পাপিষ্ঠ মন

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

প্রিয়তু শ্যামা
আমি প্রিয়বালা মুখার্জি। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে উঁচু পদে আসীন আছি। আমাকে কোম্পানির হয়ে সব সময়ই অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রায় দিনই মিটিং, প্রেজেন্টেশন, পার্টি হরদম লেগে থাকে। সারাদিন অফিসের নানান কাজের ভিড়ে আমি ভুলে যাই আমার একটা সংসার আছে, একটা শান্তির নীড় আছে। এমন না যে, আমার বাড়িতে কেউ নেই কিংবা অশান্তির সংসার। আমার চার বছরের একটা ফুটফুটে পরির মতো লাল্টুস কন্যা আর প্রেমময় ব্যস্ত মার্কা স্বামী বর্তমান। সে অবশ্য এতটাই ব্যস্ত ডাক্তার সাহেব, যে তাকে সংসারের কোনো কাজেই আমার সহসা পাওয়া হয় না। সে নামেই সংসারের কর্তা। আদতে তাকে পেতে হয় নিশীথের ঘন আঁধারে আর সকালের নাস্তার টেবিলে। সংসারটা চলেই রমার হাতে ভর করে। রমা আমার সাহায্যকারীর নাম। মা'র দেশের বাড়ির লোক। আছেও আমাদের বাড়িতে অনেক বছর ধরেই। ও-ই আমার সংসারটাকে নিজের মতো করে আগলিয়ে গুছিয়ে একেবারে পরিপাটি করে রাখছে। আমার কন্যা আমাদের চেয়ে ওকেই বেশি খোঁজে। সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর আমি যখন আমার ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহটাকে ঠেলেঠুলে বাড়ি নামক শান্তির মন্দিরটাতে প্রবেশ করাই, তখন সত্যিই আমি তলিয়ে যাই নিজের মধ্যে। অনেকটা সময় লাগে আমার নিজেকে সংসারের ছন্দে ফিরিয়ে আনতে। আমার ছোট্ট তুলতুলিটাকে পর্যন্ত রমা তখনও নিজের কাছে ভুলিয়ে রেখে দেয়, যাতে করে আমি আমার জন্য আরও কিছুটা সময় বাড়তি পাই। বলেন ওর প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়ে কি আমার কোনো উপায় আছে? আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ ওর প্রতি। তবে কথায় আছে, 'তুই দিলে মুই দেই, একলা একলা কত দেই', মানে ব্যাপারটা হচ্ছে, রমা আমার বাড়িতে বেশ স্বচ্ছন্দ। ওর পরিবারের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব আমার কাঁধে। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা কী ভাইয়ের পড়ার খরচ, সবই আমি দেখে থাকি। আরেকটা ব্যাপার হলো, আমি রমাকে কাজের মেয়ের মতো করে রাখি না, ভাবিও না। রমা আমার পরিবারের একজন হয়েই থাকছে শুরু থেকে। আমার অনেক গোপন কষ্টের সাক্ষীও থাকে এই রমাই। রমাকে বলতে পারব না, এমন গোপন কষ্ট অবশ্য আমার নেইও। মোদ্দাকথা রমাকে সবই বলা যায়। রমা আপাদমস্তক একজন বিশ্বস্ত মানুষ এটাই এতদিন ধরে মন বলে গেছে। তবে অশোক আমার স্বামী, এসব সে পছন্দ করে না। ওর কাছে কাজের লোকের একটা নির্দিষ্ট সীমানা থাকা উচিত। সে বাসায় থাকলে আমি কিছুটা মিইয়ে চলি এই যা। তবে তার কর্মসূচির কারণে বেচারা বেশির ভাগ সময় বাইরেই থাকে। তাই তার জানাও হয় না, রমা তার পরিবারে কতটা পোক্ত আসন নিয়ে ডাইনিং রুমে আমার সঙ্গে বসে খায়, আড্ডা দেয়, টিভি দেখতে দেখতে হেসে গড়িয়ে পড়ে। সব তো ঠিকই ছিল। এমন থাকলেই ছায়াছবিটা চমৎকার দাঁড়াত। কিন্তু বাধ সাধল আমার বিবস্ত্র বিবেকের হঠকারী নিছক মিথ্যে ক্ষণিকের একটা বিচ্ছিরি ভাবনাতে। স্মৃতিকে চুইংগামের মতো একটু টেনে ধরলে বুঝতে পারি আমি আসলে একজন খুব নিচু মনের মানুষই। এই যে এতদিন নিজেকে যতটা সুশীল সমাজের উন্নত রুচির সাম্যবাদী মানুষ ভেবে এসেছি সবই আসলে মিথ্যে, ঠকবাজি। আমার কার্ল মার্কস, লেনিন পড়া মন আজও সেভাবে শুদ্ধ হতে শেখে-নি। যে আমি আমার সাহায্যকারীকে কেউ কাজের লোকের মতো ট্রিট করলে রেগে যেতাম, যে আমি কোনো রেস্টুরেন্টে গেলে মেনু্য কার্ডটা রমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতাম, কী খাবে? সেই আমিই, হঁ্যা হঁ্যা, সেই আমিই সেদিন আমার প্রিয় একটা গয়না খুঁজে না পেয়ে মনে মনে রমাকেই সন্দেহ করে বসলাম! ছি ছি কী ভীষণ ভয়ংকর পাপ ভাবনা! আমি রমার অজান্তে, রমা যখন ওয়াশ রুমে তখন ওর ডেস্ক চেক করলাম। না, পাইনি। পাবার কথাও নয়। রমা এমন কাজ করতেই পারে না। কিন্তু আমি তো তা মনে রাখিনি। রমার সঙ্গে স্বাভাবিকও হতে পারছিলাম না টানা কয়টা দিন। যে আমি অফিসে গেলে সংসারকে ভুলে থাকতাম, সেই আমিই অফিসে বসে বসে রমাকে নিয়ে ভেবেছি। ভেবেছি রমাকে কীভাবে জিজ্ঞেস করব- গয়নাটা হারিয়ে কোথায় গেল? কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, গয়নাটা আসলে হারায়নি। আমার কাছেই ছিল। অনেক গয়নার ভিড়ে আমি এটাকে ভুলে লকারে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। তাই আজ যখন গয়নাটা হাতে পেলাম, তখন নিজেকে বাটখারায় ওজন দিয়ে দেখছি আমি আসলে কতটা অমানবিক, অমানুষ, পাপিষ্ঠা। আমি কীভাবে পারলাম ওকে সন্দেহ করতে! এটা কেনই-বা করলাম! কেন আমরা আসলে একজন সাহায্যকারীকে শুধু আউট সাইডার হিসেবেই ভেবে নিই? কেন ভাবতে পারি না সেও আমার পরিবারেরই একজন হতে পারে, হয়ে যায়? কেন কিছু খুঁজে না পেলে প্রথমেই ওদের মুখটা-ই চোখের তারায় ভেসে ওঠে? কেন, কেন, কেন? তবে এই যে এতদিন রমাকে এত ভালোবাসলাম, সবই কি স্বার্থের জন্যই ছিল? স্বার্থের বাইরে তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! আজ থেকে আর কোনো দিন আমি রমার সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে সেই আগের মতো করে হেসে গড়িয়ে পড়তে পারব না। নিজের নোংরা মনটার জন্যই আজীবন রমার কাছে আমাকে হেরে থাকতে হবে। অথচ রমা জানতেও পারল না, ওর সঙ্গে আমি কত বড়ো একটা অন্যায় করে বসে আছি। রমারা সবাই আসলে খারাপ হয় না, চোরও হয় না। আমরাই রমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ওদের দূরের মানুষ করে তুলি। তাই দিনে দিনে রমাদের সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। রমারা নিজেদের আর গৃহকর্মী হিসেবে দেখতে চায় না। ওরা এখন চাকরি করে। নিজেদের চাকরিজীবী হিসেবে দেখতেই ওদের স্বস্তি। হোক সেটা গার্মেন্ট কী কোনো কারখানার কর্মী। তবুও তো আত্মসম্মানটা অক্ষত থাকছে। সব রমারা ভালো থাকুক, আর আমার মতো পাপিষ্ঠদের বিবেক জাগ্রত হোক।