লাশ

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অলোক আচাযর্
নৌকার গলুইয়ের ওপর বসেই ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কী’? আমার দিকে না তাকিয়েই সে উত্তর দেয়, ‘ইয়াসিন আলী’। ইয়াসিন আলী পান খাচ্ছিল। নাম বলার সময় মুখ থেকে খানিকটা ছিটকে এলো। মনে হয় কড়া টাইপের কোনো জদার্-টদার্ খায়। মুখ থেকে ভক ভক করে গন্ধ আসছিল। ইয়াসিন আলীর সাথে আমার হয় শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার সময়। জায়গাটা পাবনার সুজানগরের সাতবাড়িয়া ঘাট। শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছিলাম ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। বাড়ি থেকে বের হতে দেরি হওয়ায় ঘাটে পেঁৗছাতে পেঁৗছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। এসময় সন্ধ্যার পর পরই নিঝুম রাত নেমে আসে। এসময় নৌকা না পাওয়ারই কথা। তীব্র শীত। আশপাশে তেমন কাউকে চোখে পড়ল না। যাত্রীদের জন্য যে ছাপড়া মতন ঘরটা সেখানে একজনকে দেখলাম আগাগোড়া ঢেকে শুয়ে আছে। বার দুয়েক ডাক দিলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না। তবে ঘাটে দেখলাম একটা নৌকা বঁাধা আছে। দিনের বেলায় যখন এসেছি তখন লক্ষ্য করেছি ঘাটের পাশেই হিন্দুদের শ্মশান। কিছুদিন আগেই এখানে একজনের মৃতদেহ সৎকার করতে দেখেছি। সেটা আসলে কোনো বিষয় নয়। ঘটনা হলো দিন আর রাতের মধ্যে জায়গার পাথর্ক্য রয়েছে। সামনের পদ্মা নদীটাকেও অচেনা মনে হচ্ছে। পানি শুকিয়ে জায়গায় জায়গায় চর পড়ে গেছে। চারদিকে নিজর্ন, নিস্তদ্ধতা। কেবল শ্মশানের দিক থেকে একটা অচেনা পাখির ডাক ভেসে আসছে। মনে হয় আগে কোথাও এই ডাক শুনেছি। কোথায়? কোনো শ্মশানেই হবে হয়তো। চারদিকে বেশ মায়াধরা আলো। পূণির্মা মনে হয় কয়েকদিন আগেই গেছে। চারদিকটা তাই স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। চঁাদের মিষ্টি আলো চরের বালুর ওপর পরে আরও উজ্জ্বল হয়েছে। আমার মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। কেমন গল্পের মতো একটা পরিবেশ। কিন্তু আমি জানতাম না এই নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এতটা ভয়ঙ্কর হবে। নৌকার কাছে পেঁৗছে দেখলাম মাঝি হাল ধরে বসে আছে। আমি জানতে চাইলাম নৌকা ওপার যাবে কিনা। জবাব এলো ‘ওঠেন’। আমি উঠলাম। আমার অভ্যাস হলো নৌকার মাঝি যেখানে হাল ধরে বসে থাকে তার কাছে বসা। আমি সোজা ছেলেটা পাশে গিয়ে বসলাম। আমি ওঠার পরপরই ছেলেটা কাকে যেন বলল, ‘যাইগা’। কিন্তু কাকে বললো বুঝতে পারলাম না। কেউ যেতেও বলল না। একটা বিষয়ে খটকা লাগলো। অন্য সময় আগে টাকা দিয়ে নৌকায় উঠতে হয়। কিন্তু আজ কেউ টাকা নিল না। তবে রাতের কারণেও এটা হতে পারে। ওপারে পেঁৗছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগার কথা। বষার্র সময় নদীতে জল থাকে। সোজাসুজি নৌকা চলতে পারে। তখন পার হতে আধ ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু এই শুকনো মৌসুমে জায়গায় জায়গায় চর জেগে ওঠে। তাই অনেকটা ঘুরে ঘাটে পেঁৗছাতে হয়। যাই হোক আমি নৌকায় ওঠা মাত্রই ইয়াসিন নৌকার ইঞ্জিন চালু করে। আমি আস্তে ধীরে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাই। নৌকা চলতে শুরু করে। আমার ভেতরের গুমোট ভাবটা কাটতে শুরু করে। সিগারেট টানার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের দৃশ্য দেখছিলাম। বেশ উপভোগ করছিলাম। চঁাদের আলো নদীর বুকে পড়ে চমৎকার দৃশ্য। দু-এক লাইন কবিতাও মনে আসছিল। ভাবছিলাম এমন প্রকৃতির ভেতর মৃত্যু হলেও কোনো আফসোস থাকে না। কিন্তু ছন্দ ভাঙলো ইয়াসিনের ডাকে। ‘স্যার কি শ্বশুড়বাড়ি যাইবেন’? ‘হু’। বলেই বিস্মিত হলাম। কারণ আমি শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছি এটা ইয়াসিনের জানার কথা নয়। বিস্মিত ভাবটা চেপে ওর সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করলাম। ‘তোমার বাড়ি কি উদয়পুর’? ‘বাড়ি! বাড়িটারি নাই স্যার। মাথা গুজে পরে থাকি এক জায়গায়”। হেঁয়ালিপূণর্ কথা। তবু কথা চালিয়ে যাই। ‘সিগারেট খাও’? ‘দেন একখান’। আমি সিগারেট বের করে এগিয়ে দিই। ইয়াসিন আলী সাবধানে সিগারেট ধরিয়ে একটু চুপ থাকে। এসময় সে নানা কসরত করে নৌকার হাল ঠিক রাখে। কারণ নদীর বিভিন্ন জায়গায় পানি একদম কম। একটু ভুল হলেই চরায় নৌকা আটকে যাবে। ‘স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করি’? ‘কর’। ‘আপনি কি ভ‚ত বিশ্বাস করেন’? আচমকা ইয়াসিনের এই কথায় অবাক হলাম। তবে অবাক হওয়া ভাবটা প্রকাশ করলাম না। ‘কেন বলতো’? ‘ইয়ে মানে স্যার এমনি। তয় স্যার একখান কথা কই’? ‘বল’। ‘স্যার, রাতের বেলায় নৌকায় একা পার হওন ঠিক না’। ‘কেন? কি সমস্যা’? ‘সমস্যা আছে স্যার। আপনেরা শহরের মানুষ। নদীর এইসব বুঝবেন না’। ‘বুঝিয়ে বললেই বুঝবো’। কিছুক্ষণ চুপ থাকে ইয়াসিন। তারপর আবারও বলতে থাকে। গতকালও স্যার ওইহানে দুইটা লাশ ভাসতে দেখছি। ইয়াসিন হাত দিয়ে জায়গাটা দেখায়। ‘মানে মানুষের মৃতদেহ’। ইয়াসিন সম্ভবত আমাকে একা পেয়ে ভয় দেখাতে চেষ্টা করছে। প্রচÐ রাগ হচ্ছে ইয়াসিনের ওপর। মনে হলো গালে কষে একটা থাপ্পড় দিই। অনেক কষ্টে রাগ সামলালাম। ইয়াসিন বলল, ‘জি স্যার’। ‘আশপাশে নৌকাডুবি হতে পারে। হয়তো সেই নৌকাডুবির ফলেই...’ ‘না স্যার। গত এক সপ্তাহে এই নদীতে নৌকাডুবির কোনো খবর নাই। আমরা নদীত থাকি। এসব খবর আমাদের কানে আগে আসে’। ‘তাহলে তুমি বলতে চাইছো বিষয়টা অস্বাভাবিক? তবে আমি ভ‚তটুত বিশ্বাস করি না। ওসব ইলিউশন ছাড়া কিছু না’। ‘সে কোনো উত্তর না দিয়ে বলল, ‘দুই মাস আগে এইখানেই নৌকাডুবি হইছিল। চার-পঁাচটা লাশ পুলিশ উদ্ধার করল’। ‘তুমি বলতে চাইছো তোমার কালকের দেখা মৃতদেহগুলো সেই দুই মাস আগের’? ‘আমি সেদিন ওদের সঙ্গে ছিলাম স্যার। সব স্পষ্ট মনে আছে। লাশগুলোর চেহারা, পোশাক সবকিছু মনে আছে’। ‘এই প্রথম আমার মনে হলো সত্যি