলেছেন রাগত কণ্ঠে। তার মানে এই নয় যে টানা পঁচিশ বছর তিনি ওর সঙ্গে দুবর্্যবহার করেছেন। পুরুষরা তো যখন-তখন ঠুনকো কারণে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন। অথচ তিনি একবারও শাকিলার গায়ে হাত তোলেননি, ও শত অপরাধ করলেও। আর তাকেই না আজ এমন নিষ্ঠুর কথা শুনতে হলো। জাবের সৈয়দ একজন নামকরা গীতিকবি। তার গানে সুর করেছেন ও কণ্ঠ দিয়েছেন দেশের খ্যাতিমান সুরকার ও শিল্পীরা। তিনি জীবনে অনেক অনিন্দ্য সুন্দরী নারীর মন জয় করেছেন। কেবল একজনের মন জয় করতে পারেননি, সে হচ্ছে শাকিলা। দুজনের মধ্যকার বয়সের পাথর্ক্য বারো বছরের। ৩০ বছর বয়সে ১৮ বছরের তরুণীকে ঘরে আনেন তিনি। তখন তার এক বান্ধবী বলেছিল- ‘সৈয়দ তুমি একটি বালিকাকে বিয়ে করেছো, ও তো তোমাকে বুঝতে পারবে না। জীবনে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিলে।’ বান্ধবী শিলার কথাকে পাত্তা দেননি তিনি, ভেবেছিলেন কম বয়স তাতে কী, ওকে শিখিয়ে নেয়া যাবে। শাকিলা তার কথামতো চলবে। সৈয়দ সাহেবের ধারণা ছিল ভুল। শাকিলার জন্মদিন ও বিয়েবাষির্কীতে শহরের সবচেয়ে বড় ও দামি ফুলের তোড়া উপহার দেন তিনি। এই দুটো বিশেষ দিনে তিনি ভোরবেলা বাসা থেকে বের হয়ে অন্তত পঁাচটি ফুলের দোকানে যাবেন। যে দোকানে সবচেয়ে বড় ও দৃষ্টিনন্দন ফুলের তোড়া পাওয়া যাবে, দাম যতই হোকÑ এ ক্ষেত্রে তিনি কৃপণতা করবেন না। বিয়ের ২৫ বছর ধরেই সৈয়দ সাহেব এ কাজ করে আসছেন। বছরে দুবার এ কাজ তাকে করতে হয় প্রাণের তাগিদে। তিনি মনে করেন শাকিলা ২৫ বছর সংসারকে আগলে রেখেছে। একমাত্র মেয়েকে মানুষ করার পেছনে তার ভ‚মিকাই অগ্রগণ্য। সংসারে এসে প্রথম জীবনে সে কষ্টও কম করেনি। এই বিবেচনায় সে একজন মহীয়সী নারী। তার জন্মদিন পালিত হওয়া উচিত। স্ত্রীকে ভালোবাসা কঠিন কাজ এটা তিনি জানেন। কারণ স্ত্রী যদি হয় রুক্ষ বদমেজাজি ঝগড়াটে পরদিনন্দা পরচচার্য় মনোযোগী, লোভী এবং সংসারবিমুখ তাকে একজন স্বামী কী করে ভালোবাসবে। এই ধরনের স্ত্রীরা সংসারে অশান্তির কারণ হয়ে দঁাড়ায়। স্বামী যদি অত্যন্ত বিনয়ী সহনশীল ভদ্র এবং স্ত্রৈণ হয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে তিনি হয়তো স্ত্রীকে ছাড় দেবেন, সংসার ও ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরব থাকবেন। একইভাবে স্বামী যদি সংসারের প্রতি উদাসীন থাকেন, থাকেন অন্য নারীর প্রতি আসক্ত তা হলে ত্যাগী ধৈযর্শীল স্ত্রীরা সংসার ও সন্তানের প্রতি তাকিয়ে নীরব ভ‚মিকা পালন করেন। উভয় ধরনের স্বামী-স্ত্রীই সংসারে রয়েছে। তিনি মনে করতেন ‘উত্তম’ স্ত্রী পাওয়া সৃষ্টিকতার্র অশেষ দান। উত্তম স্ত্রী মানে মনের মতো, যা কেবল নাটক সিনেমায় দেখা যায়, বাস্তবে নয়। সমাজ দ্রæত বদলে গেছে। মানবিকতা প্রেম ভালোবাসা ত্যাগের পরিবতের্ মানুষের মধ্যে বিপজ্জনকভাবে বিস্তার করেছে অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা পৈশাচিকতা। স্বামী-স্ত্রী যে গভীর বন্ধন ভালোবাসা জীবন ও সংসারের অনিবাযর্ অংশ এটা এখন আর সমাজ সংসারে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। সামান্য যৌতুকের কারণে স্ত্রীকে অবলীলায় হত্যা করা হচ্ছে। স্ত্রী ব্যভিচারী বা পরকীয়ার অভিযোগ তুলে কখনো কখনো হত্যা করা হচ্ছে। কেবল স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করছে না, স্ত্রীও স্বামীকে হত্যা করছে। এ ধরনের খবর প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় উঠে আসছে। যেসব দম্পতি এসব কাজ করছেÑ তারা কি সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করছে এমন এক প্রশ্ন তার সামনে বড় করে উঠে এলো। তিনি যে স্ত্রীর জন্মদিনে এবং বিয়েবাষির্কীতে শহরের সবচেয়ে বড় ফুলের তোড়া উপহার দেন এর উপযোগিতা হারাচ্ছে এসব পারিবারিক নিষ্ঠুর ঘটনায়। তিনি মনে করেন, স্ত্রীকে ভালোবাসা তার কতর্ব্য। কেবল শরীরী আনন্দ দেয়ার কারণে নয়, স্ত্রী তার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সংসার ও সন্তান আগলে রেখেছেন তিনিই। একজন পুরুষ হিসেবে তাকে অমযার্দা করার সুযোগ নেই। তার এই কথার সঙ্গে একমত নন, তার বন্ধু সজীব সাহেব। তার মত হচ্ছে, সব স্ত্রী একরকম নয়, স্ত্রী ব্যভিচারী হতে পারে, হতে পারে ঝগড়াটে মারমুখো হিংস্র । যিনি অতিথি ও স্বামীপক্ষের আত্মীয়স্বজনদের দেখলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। এমন স্ত্রী যদি কারও ভাগ্যে জোটে তখন একজন স্বামীর পক্ষে তাকে ভালোবাসা, তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করা কতখানি সম্ভব? এ ক্ষেত্রে সৈয়দ সাহেবের বক্তব্য হচ্ছে ভালোমন্দ মিলিয়েই সংসার। প্রত্যেকেরই ভালোবাসার ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা থাকতে হবে। সজীব সাহেব আরও বললেন, স্ত্রী দিনের পর দিন অপরাধ করে যাবে আর স্বামী তা নীরবে সহ্য করবে কেন? একইভাবে স্বামী অপরাধ করলেও স্ত্রীর সহ্য করা উচিত নয়। সংসারের সুখ এমনি এমনি আসে না। উভয়ের ত্যাগ পরিশ্রম আর ভালোবাসার ফসল হচ্ছে সুন্দর ও সুখী সংসার। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ সাহেবের বক্তব্য হচ্ছে ‘আমার কতর্ব্য স্ত্রী-সন্তানকে ভালোবেসে যাওয়া। তাদের ভুল শুধরে সঠিক পথে আনা। গৃহকতার্ হিসেবে এটা প্রত্যেকেরই উচিত। কিন্তু আমরা সে ঔচিত্যবোধের জায়গায় নেই। ভালোবাসা, কতর্ব্য ঔচিত্যবোধের জায়গায় আমাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে নিষ্ঠুরতা অমানবিকতা।’ সৈয়দ সাহেবের বড় দোষ তিনি ‘নারীঘেঁষা’। নারীদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া বন্ধুত্ব করা, এটা যেন তার মজ্জাগত ব্যাপার। তবে সীমা লঙ্ঘন করে নয়। বাইরের সম্পকের্র প্রভাব তার সংসারে কখনোই পড়েনি অথবা তিনি পড়তে দেননি। নারীদের সঙ্গে সম্পকর্ঘটিত ক্ষেত্রে তিনি নিবেদিতপ্রাণ। তিনি প্রায়ই বলেন যাকে বুক দিই তাকে পিঠ দিই না। অথার্ৎ কোনো কাজেই তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন না। হয় হ্যঁা না হয় না। কাজ দেয়া কিংবা চাকরি দেয়ার নামে মানুষকে অযথা ঘোরানো তিনি পছন্দ করেন না। গীতিকার ছাড়াও তার কতগুলো বিশেষ গুণ রয়েছে, যা নারীদের আকৃষ্ট করে অনায়াসেই। তিনি অত্যন্ত রসিক এবং গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। ঘরোয়া আড্ডার মধ্যমণি তিনি। উপস্থিত বুদ্ধির গুণে তিনি কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথা সৃষ্টি করতে পারেন তাৎক্ষণিকভাবে। এর ফলে ঘরোয়া আড্ডা বেশ জমে ওঠে, কেউ কেউ আকষির্ত ও বিমুগ্ধ হয়। এ ছাড়া তিনি কথায় ও কাজে মিল রাখার চেষ্টা করেন। মানুষের বিপদে এগিয়ে