স্মৃতি কথা অমৃত ব্যথা
প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০
সুরভি জাহাঙ্গীর
আমার কাছে বিজন নামটা শুধু অতীত কোনো স্মৃতি কথা নয়, বরং অমৃত ব্যথা! আমার কাছে বিজন মানে, অতি চেনা মনে পড়া আজকের লেখা গল্প কথা! আমার তখন বয়স কত ছিল জানি না। আজও স্মৃতির সঙ্গে হিসাব কষেও সঠিক করে বলতে পারব না। আর সে সময় বিজন দাদাকে আমার ছোট্ট চোখে অনেক বড় মন হতো। এখন অবশ্য আন্দাজ করে এবং পরিবার থেকে শোনা গল্প থেকে বলতে পারি, বিজন দাদার বয়স চৌদ্দ বছরের মতো ছিল। ফর্সা ছিপছিপে লম্বাটে গড়নের ছিল। আজও চোখে আঁকা আছে, সেভাবেই। বিজন দাদারা অনেক ভাই-বোন ছিল। বিজন দাদার বাবাকে আমরা সবাই কালাচাঁদ মামা আর বিজনদার মাকে টুকু মাসি বলে ডাকতাম।
প্রতিদিন বিকালে বাড়ির সামনের প্রকান্ড মাঠের মধ্যে পাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে মিলে খেলত। একে একে হরেক রকমের খেলা খেলত। ছি বুড়ি, গোলস্নাছুট, বউ চোর, রুমাল চোর, খটাস, ইচিং বিচিং, কুমির কুমির, যুদ্ধ যুদ্ধ ইত্যাদি। আমি বন্ধ ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ছোট চোখে অবাক করা বড়দের খেলা দেখতাম। ছোট ছিলাম তাই, আমার মা ভয় দিয়ে বলত, বড়দের সঙ্গে খেলতে গিয়ে আমি ব্যথা পাব, নয়তো বাহিরে গেলে ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে। সেই ভয়ে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে বাহির দেখা আর সারাবেলা মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে ঘুরঘুর করা। এভাবেই সময় কাটত আমার। তবে আমি সবকিছুই উৎসুক মনে, নিখুঁত চোখে ধরে রাখতাম।
আমার দিদিরা আর বিজন দাদাদের সবাইকে স্কুলে যেতে দেখতাম। আমি ভাবতাম বড় হওয়ার কত মজা। বড় হলে কত কিছু করা যায়। আজ অবশ্য বড় হওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করি। আজ বুঝতে পারি, বড় হয়ে যাওয়া মানে দূরে সরে যাওয়া, আর দূরে সরে যাওয়া মানে পর হয়ে গিয়ে, হারিয়ে কাঁদা!
এমন অবাক আনন্দের অনুভূতির মধ্যেই দিন কাটছিল। প্রতিদিন ঘুম ভাঙতেই, আমি বিস্ময়ের একটা করে দারুণ দিন উপহার পেতাম। রাত আর দিনের রং-বেরঙের বিস্ময়ের রহস্যে, আমি মুগ্ধমনে দিন কাটাতাম।
হঠাৎ এক সকালে জেগে উঠে দেখি, কেউ স্কুলে যায়নি। কেউ খেলছে না, কেউ হাসছে না। সেদিন নতুন অবাক করা দিন ছিল। বাড়ির সবার মন ভারী। বিজনদাদারা সবাই কাঁদছিল। বড়দের এমন ছবি দেখে, কিছু না বুঝেও আমিও কাঁদতে শুরু করলাম। ছোট্ট বুদ্ধিতে বুঝতে চেষ্টা করে বুঝলাম যে, বড়রা হয়তো ভয় পেয়েছে। তাই আমিও ভয় পেলাম আমার মতো করে। সেদিন প্রথম অবাক মনে, নতুন করে বুঝলাম, অবাক হরেক রকমের হয়।
নতুন দিনের অবাক করা ভয়ে ভীত চোখে আমি কাঁপতে থাকলাম। বাড়ির সবাই বলতে থাকল কালাচাঁদ মামার নামে দেশ ছাড়ার উড়ো চিঠি এসেছে। কেউ কেউ বলল, আজকে সন্ধ্যার মধ্যেই দেশ ছাড়ার হুমকির চিঠি এসেছে।
