শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাসমত সরকারের পুথি পাঠের আসর

আবু সাইদ কামাল
  ১৩ মে ২০২২, ০০:০০

হাসমত সরকার চেংখালীপাড়ায় বড়দের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত মানুষ। সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক বলেই

সম্ভবত তার নামের পাশে সরকার শব্দটি যোগ হয়েছে। দলিল লেখক হলেও তিনি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং সাহিত্যরসিক মানুষ। গ্রামের বাজারে প্রতিবছর যেমন নাটক করেন তেমনি নিজের বাড়ির উঠোনে বাঁশের চাটাই পেতে হারিক্যান বা কুপিবাতির আলোয় সুর করে পুথি পড়েন। রাতের আহারের পর পাড়ার সব পুরুষ মানুষ হাসমত সরকারের বাড়ি এসে পুথি শোনে।

তার সংগ্রহে রয়েছে অনেক পুথি। পুথিগুলো সংগ্রহ করেছে ময়মনসিংহ শহরসহ নানাস্থান থেকে। গারো পাহাড়ের পাদদেশের জমি বেচাকেনা বা হস্তান্তরের জন্য তখন ময়মনসিংহ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে কাওলা করতে হয়। এ কাজে প্রায় প্রতি সপ্তাহে তাকে ময়মনসিংহে যাতায়াত করতে হয়। প্রায় একশ কিলোদূরের পথ। যোগাযোগ ব্যবস্থা সেকেলে। বলা যায় সারাদিনের পাড়ি। কখনো বিশ কিলো হাঁটতে হয়, কখনো হাঁটতে হয় পঁয়ত্রিশ কিলো। বিশ কিলো হেঁটে বিরিশিরি পৌঁছে বাসে উঠে ঝারিয়ায় যায়। গ্রামের বাড়ি থেকে পঁয়ত্রিশ কিলো দূরে ঝারিয়া-ঝাঞ্জাইল। কখনো ঝারিয়ার বাস বন্ধ থাকলে সবটুকু পথ হেঁটেই ঝারিয়ায় পৌঁছতে হয়। ঝারিয়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে যায় ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ গেলে রাতে অবস্থান করতে হয়। সেই সুযোগে হাসমত সরকার শহর থেকে পুঁথি বা বই সংগ্রহ করে। কখনো-সখনো সময় পেলে পাবলিক পাঠাগারে পিয়ে পড়াশোনাও করে। তারও একান্ত ইচ্ছে, গারো পাহাড়ের পাদদেশের বিষয়-আশয় নিয়ে পুঁথি রচনা করা। এজন্যই তার পড়াশোনা করা।

সেদিন শরতের রাত। পাড়ার সবাই এসেছে পুঁথি শুনতে। কৃষিজীবীদের এ পাড়ায় আমন ফসল লাগানোর কাজ শেষ হয়েছে বেশ আগে। ফসলের মাঠ সবুজে আচ্ছাদিত হয়ে উঠছে। ধান গাছের শিশু-কিশোর গোছাগুলো বাতাসের সাথে শিশুদের মতো খেলা করে। এ দৃশ্য দেখে চাষিদের মন আনন্দে নেচে ওঠে। কৃষকদের হাতে তখন তেমন কাজ নেই। তাই সন্ধ্যেবেলায় হাসমত সরকারের বাড়িতে ওরা পুঁথি শুনতে আসে।

ইন্নছ আলী মুন্সি পরহেজগার মানুষ। তিনিও হারিক্যান জ্বালিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে ধর্মবিষয়ক পুঁথি শুনতে যায় সরকার বাড়ি। মুন্সি সাহেব এলে হাসমত সরকার বিষাদ সিন্ধু অবলম্বনে নিজের লেখা পুঁথি পড়ে শোনায়। তার রচিত পুঁথি শুনে সবাই অবাক হয়। হাসমত সরকারকে নিয়ে গর্বও তাদের। পুঁথিপাঠ শেষে আলাপ প্রসঙ্গে পাড়ার শ্রোতাদের হাসমত সরকার জানায়, গারো পাহাড়ের পাদদেশ এলাকার বিষয়-আশয় নিয়ে তার পুঁথি লেখার একটা ইচ্ছা আছে।

