বেগম রোকেয়া জীবন ও সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পাঠ

ব্যক্তি জীবনে রোকেয়া নিজে তুমুল লড়াই করেছেন প্রতিক‚ল সমাজের সঙ্গে। তবে পরাস্ত হয়ে নতি স্বীকার করেননি। সরে দঁাড়াননি স্বাধীনচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চচার্ থেকে। নারীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় জীবনের শেষদিন পযর্ন্ত কাজ করে গেছেন। তার জীবনচচার্য় এবং সাহিত্যকমের্ সেসব বিষয়ই বিধৃত রয়েছে। তারই আত্মদানের ফলে নারীরা আজ সমাজে অগ্রগামিনী। তারই কলমের ফসলে আজ পাঠকরা ঋদ্ধ।

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অঞ্জন আচাযর্
পরিমাণে বিপুল নয় বেগম রোকেয়া বা রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের সাহিত্যকমর্। কেবল পঁাচটি গ্রন্থের লেখক তিনি। লিখতেন ‘মিসেস আর এস হোসেন’ নামে। তার ওপর মাত্র ৫২ বছরের (৯ ডিসেম্বর ১৮৮০Ñ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২) নাতিদীঘর্ জীবন তিনি যাপন করেছেন। একই তারিখে তার জন্ম ও মৃত্যুদিন। সাহিত্য রচনায় তিনি যত না কাজ করেছেন, তার চেয়েও অনেক বেশি রচিত হয়েছে তাকে ঘিরে নানা রচনা। রোকেয়া তার স্বল্পকালের আয়ুটি নিয়েও নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে পরিগণিত হতে পেরেছেন, তার সৎকাযের্, প্রগতিশীল চিন্তায় এবং সমাজে সে চিন্তার প্রায়গিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীশিক্ষার গুরুত্বের কথা তিনি অনুভব করেছেন তীব্রভাবে। তাই বার বার সচেষ্ট হয়েছেন নারী জাগরণে শিক্ষাকে পাশে রাখতে। গড়ে তুলেছেন উদারচেতা স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গালসর্ স্কুল’ এবং ‘আনজুমানে-খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি সংগঠন। মূলত সমাজে বিদ্যমান কুসংস্কার, রক্ষণশীল ধমীর্য় চিন্তা-চেতনাকে তিনি প্রতিহত করেছেন তার বিজ্ঞানমনস্ক ও গভীর ধমার্নুরাগের আলোকে। তার লেখনিতে ছিল যুক্তিনিষ্ঠতা ও আপসহীন দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের অধিকার আদায়ে তিনি তার সমগ্র জীবনকে উৎসগর্ করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘রোকেয়া রচনাবলি’র পরিবধির্ত ও পরিমাজির্ত নতুন সংস্করণ পৌষ ১৪১৩ বঙ্গাব্দ, ডিসেম্বর ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকার কিছু অংশ এ প্রসঙ্গে আলোচিত হতে পারেÑ “বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রথমদিকে রোকেয়ার যখন উত্থান, তখনো বাঙালি-মুসলমান নারী ছিল অন্ধকারে, বাঙালি-মুসলমান সমাজই ছিল অন্ধকারে। সদ্য তখন ভোর হয়ে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে শুরু হয়েছিল বাঙালি-মুসলমানের বহুবিলম্বিত জাগরণ। সেই জাগরণের মধ্যে রোকেয়া নারীকেও অন্তভুর্ক্ত করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রোকেয়া ছিলেন উন্মুক্ত মনের মানুষ। ফলে বাঙালি-মুসলমান নারীর মধ্যেই তিনি আবদ্ধ থাকেননি, তিনি দেশ-কাল-জাতি-ধমর্-নিবিের্শষে সমস্ত নারীর জাগরণ আকাক্সক্ষা করেছেন। আবার বাঙালি-মুসলমান নারী শুধু নয়Ñ সমগ্রভাবে বাঙালি-মুসলমানের জাগরণই তিনি চেয়েছেন শেষ পযর্ন্ত। সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, রোকেয়া চেয়েছেন মনুষ্যত্বের উদ্বোধন। রোকেয়ার এই আকাক্সক্ষা কেবল স্বপ্ন মাত্র ছিল না, তা ছিল ভূমিস্পশীর্ অভিযানÑ রোকেয়ার তাবৎ লেখালেখি, স্কুল