আসামি

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

জাহিদ হোসেন
ধষের্ণর পর হত্যা করা হয়েছে পনের বছরের তমিস্রাকে। তমিস্রা দশম শ্রেণির ছাত্রী। ছিপছিপে গড়ন, ফসার্, দেখতেও বেশ সুন্দরী। তমিস্রার বাবা রাহাত সাহেব একজন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। তিনি মেয়েকে অপহরণ অতঃপর হত্যার দায়ে বিচার চেয়ে মামলা করেছেন। তিনি সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে প্রশাসনের কাছে কাড়ি কাড়ি টাকাও খরচ করছেন। তাই প্রশাসনের চোখে ঘুম নেই। দিন-রাত আসামিদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। উপরের আদেশে শহরের আনাচে কানাচে গোয়েন্দা মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো আসামির হদিস মিলছে না। রাহাত সাহেব সন্দেহমূলকভাবে শামীম, ডলার, হায়দার, শাকিল, হিটলারের নামে মামলা করেছেন। কারণ এরা গলির মোড়ে বাদশার চা’য়ের দোকানে আড্ডা দিত। এরা মেয়েদের দেখলে অসভ্য কথাবাতার্, চিঠি দেয়া, শিস দেয়া ছাড়াও নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত। তমিস্রা এদের বিরুদ্ধে তার বাবার কাছে নালিশও করেছিল কয়েকবার। রাহাত সাহেব বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তবে রাহাত সাহেবের শ্যালক অথার্ৎ তমিস্রার মামা দিনু মিয়া ছেলেদের বারণও করেছে কয়েকবার। কিন্ত কে শোনে কার কথা। কোনো কাজই হয়নি তাতে। বরং ছেলেরা রায় পেয়ে আরো মাথায় উঠে বসেছে। কারণ এরা অস্ত্রধারী ক্যাডার। এদের বিরুদ্ধে কেউ যেতে চায় না। এরা চঁাদাবাজ, সন্ত্রাসী, মাস্তান। প্রতিমাসে এখানকার বাড়িগুলো থেকে বখরা আদায় করে। কোনো বাড়িতে চঁাদা চাইতে গেলে কোনো রকমের ঝুট-ঝামেলা না করে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে পারলেই বঁাচে। আবার কেউ কেউ এদের হাতে রাখার জন্য দাওয়াত করে খাওয়ায়। কিন্তু রাহাত সাহেব এদের তোয়াক্কা করে না। রাহাত সাহেবের কাছেও একদিন চঁাদা চাইতে গিয়েছিল। তিনি সরাসরি না করে দিয়েছেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব ঘটনাই মনে পড়ছে শামীমের। সেই সঙ্গে মা’র কথাও মনে পড়ছে। বাড়ি থেকে আসার সময় মায়ের সে কি কান্না। মনটা তার দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। শামীম মামার বাসায় থেকে দুতিনটে প্রাইভেট পড়ায় আর ভাসিের্ত পড়াশুনা করে। মামা-মামীকে সব ঘটনা খুলে বলেছে। ঘটনার মাস খানেকের মতো হয়ে গেল। কুড়ি দিনের মাথায় হায়দার ধরা পড়েছে। পত্রিকায় খবরটি পড়ে তার ভয় ধরে যায়। গুটিশুটি মেরে বিছানায় পড়ে থাকে। আট-নয় বছরের মামাতো বোন অংকন এসে ডাকেÑ ‘ভাইয়া সারাদিন শুয়েই থাকবে, আজ বেড়াতে যাবে না।’ -যাব চল। -ভাইয়া, কল্পনা আপু দুদিন ধরে পড়াতে আসছে না। কেন আসছে না, জানি না। কল্পনা আপুর সঙ্গেও দেখা করতে হবে। -ও আচ্ছা, চল দেখা করে আসি। কল্পনার মেস বেশি দূরে নয়। মাত্র পঁাচ-সাত মিনিটের পথ। কিন্তু মেসে এসে কল্পনাকে পাওয়া গেল না। দারোয়ান বলল, আপা একটু বাইরে গেছে। দেখা না পেয়ে ফিরে আসছে দুজনে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। পথ হঁাটছে দুজনে। বিকেল বেলাটায় অনেক ছাত্রছাত্রীকে হঁাটতে দেখা যায় এই রাস্তায়। অংকন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ একটি টি-স্টলের দিকে আঙুল তুলে-ভাইয়া ওই যে কল্পনা আপু। কল্পনা কয়েকজন বান্ধবীকে নিয়ে চা খাচ্ছে। অংকন তোমার আপুকে গিয়ে বল,-শামীম ভাই এসেছেন। কল্পনা অংকনকে দেখেইÑ আরে অংকন তুমি, একা এসেছ ? -না, শামীম ভাই এসেছেন। আপনাকে ডাকছেন। -কই চলো তো। -আরে শামীম তুমি কখন...? এসো, এসো রেস্টুরেন্টে বসি। চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে। ওরা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। শামীম চা’য়ে চুমুক দিয়েÑ কল্পনা, আমি তো একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। তা তুমি নাকি দুদিন থেকে অংকনকে পড়াতে যাচ্ছ না। আর দুদিন বাদে ওর পরীক্ষা। ওর দিকে এ সময় ভালোভাবে কেয়ার না নিলে ও তো ভালো রেজাল্ট করতে পারবে না। - আমার জ্বর হয়েছিল, তাই যেতে পারিনি। -ভুলে যেওনা কল্পনা, আমাদের সম্পকর্টা কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। -তুমি আমাকে ভুল বোঝ না প্লিজ। তোমাকে সেদিন দেখতে না পেরে আমার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। তুমি তো জান, তোমাকে একদিন না দেখলে আমি থাকতে পারি না। মুহূতের্র জন্য হলেও তোমাকে দেখার জন্য এ হৃদয় ছটফট করতে তাকে। সেদিন তোমার জন্য পিচগলা রোদে দঁাড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার জ্বর এসে গিয়েছিল। তবু তো আসনি। এমনিতেই তো খুব বলÑ কল্পনা, তুমি আমার ময়না! আমার ময়না পাখি। কথা বলতে বলতে কল্পনার চোখে পানি এসে চোখের কোণ দুটো চিকচিক করছে। -আহা! তুমি এতটা ইমোশনাল হচ্ছো কেন। টেক ইট ইজি। আমি তো তোমার কাছে কৈফিয়ত চাইনি। আমি তোমাকে তোমার চেয়ে দশগুণ ভালোবাসি। -দশ গুণÑ না ছাই। আমি তোমাকে তোমার চেয়ে শতগুণ ভালোবাসি। রিমেম্বার দ্যাট, আই লাভ ইউ মোর দ্যান আই কেন ছে। এভরি ডে এন্ড এভরি মোমেন্ট। আই লাভ ইউ এন্ড আই লাভ ইউ। -আচ্ছা, ঠিক আছে বুঝলাম না হয় তোমার জ্বর হওয়ার কারণে অংকনকে পড়াতে যেতে পারনি। তবে আগামীকাল তো সিওর যাচ্ছো নাকি ? -হ্যঁা, আগামীকাল যদি সুস্থতা ফিল করি তাহলে যাব। -ওকে। আসি তাহলে। রাতে শামীম শুয়ে শুয়ে ভাবে কল্পনাকে সব কথা খুলে বলবে। জমে থাকা কথাগুলো হৃদয়ের মধ্যে ভীষণ চাপের সৃষ্টি করছে। কল্পনাকে ঘটনাটা খুলে বললে হয়তো নিজেকে কিছুটা হালকা মনে হবে। হঠাৎ শামীমের খবরের কাগজে চোখ পড়তেই দেখে হায়দারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। স্বীকারোক্তিতে হায়দার সব কিছু অস্বীকার করেছে। আরো সপ্তাহখানেক পর আকস্মিকভাবে শাকিল ধরা পড়ে। শামীম অস্বস্থি বোধ করে। কোনো কিছুই ভালো লাগে না তার। মনে হয় নিজে পুলিশের কাছে গিয়ে সারেন্ডার করি। কিন্তু বাসায় অসুস্থ মা। ধরা দিলে মাকে দেখবে কে। দু-তিনটে টিউশনি করে যা পাই তার সবই মায়ের কাছে পাঠাই। সেই টিউশনি জোগাড় করে দেয়ার জন্য কল্পনার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। সে না থাকলে কী যে হতো। আর ভাবতে পারে না শামীম। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে। কল্পনার কথায় শামীমের সম্মতি ফিরে আসেÑ ও তুমি রুমেই আছো? অংকনকে পড়ালাম। কিšুÍ তোমার কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। কি হয়েছে তোমার। শরীর খারাপ করেছে? কল্পনাকে সব কথা বলতে চেয়েও পারছে না শামীম। মুখে বলল, কই কিছু না তো। শরীর ঠিকই আছে। -তাহলে কি সব চিন্তা করছ। সব চিন্তা বাদ দিয়ে ইনজয় কর। ইনজয় ইওর সেলফ। দেখবে মনটা ফ্রেস হয়ে আসবে। দুনিয়াটা কদিনের বল, কদিনই বা বেঁচে থাকব আমরা। শামীমের বুকের ওপর শুয়ে আলতো করে চুমু খেলো কল্পনা। -আমাকে পেঁৗছে দেবে চল। -চল। সপ্তাহখানেক পরে ডলার ও হিটলার কিভাবে ধরা পড়ল তা জানতে পারল না শামীম। টেনশন শুধু বাড়ছে শামীমের। হঠাৎ খবরের কাগজে চোখ পড়ে তার। গা শিউরে কঁাটা দিয়ে ওঠে শামীমের। ‘দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধষর্ণ ও হত্যা মামলার রায়ে তিনজনের মৃত্যুদÐ।’ শামীম ভয়ানক ঘাবড়ে গেল। দুদিন সেই ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয়নি, শুয়ে শুয়েই কাটিয়েছে। কল্পনাও এখন আর আসে না কারণ অংকনের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। প্রায় মাসখানেক পর শামীমকে বেশ উৎফুল দেখাচ্ছে। খুশি খুশি ভাব। কেউ ভীষণ আনন্দ পেলে পরনের শাটর্ কিংবা বেল্ট খুলে মাথার উপরে বেঁা বেঁা করে ঘোরায়, কেউবা আনন্দে নাচানাচি, লাফালাফি করে; কিšুÍ শামীম তা করল না। তাড়াতাড়ি করে পোশাক পরে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে ছুটল কলেজের দিকে। - কল্পনা, কল্পনা শোনÑ তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। - তোমাকে আজ খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা কি? - ব্যাপার তো একটা আছেই। চল গাছের ছায়ায় বসি। - আরে না, না। এখন আমার ক্লাস আছে। - রাখ তোমার ক্লাস। আগে শোনই না ব্যাপারটা। আমি তোমার কাছে একটা ব্যাপার গোপন করেছি। তার বোঝা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। তোমাকে বলিনি কারণ, তুমি যদি আমাকে অবিশ্বাস না কর বা সন্দেহ কর। আমি চাই না আমাদের ভালোবাসায় অবিশ্বাসের ছেঁায়া লাগুক। - আচ্ছা, থাক সেসব। এখন আসল ঘটনাটা বল, কল্পনা বলল। - প্রায় এগারো মাস আগে তমিস্রা নামের একটা মেয়েকে ধষর্ণ করে হত্যা করা হয়। - মানে, তোমাদের মহল্লায়? - হ্যঁা, আমাদের ওখানে। মজার ব্যাপার হলো একই নামে আমরা দুজন একই মহল্লায়.... ক্যাম্পাসে গোলাগুলি শুরু হয়েছে, কল্পনা শুয়ে পড়। ওরা দুজন শুয়ে পড়ে ঘাসের বিছানায়। পরস্পর মুখোমুখি হয়ে কথা বলে ঘাসের সঙ্গে।