হাসমত সরকারে এ কথা শুনে ইন্নছ আলী মুন্সি বলে, আমরার এই পুরা পাড়াডার মইধ্যে আগে তো শুধু গারোদের বসবাস আছিল। ষাইট সালের গোড়ায় দক্ষিণ এলাকাত্যে আইসা আমরা কয়েকজন গারোরার কাছেত্যে জমি কিইন্যা বাড়ি করলাম। এর আগে এই পাড়ায় আছিল শুধু ইয়াছিন মোড়লের বাড়ি। ইয়াছিন মোড়ল এই দেশে আইছিল আসাম দেশেত্যে। আর সবাই তো আছিল গারো। মাত্র এক যুগের মইধ্যে এই পাড়ার সব গারো জমি-জিরাত বেইচ্যা চইলা গলো। এহন এই পাড়ায় আর কোনো গারো নাই।

জবাবে হাসমত সরকার বলে, হঁ্যা, ঠিকই কইছেন মুন্সি সাব। গারো পাহাড়ের পুরো পাদদেশে এলাকার তো একই দশা।

আমার একটা বিষয় জানার আছিল?

কী বিষয় মুন্সি সাব?

এই এলাকায় বসতি করছে আগে কারা, গারো না হাজং না বাঙালি?

আপনার এই কথার জবাব দিতে তো অনেকটা অতীতে যাইতে অইব।

বলেন না শুনি।

বেশ সময় লাগব তো। আজ তো রাত অইয়া গেছে। আগামীকাল বরং আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব।

জবাবে ইন্নছ আলী মুন্সীসহ উপস্থিত শ্রোতারা সমস্বরে তাতে সম্মতি জানায়। তখন সেই রাতের মতো আসর শেষ হয়। পরদিন আবার এশার নামাজের পর হাসমত সরকারের উঠোনে আবার আসর বসে। কিছুক্ষণ চলে পুঁথি পাঠ। তারপর আলোচনা পর্ব। আগের নির্ধারিত বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে হাসমত সরকার বলে, যে এলাকাটায় আমরা বসবাস করি, এই গারো পাহাড়ের পাদদেশ অঞ্চল আজ থেকে আটশ বছর আগে ছিল নিবিড় জঙ্গল বা বনভূমি। এই বনভূমি ছিল বন্যপশুর বিচরণ ক্ষেত্র। পশ্চিমে নিতাই নদী আর পুবে মহিলখলা নদী, এর মাঝে দৈর্ঘ্যে প্রায় ষাট কিলো এবং প্রস্থে পাঁচ কিলো পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার ছিল অরণ্যভূমি।

হাসমত সরকারে কথা শেষ না হতেই ইন্নছ আলী মুন্সি বলে, তাইলে তখন কি এই অঞ্চলে কোনো মানুষ থাকত না?

জবাবে হাসমত সরকার বলে, না তেমন কোনো মানুষ থাকত না। তবে নিচু এলাকায় বা জলাভূমিতে চলাচল করত জেলেরা। জঙ্গল এলাকাটা বাইশ্যা নামক প্রতাপশালী গারোর অধিভুক্ত ছিল। ওই সময় একটা মজার ঘটনা ঘটে।

কী ঘটনা?