তখন আমি সত্যিই দেশ ছাড়ার হুমকি না বুঝলেও উড়ো চিঠির বিষয়টি নিজ মনে সাজিয়ে নিয়ে বুঝেছিলাম নিজের মনের মতো করে। যেমন আকাশ থেকে হয়তো, কোনো চিল উড়ে এসে কালাচাঁদ মামাকে ভয় দিয়ে গেছে, তাকেই হয়তো উড়ো চিঠি বলে। কারণ আমার মা প্রায়ই বলত আকাশের দিকে তাকাবে না, তাহলে চিল এসে চোখ তুলে নিয়ে যাবে! এখন অবশ্য সবটা পরিষ্কার মিলিয়ে নিতে পারি খুব সহজেই।
এখন হুমকি, ধামকি, ছলনা, কলা, ঘৃণা, চোখের শাসন, নোংরামি সবকিছুই বুঝতে পারি। আসলে বড় হয়ে গেলে চোখটাও যেন অচেনা নোংরাতে ভরে ওঠে।
সেই রাতে আমাদের ঘরে সারি সারি খাবার সাজিয়ে মা সবাইকে খেতে ডাকছিল। দারুণ মজা হবে, সবাই একসঙ্গে খাব ভেবে। এমন সময় কালাচাঁদ মামা বুক চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। ভাতের থালাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, দেশের ভাতের বরাত উঠে গেছে দিদি। রিকশা এসে গেছে বিজন, বিমান, ধীমান, বিধান, লাকী, পাখি তোমার সবাই রিকশাতে উঠে বস। আমাদের রাতের মধ্যেই ওপার যেতে হবে। অর্থাৎ ভারত যাওরার কথা বলছিল মামা। বাড়ির সবাই মুখ চেপে ধরে কাঁদছিল। যেন কেউ শুনতে না পায়।
বিজন দাদা রিকশায় উঠে বসতেই, কী মনে করে যেন আবার রিকশা থেকে নেমে, দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। সবাই বিজনদার পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। বিজনদা দৌড়ে গিয়ে তার ঘরের পাশে থাকা চুনের বালতিতে বারুন ডুবিয়ে, যে ঘরটাতে থাকত সেই ঘরের দেয়ালে বড় বড় সব অক্ষর লিখে, আবার রিকশায় গিয়ে বসল। সবাই বলতে লাগল বিজন তার নিজের নাম লিখে, স্মৃতি রেখে গেল দেয়ালজুড়ে। আমার বিস্ময়ে ভাবনা ভাবতে থাকে, এই আঁকিবুঁকির অক্ষরগুলো কিভাবে বিজন দাদা হতে পারে? সেদিন সরল মনে কিছুই আবিষ্কার করতে পারি নাই।
এরপর রিকশাগুলো চলতেই টুকুমাসি টুক করে নিচে পড়ে গেল। সবাই কাছে গিয়ে বলল, দাঁত লেগে গেছে। তাই চোখে-মুখে জল দিতে হবে। কালাচাঁদ মামা বলল, জলের দরকার নাই। কারণ হাতে সময় খুব কম। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, উড়ো চিঠির নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ত্যাগ করতেই হবে। তাই অজ্ঞান অবস্থাতেই টেনে রিকশায় উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।
অন্ধকারে রিকশা মিলিয়ে যেতেই, আমি শব্দ করে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম। জানি না সেদিন ভয়ে নাকি স্বজন হারানোর ব্যথায় কেঁদেছিলাম। তবে আজ মনে হয় পরম আত্মীয় হারানোর যন্ত্রণাতেই কেঁদেছিলাম। কখনো মনে হয় নাই বা আজও মন হয় না যে, তারা আমাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিল। আপন-পরের হিসাবের সম্পর্ক ছিল না। আত্মার আত্মীয় ছিল সবাই।
বিজন দাদাদের বিদায়ের পরদিন আমি 'বিজন' লেখা দেয়ালটার কাছে খুঁজতে থাকি তাদের সবাইকে। আমি তখনো জোড়া শব্দ শিখি নাই অথচ কয়েক দিনের ব্যবধানে আমি 'বিজন' শব্দটা শিখে নিলাম। এটা ছিল আমার বিস্ময়কর আবিষ্কারের বিশাল বিজয়!