প্রতিষ্ঠা, সংগঠন তৈরি সবই তার সাক্ষ্য দেবে।” সময়ের চেয়ে অগ্রগামী রোকেয়ার রচনা। কেবল রচনার প্রাঞ্জলতা বা প্রসাদগুণের কারণেই তিনি পাঠক-সমাজে সমাদৃত হয়েছেন তা কিন্তু নয়; বরং নিজের লেখার মাধ্যমে তিনি কালোত্তীণর্ হতে পেরেছিলেন বলেই তার লেখা আজও সজীব ও প্রাণবন্ত। নিজের জীবনের এত এত কাজ করার পেছনে উদ্দেশ্য যে ছিল মহৎ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অনুজাতুল্য মরিয়ম রশীদ মেরীকে লেখা এক ব্যক্তিগত চিঠিতে তিনি স্বগতোক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেনÑ ‘খোদার ফজলে পঁাচটি ক্লাস এবং ৭০টি ছোট-বড় মেয়ে, দু’খানা গাড়ি, দুই জোড়া ঘোড়া, সইস, কোচম্যান ইত্যাদি-ইত্যাদি সব দিকে একা আমাকেই দৃষ্টি রাখিতে হয়। ...ভগিনীরে! এই যে হাড়ভাঙ্গা গাধার খাটুনিÑ ইহার বিনিময় কি, জানিস? বিনিময় হইতেছে “ভঁাড় লিপকে হাত কালা’ অথার্ৎ উনুন লেপন করিলে উনুন তো বেশ পরিষ্কার হয়, কিন্তু যে লেপন করে তাহারই হাত কালিতে কালো হইয়া যায়। আমার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরিবতের্ সমাজ বিস্ফারিত নেত্রে আমার খুঁটিনাটি ভুল ভ্রান্তির ছিদ্র অন্বেষণ করিতেই বদ্ধপরিকর।’ এ আত্মগত উক্তির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় রোকেয়ার আদশর্গত চেতনা, সেইসঙ্গে সেই সৎ প্রচেষ্টায় মূতির্মান প্রতিবন্ধকতার চিরায়তরূপ। তাই বুঝি ৩০ এপ্রিল ১৯৩১ সালে ¯েœহস্পদা মোহসেনা রহমান মোনাকে লেখা অন্য এক চিঠিতে অনেকটা শ্লেষের সঙ্গে বলেনÑ ‘আহা! “কেয়া টিড্ডি, কেয়া টিড্ডি কা রান!” কত ক্ষুদ্র, কত নগণ্য মানুষ, তার আবার আশা ভরসা! সুতরাং যে কয়দিন বেঁচে আছি খাই দাইÑ আরাম করি, হাসি খেলি, ব্যস! আর যদি পারি ত,’ প্রাণভরে একটু আল্লাহ্কে ডাকি। তা’ ছাই ডাকতেও ত পারি না। আমার মতো দুভাির্গনী, অপদাথর্ বোধ হয়। এই দুনিয়ায়, আর একটা জন্মায়নি।’ এ চিঠিতেই রোকেয়া তার ব্যক্তি জীবনের গভীর বেদনার কথা প্রকাশ করেন। কি পিতা, কি স্বামী, কি সন্তান, কারো কাছ থেকেই তিনি এক দÐ সুখ পাননি। তিনি বলেনÑ “শৈশবে বাপের আদর পাইনি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যহ টৎরহব পরীক্ষা করেছি। পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দুবার মা হয়েছিলামÑ তাদেরও প্রাণ ভরে কোলে নিতে পারিনি। একজন ৫ মাস বয়সে, অপরটি ৪ মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই ২২ বৎসর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি।...আমি আমার ব্যথর্ জীবন নিয়ে হেসে খেলে দিন গুনছি।’ রোকেয়ার জন্ম রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের পতিত জমিদার পরিবারে। পৈতৃক নাম রোকেয়া খাতুন। পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ও মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। তিন ভাই, তিন বোন। ভাইবোনদের মধ্যে রোকেয়ার অবস্থান ছিল পঞ্চম। বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের, মেজো ভাই খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের এবং সেজো ভাই মোহাম্মদ ইসরাইল আবু হাফস সাবের (ছোটবেলায় মৃত), বড় বোন করিমুন্নেসা খানম, তারপর রোকেয়া খাতুন এবং ছোট বোন হোমায়রা তোফজ্জল হোসেন। পারিবারিক ভাষা ছিল উদুর্। তবে রোকেয়া উদুর্ ছাড়াও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি ভাষাজ্ঞান লাভ করেছিলেন। বড় বোন করিমুন্নেসা খানমের বিয়ে হয়েছিল টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ারের জমিদার গজনভী পরিবারে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব স্যার আবদুল হালিম গজনভী ও স্যার আবদুল করিম গজনভী ছিলেন এই করিমুন্নেসারই দুই কৃতী সন্তান। এই করিমুন্নেসার বাড়িতেই একজন ইউরোপিয়ান গভনেের্সর কাছে রোকেয়া ইংরেজি অক্ষরজ্ঞান লাভ করেন। অঙ্গ-রূপ বণর্নায় রোকেয়া ছিলেন গৌরবণার্ ও রূপসী। তবুও সামঞ্জস্য বয়সের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারেননি তার পিতা। আথির্ক দুরবস্থার কারণে তাই ১৮৯৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুরের অধিবাসী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন নামের ৩৮ বছর বয়সী, বিপতœীক, মধুমেহরোগী পুরুষের সঙ্গে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল বাইশ বছর। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন উড়িষ্যার কনিকা স্টেটের কোটর্ অব ওয়াডের্সর নিযুক্ত ম্যানেজার। তারপর এক সময় ভাগলপুরের কমিশনারের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন। বৈবাহিক জীবনের প্রায় সবটা সময় স্বামীর রোগের সেবা করেই কাটাতে হয় রোকেয়াকে। শেষ বয়সে অন্ধও হয়ে গিয়েছিলেন সাখাওয়াত। বৈবাহিক-জীবনে দুটো কন্যা সন্তান জন্মেছিল। একটি পঁাচ মাস বয়সে, অন্যটি চার মাস বয়সে মারা যায়। স্বামীর মৃত্যু হয় ১৯০৯ সালের ৩ মে কলকাতায়। রোকেয়ার বয়স তখন মাত্র ঊনত্রিশ। স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর প্রথম পক্ষের কন্যা ও জামাতার হাতে লাঞ্ছিত ও বিতাড়িত হয়ে ১৯১০ সালের কোনো এক সময়ে কোলকাতায় আশ্রয় নিতে হয় তাকে। রোকেয়ার দাম্পত্য-জীবনের সংক্ষিপ্তসার নানা জানা-অজানা কথার উল্লেখ পাওয়া যায় ড. আহমদ শরীফের ‘নারী মুক্তি সংগ্রামী : বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ প্রবন্ধটিতে। সেই রচনায় তিনি উল্লেখ করেনÑ ‘...প্রৌঢ় বহুমূত্ররোগী সাখাওয়াতের কাছে বৃদ্ধস্য তরুণী ভাযার্র মতো রোকেয়ার আদর-কদর নিশ্চয়ই ছিল, এ আমরা নিঃসংশয়ে মেনে নিতে পারি। কিন্তু প্রায় পিতার বয়সের রুগ্ন স্বামীতে তার আকষর্ণ-অনুরাগ-আসক্তি থাকা তো স্বাভাবিক নয়। কাজেই দাম্পত্য সুখ বা আনন্দ তার জীবনে অনুভূত হয়নি বলেই আমরা ধরে নিতে পারি। তার একপত্রে সাক্ষ্যও মেলে, প্রস্রাব পরীক্ষা আর তিক্ত রস তৈরি করাই ছিল তার নিত্যকার প্রধান দায়িত্ব, কতর্ব্য ও মুখ্য কমর্। ...দাম্পত্য জীবনে রোকেয়ার ছিল অশেষ মানসিক দুঃখ যন্ত্রণা এবং স্বামীর সেবা শুশ্রƒষা সম্পৃক্ত দুঃসহ শারীরিক শ্রম।” ড. শরীফ সে প্রবন্ধে রোকেয়াকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। তিনি আরও বলেনÑ “কেবল শিক্ষাই নারীকে শাস্ত্রিক সামাজিক নৈতিক সাংস্কৃতিক অন্ধ বিশ্বাস-সংস্কার মুক্ত করতে পারে, পারে রোজগারে স্বনিভর্র স্বয়ম্ভর স্বাধীন জীবনযাপনের যোগ্য করে তুলতে। এ উপলব্ধি কেবল রোকেয়া মুসলিম সমাজের হয়ে নয়, কেবল বাংলার বা ভারতের হয়েও নয়, বিশ্বের হয়েই প্রথম অনুভব উপলব্ধি করে কলম ধরেছিলেন লেখার মাধ্যমে প্রচার ও প্রচারণা চালানোর জন্য, শিক্ষার মাধ্যমে জানিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। আশ্চযর্ তিনি স্বরূপে অন্তরে বিদ্রোহিনী হলেও তার লেখার কোথাও রোষ উষ্মা ক্রোধ ক্ষোভ তেমন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে প্রকাশ পায়নি, মানে চাবুকাঘাত