উত্তর ভারতের কান্যকুঞ্জবাসী সোমেশ্বর পাঠক নানাস্থান দর্শন করে বেড়াতেন। তিনি কামরুপ-কামাখ্যা দর্শন করে গারো পাহাড়ের পাদমূলে সোশ্বেরীর তীরে আবাস নির্ধারণ করেন। তখন অরণ্যের বাইরে কিছু গারো, কিছু বাঙালি জেলে এবং মাছ ব্যবসায়ীর আবাস ছিল। জেলেদের মতে তখন বাইশ্যা গারোর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল জেলেরা। তাদের মতে বাইশ্যা গারো ছিল দুর্ধর্ষ ও অত্যাচারী। সামান্য কারণে লুণ্ঠন, ঘরে অগ্নিসংযোগসহ হত্যকান্ডে লিপ্ত হতো। সেজন্য জেলেরা সোমেশ্বর পাঠকের কাছে গিয়ে নালিশ করে। ওদের অভিযোগ শুনে সোমেশ্বর পাঠক প্রথমে বিষয়টা যাচাই করে। ঘটনার সত্যতা পেয়ে সোমেশ্বর পাঠক লোক সংগ্রহ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। বিশাল লোকবল নিয়ে বাইশ্যা গারোর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে বাইশ্যা গারো পরাজিত ও নিহত হয়। ওই সোমেশ্বর পাঠকই দুর্গাপুরে সুসং রাজ্যের গোড়াপত্তন করে। ফলে নিতাই নদীর পুব থেকে মহিষখলা নদী পর্যন্ত সুসংরাজের অধিভুক্ত হয়। সেই বিবেচনায় সুসংরাজ সোমেশ্বর পাঠকও আমাদের মতো এই এলাকায় সেটলার।

এ পর্যায়ে পুঁথি পাঠের আসরে উপস্থিত হাবু মিয়া বলে, তারপর...?

জবাবে হাসমত সরকার বলে, সোমেশ্বর এখানে সুসং-দুর্গাপুর আসার আশি বছর আগে কান্যকুঞ্জ মুসলিম শামনাধীনে চলে যায়। ১২০৩ সালে লক্ষণ সেনকে হটিয়ে বখতিয়ার খলজী বাংলা দখল করেন। বলা হয় তার আমলেই বাংলার বেশি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।

মজার বিষয় হলো, বখতিয়ারের বাংলা বিজয়েরও প্রায় একশ বছর আগে নেত্রকোনার মদনপুরে আগমন করেন শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (রা.)। তার ইসলাম প্রচারের ফলে এ এলাকার বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। তারপর সুলতানি শাসনামলে ধর্মান্তঃকরণ আরও ব্যাপক প্রসার লাভ করে।

ধারণা করা হয়, সোমেশ্বর পাঠকের সুসং রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই গারো পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায় নিবিড় অরণ্যের বাইরে বাঙালিদের মাঝে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই বসবাস করত।

আগ্রহ নিয়ে তখন ইন্নছ আলী মুন্সি বলে, হাজংদের কথা তো বলেন নাই।

জবাবে হাসমত সরকার বলে, সেই কথাতেও আসতেছি। তার আগে আরও কিছু কথা বলার আছে। গারো পাহাড়ে বর্ষাকালে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি নদীতে ঢল নামে। ব্যাপক এবং প্রবল পাহাড়ি ঢলে প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকেই কৃষিজমির ফসল বিনষ্ট করে আসছে। সেজন্য প্রজা সাধারণ সুসংরাজাকে অনেক সময় কর দিতে পারত না। এ কারণে সুসং রাজও ঢাকার শাসককে সময়মতো কর দিতে পারত না। ফলে ঢাকার শাসকের বিরাগভাজন হতো সুসং রাজ। এমন একটি ঘটনা ঘটে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাসন আমলে। সুসং রাজের কর বকেয়া পড়েছিল বলে ঢাকা থেকে সৈন্য এসে কিশোরসিংহ এবং রাজসিংহ নামে দুই কিশোরকে বন্দি করে নিয়ে যায়। তাদের ঢাকার জেলে বন্দি করে রাখা হয়। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতনের পর ঢাকার জেলখানার দ্বার খুলে দেওয়া হয়।

কাহিনী শুনে হাবু মিয়া বলে, চমৎকার কাহিনী তো! পরে কী হইল সরকার সাব?