এরপর সময়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমি বড় হতে লাগলাম। একসময় আমি কিশোরী রং মেখে কিশোরী হলাম। আমি কিশোরী হতেই 'বিজন' দাদাদের ঘরে কয়েকবার নতুন ভাড়াটিয়া এলো এবং গেল। এদিকে দেওয়ালটা ধীরে ধীরে ঢেকে দেওয়ার শেওলার জোর চেষ্টা চলছিল। আমার মেয়েবেলার মনের পরিবর্তনও জোরগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছিল। আমি রং বদলের রদবদলের ঢেউয়ের স্রোতে ভাসছিলাম ঠিকই কিন্তু 'বিজন' দাদাদের কাউকেই তখনো ভুলি নাই বা আজও ভুলি নাই।
আমি প্রায়ই শেওলা-ছাতার ঢাকা দেওয়ালের 'বিজন' লেখা আবছায়া নামটার দিকে তাকিয়ে, কালাচাঁদ মামা, টুকু মাসিদের সবাইকে দেখতে পেতাম।
এরপর একদিন নতুন ভাড়াটিয়া আসবে বলে পুরনো দেয়াল রং করার দরকার। তাই বাবা রং মিস্ত্রি ডেকে দেয়াল রং করাতে ব্যস্ত। আমিও বাবার সঙ্গে সঙ্গে রং করা তদারকি করছিলাম। সারা দেয়াল রং করা শেষে 'বিজন' নাম লেখা অক্ষরটার কাছে মিস্ত্রি আসতেই, আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম। বাবা অবাক হয়ে আমার হঠাৎ কান্নার কারণ জানতে চাইল। আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম, বাবা 'বিজন' দাদা লেখা মুছে যাবে!
সেদিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা কি বুঝেছিল জানি না। তবে বাবা রং মিস্ত্রিকে বলেছিল, আর দেয়াল রং না করতে। বরং 'বিজন' নামের অক্ষরগুলো নতুন করে রং তুলি দিয়ে স্পষ্ট করে লিখে দিতে।
আজ বহু বছর পরে ব্যস্ততার মধ্যেও অনেক লেখার ভিড়ে মনে পড়ে গেল সেই 'বিজন দাদাদের'!
যদিও আমার লেখা গল্প, উপন্যাস বা কবিতায়, বিজন, বিমান, ধীমান, বিধান, লাকী, পাখি নামে অনেক চরিত্রের নাম রেখে থাকি, তাদের মনে করে। জানি না এই জীবনে আর দেখা হবে কি না!
তবে সেই ছোট্ট রানু নামে শিশুটিকে হয়তো তারা মনের কোণে ধরে রেখেছে, নয়তো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে ফেলেছে। যদিও মনে পড়ে বা মনের কোণে স্মৃতিকণার মতো ছোট্ট বিন্দু বলে অকস্মাৎ যদি থেকে থাকি, তবুও কেন মনে পড়ে স্মৃতি কথার, গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্র আমি নই।
কেবলই স্মৃতির গল্পের হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু মুখের স্মৃতিচিহ্নের ছবি চরিত্র মাত্র। কেউ কখনোই জানবে না, সেই শিশুমনের অন্তরের অনুভূতিগুলোছিল, অনেক বড়দের থেকেও অনেক বেশি বিস্তৃত।