হয়নি। যা লিখেছেন স্থির বিশ্বাসে ও ধীরে বুদ্ধিতে বিচার-বিশ্লেষণ করে, দৃষ্টান্ত দিয়ে, যুক্তি প্রয়োগে বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য এবং পরিবারের সমাজে গ্রহণীয়, প্রয়োগযোগ্য করে লিখেছেন, বলেছেন। ক্বচিৎ বিদ্রƒপ ও রোষ প্রকাশ পেয়েছে। আর বাংলার, বাঙালির ও নারীর দুরবস্থার জন্য ক্ষোভ দুঃখ প্রকাশ পেয়েছে। খান্দানি জমিদার ঘরের সংস্কৃতি-সৌজন্যের প্রমূতর্ প্রতীক, প্রতীভূ ও প্রতিম এক তাৎপযের্ বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথম দেশাচারদ্রোহী নারী, প্রতিকার প্রতিবাদ প্রতিরোধ লক্ষ্যে প্রথম আত্মোৎসগর্কারিণী, যিনি নারীকে স্বাধিকারে স্ব-ও সুপ্রতিষ্ঠাকামী অহিংস সংগ্রামী আপসহীন ও বিরামহীন সংগ্রামে চালিয়ে গেছেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর আকস্মিক হৃদরোগে মৃত্যু মুহূতর্ অবধি। তার মৃত্যুর দিনেই তার টেবিলে তার অসমাপ্ত প্রবন্ধ “নারীর অধিকার” দেখা গেছে। তার ৫২/৫৩ বছরের জীবনে তিনি ইংরেজিতে, বাংলায় এবং উদুের্ত কেবল নারীশিক্ষার, নারীপদার্র, ও নারীমুক্তির তথা নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার কথাই বলেছেন, লিখেছেন এবং এ-ই ছিল তার ধ্যানের ও অনুধ্যানের বিষয়।’ সাহিত্যচচার্ সম্পকের্ ড. শরীফের বিশ্লেষণ হলো : “রোকেয়া কবিতা, হালকা গল্প বা রসরচনা, প্রবন্ধ উপন্যাস লিখেছেন, সবটাই লিখেছেন অভিন্ন লক্ষ্যে। নারীর পারিবারিক সামাজিক ও দুঃখ দুদর্শা নিবারণ বা বিমোচন ছিল তার উদ্দেশ্য। ভাইয়ের সাহায্যে ও পরে স্বামীর সহায়তায় এ উদুর্ভাষী মহিলা বাংলা ও ইংরেজি আয়ত্ত করে বাংলায় ও ইংরেজিতে বই লিখেছেন। তার ভূমিকা ছিল শাস্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক উপযোগবিরহী বিশ্বাস-সংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন একাধারে বিদ্রোহিনী, সমাজসংস্কারিকা, নারী অবরোধ বা পদার্মুক্তি সংগ্রামী, নারীর শিক্ষার প্রচারে প্রসারে নিষ্ঠ, নারীকে পরিবারে ও সমাজে স্বাধিকারে স্বপ্রতিষ্ঠ ও স্বাধীনভাবে জীবিকা অজের্ন স্বনিভর্র হওয়ার পন্থা আবিষ্কারে প্রেরণাদাত্র আর পুরুষ সমাজকেও বিবেক বিবেচনায় অনুগত হয়ে নারী কল্যাণে ও মুক্তিতে এগিয়ে আসার আহŸায়িকা। কাজেই তার রচনামাত্রই প্রচার-প্রচারণা সঞ্চাত। অতএব, গুণে মানে মাপে মাত্রায় এর শিল্পমূল্য উঁচুদরের নয় বটে, কিন্তু উদ্দিষ্ট ও অন্বিষ্ট ফল দানের ও প্রান্তিতে উপযুক্তই ছিল অথার্ৎ এর সাহিত্য মূল্য যাই হোক, সমকালীন মুসলিম সমাজের-সমস্যা সংকট সম্বন্ধে চেতনাদানে এবং প্রতিকার-প্রতিরোধ পন্থা নিদেের্শ তার রচনা সাথর্ক ও সফল হয়েছিল তখনো সীমিত শিক্ষিত মুসলিম সমাজে। তার রচনার ও প্রয়াসের মূল্য তাই তার সমকালীন মুসলিম সমাজে অতুল্য, অনন্য এবং গোটা ভারতে কোনো মহিলার এমনি ঐকান্তিক ও একাগ্রতা ছিল দুলর্ভ ও দুলর্ক্ষ্য। সেদিক দিয়েও তিনি কেবল বাংলায় কলিকাতায় নয়, সমগ্র ভারতবষের্ ছিলেন অনন্যা, অসামান্য।” ব্যক্তি জীবনে রোকেয়া নিজে তুমুল লড়াই করেছেন প্রতিক‚ল সমাজের সঙ্গে। তবে পরাস্ত হয়ে নতি স্বীকার করেননি। সরে দঁাড়াননি স্বাধীনচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চচার্ থেকে। নারীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত কাজ করে গেছেন। তার জীবন চচার্য় এবং সাহিত্যকমের্ সেসব বিষয়ই বিধৃত রয়েছে। তারই আত্মদানের ফলে নারীরা আজ সমাজে অগ্রগামিনী। তারই কলমের ফসলে আজ পাঠকরা ঋদ্ধ।