নবাব শাসনাধীন কারাগারে বন্দি সুসংরাজ পরিবারের দুই কিশোর ভাই কিশোরসিংহ ও রাজসিংহ প্রহরীশূন্য কারাগার থেকে পলায়ন করে দুর্গাপুর চলে আসে। অতঃপর কিশোরসিংহ জমিদারির সুশৃঙ্খলার কাজে মনোযোগী হয়। নেতাই নদী থেকে পুবে মহিষখোলা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত পতিত ভূমিতে বহুসংখ্যক হাজং শেরপুর পাহাড় থেকে এনে বসত করায়। হাজংদের পাহাড় পাদদেশের শস্যাদি ও বনজন্তুর উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য নিযুক্ত করে। এ ছাড়া তাদের দ্বারা খেদা, পশুশিকার, ভারবহন, উৎসবাদিতে কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ 'চাকরান' জমি প্রদান করেন। (পৃষ্ঠা-৫৯২, ময়মনসিংহের ইতিহাস, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা)

তাইলে গারো আর বাঙালি...?

জবাবে হাসমত সরকার বলে অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে তো বনহীন কিছু সমতল ভূমি ছিল, সেগুলোয় গারো এবং বাঙালিরা ক্রমে বসত করতে শুরু করে। তবে একথা সত্য, গারো পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায় বাঙালিদের সংখ্যা গারো-হাজংদের চেয়ে কম ছিল। এরপর ষাটের দশক থেকে দক্ষিণ এলাকার মানুষ ব্যাপকহারে এ এলাকায় এসে গারো-হাজংদের কাছ থেকে জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসত গড়তে থাকে। এ প্রক্রিয়া চলে আশির দশক পর্যন্ত। এক পর্যায়ে গারো পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায় বাঙালিদের সংখ্যাধিক্য ঘটে। আমরা যারা গারো পাহাড়ের পাদদেশে আছি, আমাদের চাষাবাদ, কৃষি-অর্থনীতি যোগাযোগ ব্যবস্থায় বর্ষাকালের পাহাড়ি ঢল নানাভাবে প্রভাব ফেলে আসছে।

হাসমত সরকারে এ কথা শুনে হাবু মিয়া বলে, ঢলের কতা কী কইলেন, আমি ঠিক বুঝলাম না।

জবাবে হাসমত সরকার বলে, ওই যে আগে বললাম, সুসং রাজের দুই কিশোর ছেলেকে জেলে বন্দি করা হয় খাজনা পরিশোধ করতে না পারার জন্য। ঢলের কারণে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় প্রজা কৃষকরা খাজনা দিতে পারত না। ফলে সুসংরাজও ঢাকার নবাব শাসককে খাজনা দিতে পারে নাই। হাজংদের টংক আন্দোলনের কথা আমরা জানি। ঢলের কারণে ফসলহানি ঘটলেও সুসংরাজকে টংক বা খাজনা দেওয়া লাগত। এজন্যই কৃষকরা প্রতিবাদী হয়ে আন্দোলনে নামে।

হ্যাঁ, ঢলে তো প্রত্যেক বছর আমরার কিছু না কিছু ক্ষতি করে। জমিতে বালু তুইল্যা ফসলই নষ্ট করে না, বালু তোলায় জমির ফলনও কইম্যা যায়। জমির আইল ভাইঙ্গা নাশ-বিনাশ করে। আর রাস্তাঘাটও ভাইঙ্গা লন্ডভন্ড কইরা ফেলে।

জবাবে হাসমত সরকার বলে, ঠিকই কইছেন মুন্সি সাব। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঢলে শুধু আমাদের ক্ষতিই হয় না। ঢল আমাদের সবচেয়ে বেশি করে উপকার। কারণ, আপনারা খেয়াল করছেন নিশ্চয়, প্রতিটি ঢলের পানি যখন আমাদের ফসলের মাঠে ওঠে, কয়েক ঘণ্টা থাকার পর আবার নাইম্যা যায়। তখন বেশ পলি ফেলে যায়। ফলে আমাদের ফসলের জমি হয় উর্বর। এজন্য ক্ষেতে ধান হয় বেশি। তবে আমরা মানুষ ঢলের স্বাভাবিক গতিকে কখনো ব্যাহত করি। অনেকে হীনস্বার্থে প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। এতে স্বার্থপর কিছু মানুষ লাভবান হলেও মোটাদাগে ক্ষতি কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষেরই হয়।

এ পর্যায়ে হাবু মিয়া বলে, যেমন?