আসেন। সম্ভবত এই সব কারণে নারী মহলে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। হেমন্তের শুরু হলেও শহরেও শীতের আমেজ অনুভব করা যায় সন্ধ্যা নামলেই। এই আমেজটা বেশি অনুভ‚ত হয় যে কোনো বৃক্ষপ্রধান এলাকায়। ভাঙা মন নিয়ে রমনা পাকের্র বেঞ্চিতে বসে আছেন সৈয়দ সাহেব। আজও শাকিলা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। ফেসবুকে তার এক নারীভক্ত বারবার ফুলসমেত সুপ্রভাত জানানোর কারণে। আজও তার মনোবলে ধস নেমেছে। সামনে চলার শক্তি যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। সামনে যা দেখছে, কেবলই অন্ধকার। তিনি কি এমন স্ত্রী চেয়েছিলেন। আজ তার মনে হচ্ছে তার প্রতি শাকিলার শ্রদ্ধা ভালোবাসা কোনোটাই নেই, নেই কোনো কতর্ব্যবোধও। শাকিলা যতই অপরাধই করুক না কেন, সংসার জীবনে কখনোই সে সৈয়দ সাহেবকে কোনো ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করেনি। তার ভেতরে কাজ করেনি কোনো অনুশোচনাও। কোনো রকম নতজানু স্বভাব তার নেই। তা হলে কি তিনি সংসারজীবনে ব্যথর্। উদ্যানে চলাচলরত নানা কিসিমের মানুষ দেখছেন তিনি সে। শাকিলাকে কেন্দ্র করে একসময়ে তার মনে স্বপ্ন ছিল, ছিল ভবিষ্যতের সুন্দর হাতছানি। এখন স্বপ্ন উবে গেছে, পড়ে রয়েছে হাহাকার শূন্যতা। এই শূন্যতাই তাকে আজ জাপটে ধরেছে, পলায়নরত চোরকে যেভাবে জনতা ধরে। যেন তার হৃদস্পন্দন থেমে যাচ্ছে। মানুষের জীবনে অনেক দুঃখের ঘটনা থাকে, থাকে কত ধরনের দুঃসহ স্মৃতি। তারপরও মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ভালো থাকার চেষ্টা করে। তার জিজ্ঞাসা, অন্যরা পারলে তিনি পারবেন না কেন? সামান্য কারণে স্ত্রীর ওপর মানসিক ও শারীরিক নিযার্তন, অথবা স্ত্রীকে হত্যা করা, গত সাতদিনে এমন ঘটনা বেশ কয়েকটা ঘটেছে। তারপরেও সৈয়দ সাহেব এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেন না কিংবা নেয়ার চিন্তাও করেন না।। তিনি মনে করেন স্ত্রীকে মানসিক ও শারীরিক নিযার্তন করার অধিকার তার নেই। কারণ এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সংসারে বনিবনা না হলে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। তিনি বেশ কয়েকবার আলাদা হওয়ার কথাও ভেবেছিলেন, বলেছিলেন শাকিলাকেও। তখন শাকিলা তাকে বলেছিল, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পযর্ন্ত।’ কিন্তু স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেলে অন্য ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক বিপত্তি দেখা দেয়। ব্রকেন পরিবারের সন্তানরা অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠে। তাদের ঠিকমতো মানসিক বিকাশ হয় না। অনেক সময় তারা বিপথগামী হয়ে যায়। বিশেষ করে মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়। যদিও আধুনিক সমাজ এসব তোয়াক্কা করে না। সৈয়দ সাহেব এর একমাত্র মেয়ে শ্রাবণী, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মায়ের আচরণে সেও সন্তুষ্ট নয়। সে মাকে বারবার বলেছে বাবার ওপর এমন অশোভন আচরণ না করতে। শাকিলার সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে সংসারে সৈয়দ সাহেব এর অবদানকে স্বীকার করেন না। এ ব্যাপারে তার কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। তার ছোট বোন পাপিয়া প্রায়ই ফেসবুকে স্বামী শওকতের গুণগান গেয়ে স্টেটাস দেয়, স্বামীকে খুশি রাখার জন্য। সাংসারিক ঠুনকো বিষয়ে আবেগ ঝরায়। স্বামীর পক্ষের কোনো আত্মীয় মারা গেলে কৃত্রিম কান্নায় ভেঙে পড়ে। এমনকি স্বামীর সঙ্গেও সে কৃত্রিম আচরণ করে। ফলে তাদের সংসার ও দাম্পত্য জীবন অনেক সুখের। অবশ্য স্বামীর সঙ্গে কৃত্রিম আচরণ করার জন্য শাকিলার পরিচিত মহিলারা ওকে বলেছিল। ও এসবকে ভÐামি মনে করে। অতি সত্যবাদিতা কখনো কখনো নিমর্মতার জন্ম দেয়। শাকিলার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। সে শ্রাবণীর সঙ্গেও ভালো আচরণ করে না। ওর চরিত্রের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হচ্ছে, নারীর কমনীয়ভাব ওর মধ্যে নেই। এক ধরনের পুরুষ-বিদ্বেষী ভাব রয়েছে ওর মধ্যে। ও নিজেই সৈয়দ সাহেবকে বলেছে, ও জীবনে কখনো কঁাদেনি। এমনকি সৈয়দ সাহেবও কখনো ওকে কঁাদতে দেখেনি। এমন নারীর পুরুষ বন্ধু না থাকাই স্বাভাবিক। যার কারণে ওর কোনো পুরুষ বন্ধু নেই, বন্ধুত্ব করার আগ্রহও ওর মধ্যে নেই। সৈয়দ সাহেবের বান্ধবীরা মনে করে, শাকিলা কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসে, আর এ জন্যই সৈয়দের সঙ্গে এমন আচরণ করে। কিন্তু শাকিলা যখন ওকে বলে, ‘তোমাকে দয়া করে বিয়ে করেছি। তোমার মতো রাস্তার লোককে কে বিয়ে করে?’ সৈয়দ সাহেব ঘরমুখী মানুষ নন। বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে, শিল্প-রসিকদের সঙ্গে আড্ডা মারাটা তার স্বভাবজাত। যার কারণে অনেক সময় বাসায় ফিরতে গভীর রাত হয়ে যায়, যা শাকিলার একেবারে না পছন্দ। আসলে বহিমিয়ান মানুষ নিয়ে কেউ সংসার করতে চায় না। শিল্প সংস্কৃতির মেয়েদের সৈয়দ সাহেব ভালোভাবেই চেনেন। তারা সম্পকর্ঘটিত ব্যাপারে বেশ উদার ও আন্তরিক। তাদের স্বভাব পুরুষঘেঁষা। সৈয়দ সাহেব তার এমন অনেক বান্ধবীকে জানেন, স্বামীর অনুপস্থিতিতে বন্ধুদের বিছানায় ডেকে নিয়ে আসে, এমনকি রাতও কাটায়। কারো কারো বাইরের একাধিক পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পকর্ রয়েছে। শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার তারা এই নীতিতে বিশ্বাসী। তাদের ভেতর কোনো অপরাধবোধ নেই। এরাই স্বামী ঘরে ফিরে এলে ভালোবাসার অভিনয় করে, পারলে জীবন দিয়ে দেয়। স্বামীর পছন্দের রান্না করে। অন্য পুরুষের টাকা দিয়ে স্বামীর জন্য উপহারসামগ্রী, খাবার কিনে নিয়ে আসে। এদের কেউ কেউ একাধিক বিয়েও করেছে। এ ক্ষেত্রে শাকিলা সম্পূণর্ বিপরীত। ওর একমাত্র পুরুষ সৈয়দ সাহেব। এমন নিমর্ল অপাপবিদ্ধ চরিত্রের নারী নাগরিক-সমাজে বিরল। তাতে কী? সৈয়দ সাহেব আসলে কী চেয়েছিলেন, ভালোবাসাপ্রবণ কৃত্রিম নারী, যাদের দৃষ্টি বহিমুর্খী নাকি শাকিলার মতো শারীরিকভাবে সৎ নারী। ঘামজজর্র শরীরে মনোবিকার নিয়ে আজ তার সামনে এই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিল। দূরে কোথাও তারই লেখা গান বাজছে ‘ মন রাঙালো কে, জীবন রাঙালো কে, ওরে মন, তুই যে এক পাগলা ঘোড়া, ওরে জীবন, তুই যে এক পাগলা ঘোড়া।’ তার দুচোখ অশ্রæসজল হয়ে উঠলো। তিনি সামনের দিকে তাকালেন। পরস্পর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে এক নব-দম্পতি। তাদের মুখে হাসি চোখে স্বপ্ন। এমন স্বপ্ন তারও একদিন ছিল। ২০ নভেম্বর, ২০১৮