সত্যি ভয় পেতে শুরু করেছি। অবশ্য ইয়াসিন মিথ্যাও বলতে পারে। আমার পাশে বসে থাকা ইয়াসিনকে এখন অচেনা মনে এসেছে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি গল্পটা অবিশ্বাস করতে। তবে পরিবেশটা আমার অবিশ্বাসকে বারবার দুবর্ল করে দিচ্ছিল। এর মধ্যেই ইয়াসিন বলে উঠল, ‘স্যার, ওই দেহেন’। আমি ইয়াসিনের আঙুলের নিদের্শ মতো তাকিয়ে দেখি, কয়েক গজ দূরে ঠিক অস্পষ্ট মতন কিছু একটা ভাসছে। আপাতদৃষ্টিতে মানুষের মৃতদেহ বলেই মনে হয়। একটা দেখতে না দেখতেই পাশে আরেকটা লাশ ভাসতে দেখলাম। এভাবে কয়েকটা লাশ ভেসে উঠল। লাশগুলো যেন ভাসতে ভাসতে আমাদের নৌকার কাছে আসতে লাগল। আমি আবারও প্রাণপণ চেষ্টা করছি বিষয়টাকে ব্যাখ্যা দিয়ে দঁাড় করাতে। হয়তো এটা কোনো মানুষের না, কোনো প্রাণীর মৃতদেহ। কিন্তু পরিবেশটা এমন যে আমার যুক্তির অংশটা ক্রমেই দুবর্ল হয়ে পড়ছে। সেই স্থানে কাল্পনিক শক্তি বেড়ে যাচ্ছে। আমি জানি এখন ইয়াসিন যা দেখাবে আমি তাই দেখবো। ভয়ের মুহ‚তর্টাই এমন। এই শীতের রাতের আমার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল। মনে হলো পাশে কেউ হেসে উঠল। এটা কি ইয়াসিন? আমি দুবর্ল স্বরে ডাকলাম, ‘ইয়াসিন’। ‘বলেন স্যার’। আমি ভয় পাই না। আমি যা দেখছি তা আমার কল্পনা। তুমি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবে না’। ‘আমিও না স্যার। তয় এটা ভয় না। এটাই বাস্তব। আপনি আর রাইতে নৌকায় চড়বেন না স্যার। ‘ঠিক আছে ইয়াসিন। আর কতক্ষণ লাগবে’? ‘ইয়াসিন আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলল ‘স্যার, সামনে দ্যাখেন’? আমি নৌকার উল্টো দিকে তাকাই। তাকিয়ে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। এতক্ষণ সেখানে কেউ ছিল না। কিন্তু চঁাদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম সেখানে কয়েকজন কিছু একটা ঘিরে বসে আছে। অথচ নৌকায় এতক্ষণ কেউ ছিল না। আমি চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাবো কিন্তু ইয়াসিন আমাকে থামিয়ে দিয়ে সামনে দেখালো। আমি এবার একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। যা দেখলাম তাতে আত্মারাম খঁাচাছাড়া। মনে হলো কোনো একটা প্রাণীর মৃতদেহ ঘিরে আছে। আর সেখান থেকে কোনো অংশ ছিঁড়ে খাচ্ছে। আবছা আলোতে সেটাকে মানুষের মৃতদেহ চিনতে ভুল হলো না। ইয়াসিনের দিকে তাকালাম। দেখি ওর চোখ দুটোও মনে হয় জ¦ল জ¦ল করছে। আমার আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলে তাকিয়ে দেখি ইয়াসিন আমার দিকে ঝুঁকে আছে। ‘আমরা পেঁৗছে গেছি, স্যার’। আমি বঁাশের চৌকির ওপর শুয়ে আছি। এই শীতেও কেউ আমাকে বাতাস করছে। পাশ থেকে কয়েকজন ঘিরে রেখেছে। কেউ একজন বলল, ‘জ্ঞান ফিরছে মানুষটার। মনে হয় ভয় পাইছে’। তারপর সবাই আমাকে আমার গন্তব্যে তুলে দিল। গাড়িতে ওঠার সময় ইয়াছিন আমার কাছে এসে বলল, ‘স্যার আমার কথাটা মনে রাইখেন। রাইতে নৌকায় উইঠেন না’।