জবাবে হাসমত সরকার বলে, নদী বা খালের গতি আমরা ব্যক্তিস্বার্থে অনেক সময় পাল্টে দেই। যেমন সোমেশ্বরীর দু'টি শাখার একটি বন্ধ করার জন্য বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। শেষে যদিও সেটা রাখতে পারে নাই। তেমনি নাজিরপুর বাজারে যাওয়ার পথে রামপুর বাজারে একটা খাল ছিল, সেই খালটি ভরাট করে ফেলা হলো। এখন ঢল এলেই তার চড়া মূল্য দেয় ওই এলাকার সাধারণ মানুষ। আমাদের কুড়াখালের একটা সংযোগ ছিল মঙ্গলেশ্বরীর সঙ্গে। সেটা বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমাদের মাঠের মাঝ দিয়ে ঢলের পানি যাওয়ার জন্য বর্ডার-সড়কের উত্তর পাশে ঢলের পানি যাওয়ার মতো একটা ব্যবস্থা ছিল, সেটা বন্ধ করে দেওয়া হলো। এ রকম প্রতিটি এলাকায় অসংখ্য নজির আছে। এতে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতি হয়েছে ব্যাহত। মানবসৃষ্ট এসব সমস্যাগুলোর কারণে ঢল নামলে সাধারণ মানুষের ঘর-বাড়িতে বা ফসলি জমিতে ঢলের পানি উঠে বেশ ক্ষতি করে।

হাসমত সরকারের কথার রেশ টেনে হাবু মিয়া বলে, ঠিকই কইছেন সরকার সাব। অনেকেই ঢলের পানি যাওনের রাস্তা আটকাইয়া দিছে। এজন্যই তো বড় ঢল নামলে সহজেই আমগর বাড়ি-ঘরে পানিতে ভাইস্যা যায়।

জবাবে হাসমত সরকার হাসতে হাসতে বলে, তাহলে বিষয়টা বুঝতে পারছেন সবাই। এসব বিষয়ে আমগর সচেতন হওয়া লাগবে। আর একটা ঢলের কথা বলা যায়। ষাইটের দশক থেকে দক্ষিণের এলাকা থেকে গারো পাহাড়ের পাদদেশে সেটলার বাঙালিদের ঢল নামে, ওই ঢলের চাপে কিন্তু এই এলাকার গারো-হাজংয়ের সংখ্যা কমতে থাকে। যদিও দেশ বিভাগের দুই বছর পর টংক আন্দোলনের নামে কমউিনিস্ট সমর্থিত যে সশ্রস্ত্র আন্দোলন শুরু হইছিল, পাক সরকার তা কঠোর হাতে দমন করে। সেই আন্দোলনে পরাজয় বরণ করে সশস্ত্র বিপস্নবীরা। তার কারণে হাজংরা পাক সরকারের রোষানলে পড়ে। সেই সময় হাজংদের দেশ ছাইড়া যাওনের হিড়িক পড়ে। পাকিস্তানি শাসনের শেষ দশকে হাজংরা ব্যাপকহারে এদেশ ত্যাগ করে।

চৌষট্টি সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার গুজব ছড়ায় এলাকার হাজংদের মধ্যে। তখন ওই গুজবে কান দিয়ে হাজংদের অনেকে জমাজমি সহায়-সম্পত্তি রাইখ্যাই ওই পাড়ে চলে যায়। ওই সময়ই হাজংরা ব্যাপকহারে ওই পারে পাড়ি জমায়। তারপরের বছরগুলোয় অনেকে জমাজমি বিক্রি কইরা ওই পাড়ে যায়। গারোরা অবশ্য বাঙালিদের কাছে জমাজমি বিক্রি কইরা কেউ মেঘালয়ে যায়, কেউবা সীমান্তের আরও কাছাকাছি যায়; কেউ কেউ আবার সিলেটের সীমান্ত এলাকায় স্থানান্তরিত হয়।

পুঁথি পাঠের আসরে এসব আলোচনা করতে করতে রাত গভীর হয়। এ পর্যায়ে ইন্নছ আলী মুন্সি বলে, সরকার সাব! অনেক কিছু জানলাম। বেশি রাইত অইয়া গেছে। আইজ তাইলে উডি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে