বেগম রোকেয়ার সমাজ চিন্তা ও সমাজ পরিবতের্নর সংগ্রাম

এই মহীয়সী নারী উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের জন্যই মূলত তার সাহিত্য সাধনায় স্থান করে নিয়েছেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন সে আমলে নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ও অগ্রদূত। আমাদের গবর্। বাঙালি জাতি প্রেরণার উৎস। সত্য কথা বলতে কী, বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব হলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই। তিনি শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা কিংবা নারী শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি; বরং সে সঙ্গে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সমাজে নারীদের অবস্থার সাবির্ক উন্নতির জন্য তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন পুরুষ ব্যক্তিত্ব। বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন নারী। এখানে বিদ্যাসাগরের চেয়ে বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব ছিল বেশি। সমকালীন সামাজিক অনুশাসনের অচলায়তন ভাঙা ছিল তার লক্ষ্য।

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

জোবায়ের আলী জুয়েল
বেগম রোকেয়া এমন এক অসামান্য নারী, যিনি এ দেশের অবহেলিত নারী সমাজকে দিয়েছেন এক অভাবনীয় আলোকবতির্কার সন্ধান। নারী অধিকার, চেতনা ও সমাজ নিমার্ণ মানসিকতার যথাথর্ রেখাপাত ঘটেছে তার সৃজন কমের্। নারী জাগরণ তথা নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এক প্রদীপ্ত শিখা। যার সংস্পশের্ এসে এই উপমহাদেশের নারী সমাজ লাভ করেছে মুক্তির দিশা। তিনিই প্রথম বাঙালি নারী, যিনি নারী হয়ে প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেনÑ এই উপমহাদেশে নারী সমাজের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষা ও স্বনিভর্রতা। রোকেয়া প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার নামে ধমীর্য় ও সামাজিক মূল্যবোধের আদশর্ ও ঐতিহ্যকে কখনই বিসজর্ন দেননি। বাংলার নারী সমাজের মুক্তির অগ্রদূত ও জ্ঞানের আলো সঞ্চারিণী বেগম রোকেয়া ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তগর্ত ‘পায়রাবন্দে’ বিখ্যাত জমিদার সাবের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পায়রাবন্দের প্রথম জমিদার টাটি বলদিয়া ইংরেজ পক্ষের গুপ্তচর ছিলেন (‘বলদিয়া’ অথর্ হলো বলদের পৃষ্ঠে মালামাল চাপিয়ে একস্থান হতে আর এক স্থানে নিয়ে গিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করত যারা তাদের দেশীয় ভাষায় ‘বলদিয়া’ বলা হতো)। টাটি শেখ বলদিয়া তৎকালীন ইংরেজদের পক্ষে সফল গুপ্তচরের বদৌলতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মহাখুশী হয়ে তাকে বহু লাখ টাকার জমিদারি, লাখেরাজ, জলকর, ফলকর, বনকর দান করেন (হায়দার আলী রচিত ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদি সংগ্রামের পাদপীঠ’ পৃষ্ঠা নং ৩৪০)। এখানে বেগম রোকেয়া পরিবারের সংক্ষিপ্ত বংশ পরিচিতি তুলে ধরা হলো : প্রপিতামহ : টাটি চৌধুরী বলদিয়া (পরবতীর্ সময়ে চৌধুরী)। পিতামহ: জমির উদ্দিন চৌধুরী, পিতা- জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের চৌধুরী ও রাহাতুন্নেছা সাবেরা চৌধুরানী ছিলেন বেগম রোকেয়ার মাতা। তার মাতা রাহাতুন্নেছা, সাবেরা চৌধুরানী ঢাকার বলিয়াদির জমিদার হোসেন উদ্দীন চৌধুরী সাহেবের কন্যা ছিলেন। রোকেয়ার ৪ মাতা ছিলেন এবং ভাইবোনের সংখ্যা ছিল ৯ ভাই ও ৬ বোন। তন্মধ্যে ২ ভাই ও ২ বোন অপ্রাপ্ত বয়সে মারা যান। ভাইরা ছিলেন যথাক্রমে- ১) ইব্রাহিম সাবের, ২) খলিলুর রহমান সাবের, ৩) আবুল বাকের সাবের, ৪) আবুল ফজলে সাবের, ৫) আব্বাস সাবের, ৬) মজলুম সাবের, ৭) মছিহজ্জামান আবুল ওছামা সাবের ও বোনদের মধ্যে ১) করিমন নেছা (টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে বিয়ে হয়। ইনি আব্দুল করিম ও আব্দুল হালিম গজনবীর মাতা ছিলেন), ২) বেগম রোকেয়া (ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়), ৩) বাদশাহ খাতুন, ৪) হুমেরা খাতুন। রোকেয়ার বড় বোন করিমন নেসা ও বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের হাতেই শৈশবকালে বেগম রোকেয়ার লেখাপড়ার হাতে খড়ি। তাদের ঐতিহ্যবাহী এই সাবের পরিবারে আরবি, ফারসি ও উদুর্ ভাষার প্রচলন ছিল কিন্তু বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রচলন ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। রোকেয়ার দুই সহোদর ভাই, ইব্রাহিম সাবের ও খলিলুর রহমান সাবের সবর্প্রথম সাবের পরিবারের ঐতিহ্য ভেঙে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভাগলপুর নিবাসী খানবাহাদুর সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন সে আমলে প্রথম সারির উল্লেখযোগ্য মুসলিম গ্র্যাজুয়েট (১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে মোহসেনের হুগলী কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষায় উত্তীণর্ হন)। কমর্জীবনের শুরুতে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সাখাওয়াৎ হোসেন যখন বিএ পাস করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন, বেগম রোকেয়া তখনো জন্মগ্রহণ করেননি (বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে)। সাখাওয়াৎ হোসেনের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। এই অসম বিয়েতে বেগম রোকেয়ার গভের্ দুটি কন্যা সন্তানের জন্মের কিছুদিন পর পরই তাদের অকাল মৃত্যু হয়। তার স্বামী ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া তার স্বামীকে হারান। সাখাওয়াৎ হোসেনের আকস্মিক মৃত্যু বেগম রোকেয়াকে বিপযের্য়র মুখে ঠেলে দেয়। তার ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। অকাল বৈধব্য তাকে সে যুগে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বেগম রোকেয়ার মনোবল ছিল অপরিসীম। তাই তিনি তার এই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। পরবতীর্ সময়ে মৃত স্বামীর সম্পত্তি নিয়ে প্রথমা স্ত্রীর সন্তানদের সঙ্গে তার বিরোধ হওয়ায় স্বামীর মৃত্যুর মাত্র ২ বছর পরেই ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে স্বামীর সঞ্চিত ১০,০০০/- (দশ হাজার) টাকা নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মাচর্ কলকাতার তালতলা অঞ্চলে ১৩নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের ভাড়াবাড়িতে মাত্র দুটি ক্লাস, দুখানা বেঞ্চ আর ৮ জন ছাত্রী নিয়ে স্কুলের যাত্রা শুরু করেছিলেন। মরহুম স্বামীর নামানুসারে স্কুলের নাম দিয়েছিলেন ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গালর্স স্কুল’। অভিভাবকদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলেন স্কুলে কঠিনভাবে পদার্ মানা হবে। নিজে বোরকা পরে বাড়ি বাড়ি যেতেন ছাত্রী জোগাড় করতে। স্কুলের মিটিংও করতেন পদার্র অন্তরাল থেকে। একপযার্য় স্কুলের ফান্ড শূন্য হলে তিনি বিত্তবানদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে স্কুল টিকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে রোকেয়ার হিতৈষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খান বাহাদুর তসাদ্দক আহমেদ। ইতিহাসের পাতায় সেই ৮ জন ছাত্রীর নাম লিপিবদ্ধ থাকা দরকার। কেননা, একটা যুগের পরিবতের্ন এরাই এগিয়ে এসেছিলেন ছাত্রীর নাম পিতার নাম ১) আখতারুন্নেছাÑ সৈয়দ আহাম্মদ আলী ২) জোহরাÑ সৈয়দ আহাম্মদ আলী ৩) মোনাÑ মাওলানা মোহাম্মদ আলী ৪) রাজিয়া খাতুনÑ আবদুর রব ৫) জানি বেগমÑ আবদুল ওহাব ৬) সৈয়দা কানিজ ফাতেমাÑ সৈয়দ আবদুস সালেক ৭) সৈয়দা সাকিনাÑ সৈয়দ আবদুস সালেক অষ্টম ছাত্রীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। অবশেষে তার অক্লান্ত চেষ্টায় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র তিনটি মেয়ে তার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। মেয়েদের সাবির্ক উন্নতির জন্য তিনি শিক্ষাগ্রহণকেই সবাের্গ্র জোর দিয়েছিলেন; তার স্বপ্ন ছিল নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এরই জন্য তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ‘আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামক মহিলা সংগঠন সে সময় কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শুধু সে সময় স্কুল ও ‘আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামক মহিলা সংগঠন তৈরির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বেগম রোকেয়া সে আমলে ছিলেন একজন নামকরা কবি ও সাহিত্যিক। মিসেস আর এস হোসেন নামে সেকালের বিখ্যাত পত্রপত্রিকায় তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস ও নারীদের জন্য সমাজ সচেতনমূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) সাহিত্য জগতে আবিভার্ব ঘটে বিশ শতকের প্রারম্ভে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ‘নব প্রভা’ পত্রিকায় ‘পিপাসা’ শীষর্ক রচনার মাধ্যমে সাহিত্য জগতে তার আবিভার্ব। বেগম রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর নাম হলোÑ মতিচুর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন (ইংরেজিতে লেখা), সুবেহ সাদেক, অধার্ঙ্গী, জাগো হে ভগিনী, স্ত্রী জাতির অবনতি, গৃহ ইত্যাদি। রোকেয়া সাহিত্য রচনায় বেশির ভাগ সময় লিখতেন মিসেস আর এস হোসেন। দাপ্তরিক চিঠি বা অনাত্মীয়দের কাছে চিঠি লিখতেও এই নামই স্বাক্ষর করতেন। একান্ত আপনজনদের কাছে লেখা চিঠিতে স্বাক্ষর করতেন ‘রোকেয়া বা রোকেয়া খাতুন’। রোকেয়ার সমাজ চিন্তা ও সমাজ পরিবতের্নর বিশ্বাস আধুনিক মতবাদে উজ্জীবিত। নারীর কাক্সিক্ষত মুক্তি সাধনে ও নারী শিক্ষায় উদ্দীপ্ত প্রাণ বেগম রোকেয়া তাই চিরকাল অ¤øান হয়ে থাকবেন তার আপন কীতির্ও সৎকমের্র জন্য। প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর থেকে ৩ দিনের জন্য মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া মেলা বসে। তখন মেলার পদভারে লোক সমাগমে এই এলাকাটি সরব ও কোলাহল মুখর হয়ে ওঠে। পায়রাবন্দে আরও রয়েছে বেগম রোকেয়া একাডেমি ভবন, রোকেয়া ডিগ্রি কলেজ ও বেগম রোকেয়ার জাদুঘর। জাদুঘরে থেকেও আকষর্ণ হলো বেগম রোকেয়ার মূল বসতভিটার ধ্বংসস্ত‚প ঘিরে তৈরি উদ্যানটি। ইটের দেয়াল দিয়ে গঁাথুনি দেয়া এই উদ্যানে ঢোকার মুখে রয়েছে একটি প্রবেশদ্বার। লোহার গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেই ভাঙা ইটের প্রাচীর ও পিলার। পুরনো স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ ঐতিহ্যবাহী সাবের বংশের আভিজাত্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। বেগম রোকেয়ার আত্মত্যাগ কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা কিংবা আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কমীর্ রোকেয়ার চেয়েও অনেক বড় ছিলেন সাহিত্যিক রোকেয়া। এ প্রসঙ্গে রোকেয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসির উদ্দীন বলেছেন, ‘বেগম রোকেয়া ছিলেন তৎকালীন মুসলমান নারী সমাজের স্বাধীনতার অগ্রদূত’। ‘সওগাত’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার উৎসাহ ছিল অবিস্মরণীয়। সওগাতের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম কবিতাটিও ছিল বেগম রোকেয়ার। (সওগাত প্রথম বষর্, প্রথম খÐ, অগ্রহায়ণ ১৩২৫ বাংলা প্রথম সংখ্যা, ইংরেজি নভেম্বর ১৯১৮ খ্রি.)। লেখাটির সঙ্গে ছিল একটি চিঠি। আমি কবি নই, উৎসাহ দমন করতে না পেরে এটা লিখেছি। কবিতা হিসেবে হয়তো কিছুই হয়নি, তবে অভিনন্দন হিসেবে গ্রহণ করলে খুশি হব। (তৎকালীন সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীনকে উদ্দেশ্য করে লিখা)। সওগাতের মহিলা সংখ্যা ও বেগম রোকেয়ার কথা বলতে বলতে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন (বতর্মান প্রয়াত) আপন মনে হেসে উঠেছিলেন। হাসির কারণ সম্পকের্ তিনি জানান ‘মহিলা সওগাত’ বের হওয়ার পরে বেগম রোকেয়া তার বাড়িতে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনকে চায়ের দাওয়াত করেন। লোয়ার সাকুর্লার রোডের বাড়ির নিচ তলায় স্কুল এবং ওপর তলায় বেগম রোকেয়া থাকতেন। পদার্র ওপাশে টেবিলে নাশতা দিয়ে পরিচারিকা বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পর পদার্র ওপাশে হাসির শব্দ। হাসতে হাসতে পদার্র ওপাশ থেকেই বললেনÑ‘মহিলা সংখ্যার জন্য আপনাকে অভিনন্দন’। প্রগতিপন্থি হওয়া সত্তে¡ও বেগম রোকেয়া পদার্র আড়াল থেকে কথা বলতেন। কারণ তার স্কুল। যদি বেপদার্ বলে মুসলমান সমাজ তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেয়। সামাজিক পরিবেশে এরূপ কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে বেগম রোকেয়াকে তৎকালীন টিকে থাকতে হয়েছে। রোকেয়া এই উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম নারীবাদী আন্দোলনের একজন প্রবক্তা ছিলেন একথা নিঃশংসয়ে বলা যায়। ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার শতবষের্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তার দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের এটি একটি মহৎ কাজ। এই মহীয়সী নারী উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের জন্যই মূলত তার সাহিত্য সাধনায় স্থান করে নিয়েছেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন সে আমলে নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ও অগ্রদূত। আমাদের গবর্। বাঙালির জাতি প্রেরণার উৎস। সত্য কথা বলতে কি বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব হলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই। তিনি শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা কিংবা নারী শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি; বরং সেই সঙ্গে ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে সমাজে মহিলাদের অবস্থার সাবির্ক উন্নতির জন্য তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন পুরুষ ব্যক্তিত্ব। বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন নারী। এখানে বিদ্যাসাগরের চেয়ে বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব ছিল বেশি। সমকালীন সামাজিক অনুশাসনের অচলায়তন ভাঙা ছিল তার লক্ষ্য। সুবিধাভোগী পুরুষের বিরুদ্ধে তার ব্যঙ্গ ছিল, কিন্তু নিছক পুরুষ বিদ্বেষ লালন করেননি নিজে অন্তরে। তাই নিদ্বির্ধায় তার নামের সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করে নিজের সত্তাকে পূণর্তা দিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর শীতের ভোরে ফজরের নামাজের জন্য জায়নামাজে দঁাড়িয়ে ছিলেন তিনি। ভোরের নামাজরত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মাত্র ৫২ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া ইন্তেকাল করেন। (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) শোনা যায়, মৃত্যুর পর তার ইচ্ছা ছিল তার হাতে গড়া স্কুল প্রাঙ্গণে কবর হবে এটি ছিল তার অন্তিম বাসনা। বলাবাহুল্য, সে আশাও তার পূরণ হয়নি। সে আমলে এক শ্রেণির রক্ষণশীল গোড়া মুসলমান সমাজ সে সময়ে তাকে তার স্কুল প্রাঙ্গণে জানাজা ও কবর দিতে বাধা দিয়েছিলেন। পরবতীর্ সময়ে কলকাতার কাছে ‘সেঁাদপুরে’ তার এক আত্মীয়ের বাগানবাড়িতে বেগম রোকেয়ার কবর দেয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। আজ তার চিহ্ন মাত্র কোথাও বিদ্যমান নেই। যে নারী সারাটা জীবন তার সবর্স্ব বিলিয়ে দিয়ে জাতির উন্নতির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তার কবরটিও ধরে রাখার চেষ্টা করেননি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিংবা বুদ্ধিজীবী মহল। সেঁাদপুরের কাছে পানহাটিতে একটি স্কুলবাড়িতে বেগম রোকেয়ার কবর পাওয়া গেছে বলে কলকাতার বামপন্থি মহল থেকে একবার দাবি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন ওমরকে দিয়ে দেড়যুগ আগে সেই কঙ্কালবিহীন কবরের উদ্বোধনও করা হয়েছিল। কঙ্কালটি নাকি স্কুলবাড়ি তৈরি করার সময় পাশের গঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবতীর্ সময়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ দাবি অলীক সম্পূণর্ ভুয়া। বতর্মানে বেগম রোকেয়ার উদ্বোধন করা সেই সমাধিটি এখনো রয়েছে কলকাতার সেঁাদপুরের পানহাটির ঐ স্কুল প্রাঙ্গণে। বিশ্বমানের বিচারে আমাদের মতো পিছিয়েপড়া সমাজে আজ বেগম রোকেয়া চচ্চার্র বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বেগম রোকেয়া শুধু নারীর অধিকার ও জাগতিক মুক্তির কথাই বলেননি; প্রায় এক শতাব্দী আগে সা¤প্রদায়িকতাবিহীন মুক্ত জীবনবোধ ও জীবনাচরণের উৎসাহ দিয়েছিলেন। বতর্মানে কলকাতার লডর্ সিনহা রোডে অবস্থিত বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল সরকারি বালিকা বিদ্যালয় আজও তার গৌরব ও ঐতিহ্য বহন করে চলছে।